২৮ নভেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৬:৪৫:৫২ পূর্বাহ্ন


হাসিনাকে দেশে ফেরাতে কঠোর এজেন্ডা : নেপথ্যে অন্য কিছু
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-১১-২০২৫
হাসিনাকে দেশে ফেরাতে কঠোর এজেন্ডা : নেপথ্যে অন্য কিছু শেখ হাসিনা


সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়েই আনতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। এর পাশাপাশি তাকে দেশে এনে তার জন্য নির্ধারিত শাস্তি কার্যকরও চায়। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত শক্তভাবেই এগুচ্ছে সরকার। উদ্দেশ্য হচ্ছে এতে করে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে আর যেনো আওয়ামী লীগ বেশি বাড়াবাড়ি করতে না পারে। এবং দলটির এই সভানেত্রী ও তার পরিবারের পক্ষ থেকেও যেনো আর কখনোই হাল ধরতে না পারে। তবে শেখ হাসিনাকে দেশে এনে ও তার বিরুদ্ধে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার শক্ত প্রচেষ্টার পেছনে আরও কিছু গোপন ও প্রকাশ্যে কৌশলও আছে অন্তর্বর্তী সরকারের। 

২০২৪ সালের ছাত্র বিক্ষোভে সহিংস দমন-পীড়ন চালিয়ে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে এখন ভারতে। বিক্ষোভে সহিংস দমন-পীড়ন চালানোয় দায়ে তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দায়ি করে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আর দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।

যে কারণে শেখ হাসিনাকে চায় অন্তর্বর্তী সরকার

তবে এই রায় দিয়েই সরকার ক্ষান্ত নয়। একটি সূত্র জানায়, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া শেখ হাসিনাকে ভারতে থেকে বাংলাদেশে আনার প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হচ্ছে। এর পাশাপাশি প্রয়োজনে তাকে এনেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে। ওই সময়ে সৃষ্টি পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও মাস্টার প্ল্যান আছে সরকারের। বিষয়টি স্পস্ট বোঝা যায় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্যেও। তিনি সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিং এ জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফেরত চেয়ে ভারতকে চিঠি দেওয়া ছাড়াও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার কথা ভাবছে সরকার। এমন খবরে দেখা যাচ্ছে শেখ হাসিনার শুধু ফেরত চেয়ে-ই ভারতকে চিঠি দেওয়া নিয়ে সরকার চুপচাপ থাকছে না বা থাকবে না। বিষয়টি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বিশ্ব দরবারেও যাবে। অর্থ্যাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার নিয়ে কাজ করে যাবে সরকার। এবিষয়টি আরও স্পষ্ট হিসাবে প্রকাশ হয়েছে সিএনএনের প্রতিবেদনেও। বলা হয়েছে সাবেক নেত্রীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর চায় বাংলাদেশ। অবশ্য ওই রির্পোটে আরও জানানো হয় যে এই পথে বড় বাধা ভারত। 

ড. ইউনুসের ইমেজ ও ক্ষমতা কাজে লাগানো হবে

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার ব্যাপারে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শক্তভাবে প্রভাব খাটাতে পারেন। এব্যাপারে একটি সূত্র জানায়, বেশ কয়েকটি কারণে এ তৎপরতা চালানো হচ্ছে। প্রথমত ভারত যেনো শেখ হাসিনাকে দাবার গুটি হিসাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশে পুনরায় আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে চেষ্টা না করে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা বা তার দল বাংলাদেশে যেনো কোনো ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি না করতে পারে। এর পাশাপাশি সরকার চায় ভারত শেখ হাসিনাকে সেদেশে রেখে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। আবার এই শেখ হাসিাকে দিয়ে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরি করে ভারত যেনো কোনো ধরনের ভূ-রাজনৈতিক সুবিধা না করতে পারে

তবে ভিন্ন উদ্দেশ্যও আছে

একটি সূত্র জানায়, অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনা যেনো ভারতে চুপচাপ থাকেন। কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য না দেন। বলেছিলেন, ভারতে থাকাকালে শেখ হাসিনাকে অবশ্যই “চুপ করে থাকতে হবে” এবং বিচারের জন্য তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত ভারতকেই তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু এ পর্যন্ত তা করা হয়নি। কয়েকমাস আগে প্রধান উপদেষ্টা এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। সেখানে শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে বলেছিলেন তিনি। কিন্তু জবাবে মোদি বলেছিলেন তিনি এটি পারবেন না। কারণ ভারতে সবাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। অর্থাৎ শেখ হাসিনা সামাজিকমাধ্যম ব্যবহার করে কিছু বললে সেটি তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মুখে ওপর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এমন জবাব তিনি (মুহাম্মদ ইউনূস) সাদামাটে নেননি । সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ছাত্র বিক্ষোভে সহিংস দমন-পীড়ন ও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে মেরে ফেলে টিকতে না পেরে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে শেখ হাসিনা। অথচ ছাত্র-জনতার ওপর এমন হত্যাযজ্ঞ চালানোর হোতাকে দেশে আশ্রয় দেওয়া থেকে নিয়ে তার উসকানিমূলক বক্তব্য ভারত এভাবে স্বাভাবিকভাবে নেবে তা কিন্তু অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ধারণা করতে পারেনি। তা-ই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুপ্রাপ্ত ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ভারতকে চিঠি দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না ইউনূস সরকারের তৎপরতা। এখন তার পদক্ষেপ বা কার্যক্রম আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও পর্যন্ত গড়াবে বলে কারো কারো অভিমত। অন্যদিকে এব্যাপারে দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত কূটনৈতিক যোগাযোগ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। যেনো বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার একজন গুরুতর অপরাধীকে তার দেশে আশ্রয় দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বার্তা দেওয়া হবে বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ছাত্র বিক্ষোভে সহিংস দমন-পীড়ন ও ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর দায়ে সাজা পেলেও ভারত এনিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। 

সিএনএনের প্রতিবেদনই একই বার্তা

এদিকে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাবেক নেত্রীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর চায় বাংলাদেশ, এই পথে বড় বাধা ভারত। কারো কারো মতে, এ রিপোর্টও ভারতের আদর্শিক ইমেজে ধাক্কা দিবে। কেনোনা ওই রিপোর্টে স্বীকার করে বলা হয়েছে যে কেমন ছিল শেখ হাসিনার শাসনামল? কেমন ছিল মানবাধিকারের অবস্থা? ইঙ্গিত করা হয় যে শেখ হাসিনা তার স্বৈরাচারী শাসন টিকিয়ে রাখতে কিভাবে ভারতরে ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত রির্পোটের একটি অংশে দেথা যায় ‘পরবর্তী ১৫ বছর তিনি ক্রমেই কঠোরতার সঙ্গে বাংলাদেশ শাসন করেন এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যুগের সূচনা করেন। একই সময়ে তিনি ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন দেন, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তির মাধ্যমে নয়াদিল্লির হাতকে শক্তিশালী করেন, যা পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বৈরিতা টেনে আনে। তবে বাংলাদেশের উন্নয়নের সাফল্যের জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করেছিল যে তিনি ও তাঁর সরকার একদলীয় ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। সমালোচকেরা রাজনৈতিক সহিংসতার বাড়বাড়ন্ত, ভোটারদের ভয় দেখানো এবং গণমাধ্যম ও বিরোধী মতের ব্যক্তিত্বদের হয়রানির ক্রমবর্ধমান ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মোবাশ্বার হাসান বলেন, ‘ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি ব্যাপক রক্তপাত ঘটিয়ছেন।’’

শেষ কথা

তবে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপের বিষয়ে ভিন্নমতও আছে। তা হলো ভারত কখনোই শেখ হাসিনাকে অন্তত ইউনুস সরকারের কাছে তাদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু শেখ হাসিনাকে তুলে দেবে না। এ বিষয়টি মাথায় রেখে ইউনুস সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দ্বারস্থ হতে তার কূটনৈতিক তৎরতা রাখবেন ভারত দমিয়ে রাখতে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতকে তার আদর্শিক নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করতে। যেনো বিশ্ববাসীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বোঝানো যায় ‘নীতি নৈতিককতার ধার ধারে না, তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন ও এর জন্য আত্মত্যাগকে মূল্যই দেয় না। বরং ভারত একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে প্রহরা দিয়ে রাখতে পারে-এই মেসেজও দিতে চায় ইউনুস সরকার।

শেয়ার করুন