শুরু হয়ে গেছে ভোটের ঢামাডোল। এমন ঢামাডোলের মধ্যে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারন এখনও এ সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে স্পষ্ট কিছু নেই। গণভোট নিয়েও বিএনপি এক স্থানে। জামায়াত-এনসিপি অন্যস্থানে। এখানেই ঐক্যমত নেই। তাহলে যে ঐক্যমত কমিশন দীর্ঘ ৯ মাস বহু মিটিং করে একটা সনদ দাঁড় করালো তার শেষটা কী। সব ঠিক আছে। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সেস্থানেই আবার অনৈক্য রাজনৈতিক দলসমূহের।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে এটি কীভাবে কার্যকর হবে এ নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। কমিশন তাদের সুপারিশে নতুন একটি ধারায় “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, আগামী সংসদ নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রথম ২৭০ দিন (৯ মাস) “সংবিধান সংস্কার পরিষদ” হিসেবে কাজ করবে। তারা ২৭০ দিনে জুলাই সনদের সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো কার্যকর করতে না পারলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হবে। জুলাই সনদ সইয়ের আগে এই ধারাটি যুক্ত ছিল না। কিন্তু এ প্রক্রিয়া পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন কিছু বলে অনেকেই মনে করছেন। এমন এভাবে একটা প্রস্তাবনা অটো পাশ হয়ে আইনে রূপ নেবে এটাও অকল্পনীয় একটা ব্যাপার।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও সমমনা দলগুলোর পক্ষ থেকে “গণভোট” জাতীয় নির্বাচনের দিনে করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও এটি তার আগেই করা যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছে কমিশন। এছাড়া “নোট অব ডিসেন্ট” বাদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আগেই বলে আসছে, তারা নির্বাচনের দিন গণভোট চায় না। তাদের দাবি, নভেম্বরেই গণভোট এবং সেই প্রক্রিয়ায় সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। দলটির দুটির নেতাদের ধারণা, একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট হলে গণভোটের প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে।
এনসিপিসহ চার বাম দল এখনও সনদে সই করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর এমন দ্বিমতের বাস্তবতায় জুলাই সনদ আদৌ কার্যকর হবে কি-না সে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপি ক্লিয়ার বলছে তারা নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের গণভোটের পক্ষে নেই। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলছেন, জাতীয় ঐক্যমত কমিশন রাজনীতিতে ঐক্য করতে যেয়ে অনৈক্য সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, “সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে তাদের কনস্টিটিউশন পাওয়ার বা গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়ার কথা আমরা কেউ কেউ বলেছিলাম। তবে তারা ২৭০ দিনে কার্যকর করতে না পারলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আইনে পরিণত হয়ে যাবে, এমন প্রস্তাব পৃথিবীর কোনও দেশে আছে কিনা জানা নেই। আমি মনে করি, এটি পরবর্তী সংসদের ওপরই ছেড়ে দিলে ভালো হতো। আর সময়সীমা ৯ মাসের পরিবর্তে ৬ মাস হওয়ার দরকার ছিল।” তিনি আরও বলেন, “জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের প্রস্তাব বেশিরভাগ দলেরই ছিল। সেখানে কমিশন তার আগেও গণভোটের প্রস্তাব দিয়েছে, এটা ঠিক করেনি।” তবে নোট অব ডিসেন্ট না রাখাকে তিনি ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।
এ নিয়ে ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ হস্তান্তরের পর বিকালে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “এ সুপারিশে কমিশন ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করেছে। অঙ্গীকারনামায় সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। নোট অব ডিসেন্টও বাদ দেওয়া হয়েছে।” তিনি কমিশনের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিহিত করেন।
জুলাই সনদে কী কী থাকবে সে বিষয়ে একাধিক প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে এটি কার্যকরে তিনটি প্রক্রিয়ার ওপর দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রথম প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক একটি পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। গণভোটে অনুমোদন পাওয়া সংবিধান সংস্কার বিল পরিষদের সহায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে এবং পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সরকার জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫- এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংশোধনের বিষয়গুলো কার্যকরের জন্য “জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫” জারি করবে।
আদেশ এবং এর তফশিলে উল্লিখিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। আদেশ জারির পর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে, যা সংবিধান সংস্কারের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবে। যেখানে একটি প্রস্তাবে জাতীয় সংসদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার পাশাপাশি একইসঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
অন্য প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে এবং সংস্কার কার্যক্রম শেষ হলে পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হবে।
এ ব্যাপারে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, “জুলাই সনদ নিয়ে রাজনীতিবিদদের অতীতে কোনও ধারণা ছিল না। তারপরও আমরা এর কার্যক্রমে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেছি। কমিশন সুপারিশ করেছে ভালো কথা। কিন্তু অধ্যাদেশের যে কথা বলা হয়েছে, তা তো সংবিধানে নেই। তাই বিষয়টি পরবর্তী সংসদের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে।”
কমিশনের সুপারিশের মাধ্যমে জুলাই সনদ কার্যকর প্রক্রিয়া ইতিবাচক ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ। তিনি বলেন, “তিন ধাপে সনদ বাস্তবায়নে কমিশন যে সুপারিশ দিয়েছে, তা ভালো দিক।”
সংবিধান সংস্কার পরিষদকে গাঠনিক ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে তার সমর্থন রয়েছে। তবে গণভোট নভেম্বরই করার পক্ষে তার দল। তার মতে, জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের আয়োজন কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তার ভাষ্য, এতে নির্বাচনি প্রচারণার ঢেউয়ে গণভোট গুরুত্ব হারাতে পারে। অবশ্য যেকোনও প্রক্রিয়ায় জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। এক্ষেত্রে কোনও অনিশ্চয়তা দেখছেন না এই জামায়াত নেতা।
সংবিধানের চার মূলনীতি প্রশ্নে গত ১৭ অক্টোবর জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেনি চার বাম দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ)। ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিশনের দেওয়া সুপারিশকেও তারা একপেশে হিসেবে দেখছেন। তাদের অভিযোগ, কমিশন কথা রাখেনি।