দুর্নীতি দমন কমিশন ভবন
আগস্ট ২০১৪ থেকে ডিসেম্বর ২০২৫ অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার দেশের প্রধানতম সমস্যা অবাধ দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের সমালোচকদের কথা নাই বা বলি। নিচের দুটি উদ্ধৃতি থেকেই আঁচ করা যাবে বাংলাদেশের দুর্নীতির বর্তমান ভয়াবহ চিত্র।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বলছে, গণঅভ্যুত্থানের পর প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়েছে বিজয়ী পক্ষ। আর দুদক চেয়ারম্যান আব্দুল মোমেনের ভাষ্য, দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করতে দেশে গড়ে উঠেছে গডফাদার চক্র। কিছুদিন আগে জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেছিলেন, রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা চায় না বাংলাদেশ দুর্নীতি মুক্ত হোক। সরকার অনভিজ্ঞতার কারণে এবং নিজেদের একমাত্র কৌশল হিসাবে পূর্ববর্তী সরকার বিশেষত শেখ হাসিনাকে ঘায়েল করার চেষ্টায় সময় নষ্ট করায় শীর্ষস্থানীয় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। সরকারের দুর্বলতার সুযোগে কিছু সরকার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বিপুল বিনিময়ে শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের দেশ থেকে পালানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
অনেকের ধারণা সরকার ঘনিষ্ঠ কিছু সুবিধাবাদী বর্তমান সময়ে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে। এদের অশুভ প্রভাবে সরকারের আন্তরিকতা সত্ত্বেও দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত কোনো খাতেই কোনো কার্যকরি সংস্কার হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে। শিল্প, বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, স্থানীয় সরকার-যাতায়াত সব ক্ষেত্রে মহাদুর্নীতির কারণে অর্থনীতিতে মহাসংকট দেখা দিয়েছে। অনেকে পূর্ববর্তী সরকারকে দুর্নীতি, অর্থলোপাট, বিদেশে পাচারজনিত অভিযোগে অভিযুক্ত করে। প্রশ্ন হলো সরকার কেন যথেষ্ট সময় হাতে পেয়েও একটি বড় ধরনের দুর্নীতি প্রমাণ করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনতে পারলো না?
বেশি কিছু নিয়ে আলাপ করবো না। জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতির প্রসঙ্গে আলোচনা করি। সরকার গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করলো ২০১০-২০২৪ জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে ব্যায়িত বিপুল অর্থের অন্তত ৩০ শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে। সুপারিশ ছিল প্রকল্প ভিত্তিক অনুসন্ধান করে দুর্নীতি চিহ্নিত করা। কেন করা হলো না? দুর্নীতি দমন সংস্থা কেন জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে সক্রিয় সিন্ডিকেটগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কোনো উদ্যোগ নিলো না।
একটি বায়বীয় অভিযোগ ছিল রাশিয়া সরকারের আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তায় বাস্তবায়নরত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে শেখ হাসিনা পরিবার বিপুল দুর্নীতি করেছে। কি হলো সেই অভিযোগের? কেন প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে প্রকল্প সমাপ্তি বিলম্বিত হচ্ছে? অস্বীকার করার উপায় নেই জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ আইনের অধীনে প্রয়োজনের বহুগুণ বেশি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করে সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট দুর্নীতি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সরকারি সংস্থা পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বহন করতে ত্রিঙ্কুশ অবস্থা, সরকার কেন সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলো না? দেখলাম জ্বালানি উপদেষ্টা একটি সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ফসিল ফুয়েল থেকে নবায়ণযোগ্য জ্বালানি রূপান্তর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কেন সেই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তী সরকার কিন্তু জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতের সরকারি সংস্থাগুলোর আমলা নিয়ন্ত্রিত প্রশাসনিক অবকাঠামোগুলোতে কোনো পরিবর্তন আনেনি। কারিগরি কর্মকান্ডের নিয়ন্ত্রণে আমলাদের দায়িত্ব দেওয়ায় সরকারি সংস্থাগুলো দুর্নীতি আর অপশাসনের অভয় অরণ্যে পরিণত হয়েছে। সরকার আন্তরিক হলে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সংস্থাগুলোকে কার্যকর করতে পারতো। কেন করলো না সেটি অনুমেয়। সরকার গতানুগতিকভাবে আমলাদের ওপর নির্ভশীল থেকেছে। সরকার নিজেদের জ্বালানি আহরণ এবং উন্নয়নে প্রকৃতপক্ষে ব্যর্থ হয়েছে।
আলোচনা করলাম একটি খাত নিয়ে। দেশের সব খাতেই সমস্যা। কোথাও কোনো সংস্কার বা পরিবর্তন হয়নি। দুর্নীতি দেশ-সমাজকে অক্টোপাসের মতো বেঁধে ফেলেছে। আসন্ন নির্বাচনে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ অশুভ প্রভাব বিস্তার করবে সন্দেহ নেই। নতুন সরকারকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকা দুর্নীতি উচ্ছেদে মহা সংকটে পড়তে হবে।