চার দশক বা তারও বেশি সময়ের পুঞ্জীভূত ভ্রান্ত পরিকল্পনা, কুশাসন আর সীমাহীন দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর এখন দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। মাটির নিচে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ (কয়লা, গ্যাস), প্রকৃতিতে সূর্যের আলো, বাতাস এবং অন্যান্য অপরিচালিত জ্বালানিসম্পদ থাকা সত্ত্বেও মূলত জ্বালানি সংকটের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে মহাসংকট। ২৭ হাজার মেগাওয়াটের অধিক গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও মূলত জ্বালানি সংকটের কারণে ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। বিপুল দেনার দায়ে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে বিপিডিবি, পেট্রোবাংলা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবারের গ্রীষ্মে অসহনীয় জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটের। ভুল কৌশল এবং অনেকে বলবেন দুর্নীতিপ্রবণ মানসিকতার কারণে নিজেদের জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ খাত ৫০ শতাংশ আমদানি নির্ভর হয়ে পড়েছে। অথচ জ্বালানি আমদানি করার মতো প্রয়োজনীয় সক্ষমতা নেই বাংলাদেশের। কয়েকজন আমলা (ডক্টর তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ডক্টর আহমেদ কায়কাউস) ভুল পরামর্শ দিয়ে জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতকে আমলানির্ভর করে পেশাদারিত্ব ধ্বংস করেছে। দ্রুত জ্বালানি বিদ্যুৎ সরবরাহ বিশেষ আইন, ২০১০ পঙ্গু করেছে জ্বালানি বিদ্যুৎ খাত। বর্তমান অবস্থান থেকে উদ্ধার পেতে শুধু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কেন পরবর্তী সরকারগুলোকেও বেগ পেতে হবে।
অথচ ১৯৭০, ১৯৮০ দশকের সিংহভাগ জুড়ে বিপুল স্বভাবনাময় ছিল জ্বালানি খাত। অনুসন্ধানে ৩:১ গ্যাসসম্পদ আবিষ্কার হতে থাকায় দেশব্যাপী ব্যাপক হারে স্থানীয় সম্পদভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সুলভ গ্যাস, বিদ্যুৎ ব্যবহার করে শিল্পায়ন হতে থাকে। বৃহত্তর ঢাকা, বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় বিস্তৃত হয় তিতাস গ্যাস। সৃষ্টি হয় দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস লিমিটেড নামের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। সিলেট অঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করে জালালাবাদ গ্যাস সিস্টেমস লিমিটেড। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখে কখনো পেশাদারি ভিত্তিতে বিকশিত হয়নি পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানি সেক্টর ব্যবস্থাপনা। দক্ষ-যোগ্য কারিগরি জনবল ১৯৮০ দশকের মধ্যভাগ থেকেই সেক্টর ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে থাকে। সাইপেম দুর্নীতি, সি-মিটার কেলেঙ্কারি জ্বালানি সেক্টরকে দুর্নীতিতে কলঙ্কিত করে।
বিপুল সম্ভাবনার জ্বালানি সেক্টরে আমলারা নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়। প্রাথমিকদূষণ শুরু হয় সেনাশাসক জেনারেল এরশাদের সময় থেকেই। ১৯৮৭-৮৮ সিলেট অঞ্চলে তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। এ সময়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সিমিটার নামের একটি অদক্ষ কোম্পানিকে এনে সিলেট অঞ্চলে গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাবনার ভ্রূণ হত্যা করা হয়। অনেকের ধারণা এই দুর্নীতি জেনারেল এরশাদ, মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এবং বেক্সিমকো প্রধান সালমান এফ রহমানের সম্পৃক্ততা থাকায় সিমিটার দুর্নীতির কুশীলবরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। একইভাবে বিএনপির শাসন আমলে সংঘটিত সাইপেম দুর্নীতির নায়কদের সঠিক বিচার হয়নি। দুর্নীতি অপশাসন দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। সম্ভাবনাময় জ্বালানি সেক্টরে ধস নামতে থাকে। তবুও অক্সিডেন্টাল, ইউনোকোল হয়ে শেভরন আবির্ভূত হয়ে সুরমা বেসিন অঞ্চলে বিপুল গ্যাসসম্পদ আবিষ্কার করে। এ পর্যায়ে অনুসন্ধানকালে মৌলভীবাজারের মাগুরছড়ায় বিস্ফোরণ ঘটে। অক্সিডেন্টালের কাজে সুস্পষ্ট ব্যর্থতার কারণে তাদের চুক্তি বাতিলের সুযোগ থাকলেও একজন প্রভাবশালী আমলার তৎপরতায় সরকার সেই কাজটি করে নি। ১৯৯৮ -৯৯ বিবিয়ানায় বিশাল গ্যাসসম্পদ আবিষ্কার করে শেভরন। প্রস্তাব দেয় গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদিত গ্যাসের একটি অংশ ভারতে রফতানি করার। দেশব্যাপী আন্দোলনের কারণে সে উদ্যোগ সফল হয়নি। গ্যাস রফতানির সিদ্ধান্ত না হলেও দেশে কিন্তু গ্যাসের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ পর্যায়ে বিদেশি কোম্পানিগুলো দেশে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, সাগরে বিপুল গ্যাসসম্পদ পাওয়ার স্বভাবনা থাকলেও দীর্ঘসময়ে একমাত্র সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র ছাড়া কোনো গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি। স্থলভাগে সম্ভাবনাময় ব্লক ৯ অনুসন্ধানে বিশ্বের সেরা কোম্পানিগুলো সাড়া দিলেও অনেকের মতে, দুর্নীতি করে তাল্লো নামের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র কোম্পানিকে কাজ দেওয়ায় বড় তেল কোম্পানিগুলো আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
১৯৯০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভোলা দ্বীপে গ্যাস আবিষ্কৃত হয়। ১৯৯০ দশকের শেষ দিকে মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল ডজওচ নামক প্রকল্পের আওতায় ভোলার গ্যাস পাইপলাইন দিয়ে বরিশাল হয়ে খুলনায় নেয়া এবং ভোলা, বরিশাল, খুলনায় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দিলেও সরকার সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। সেই থেকে ২০২৫ পর্যন্ত ভোলায় বিপুল গ্যাস অব্যাবহৃত পড়ে রয়েছে।
১৯৯৬-২০০১ ছিল গ্যাস বিদ্যুৎ সেক্টর উন্নয়নের সেরা সময়। এই সময় বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্র, বিয়ানীবাজার, সালাদা, মেঘনা গ্যাসক্ষেত্র জাতীয় গ্যাস গ্রিডে সংযুক্ত হয়, গ্যাস সঞ্চালন গ্রিড যমুনা পেরিয়ে পশ্চিম অঞ্চলে পৌঁছে। বার্জ মাউন্টেড বিদ্যুৎকেন্দ্র, আইপিপি, এসআইপিপি আদলে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে ওঠে। কিন্তু ১৯৯৬-২০০১ অর্জনের অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় ২০০২-২০০৬ অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির কারণে। ইতিমধ্যে নানা কারণে পেট্রোবাংলা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে দুর্বল এবং অদক্ষ হয়ে পরে। পেশাদারি নেতৃত্বের বদলে আমলাদের আখের গোছানোর অভয় অরণ্যে পরিণত হয় গ্যাস খাত।
২০০০-২০০৬ সবচেয়ে বড় সুযোগ হারায় বাংলাদেশ মায়ানমার থেকে বাংলাদেশ হয়ে ভারতে গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে সাড়া না দিয়ে। ২০০৫ ফেব্রুয়ারি মাসে এই বিষয়ে মায়ানমার রাজধানী ইয়াঙ্গুনে স্বাক্ষরিত এমও ইউর ভিত্তিতে ব্যবস্থা গৃহীত হলে ২০০৯ থেকে ২ ডলার প্রতি ইউনিট ভিত্তিতে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বাংলাদেশ পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কে জানে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে হয়ত রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি হতো না।
গ্যাসের পাশাপাশি উত্তরাঞ্চলে বৃহত্তর রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চলে ফুলবাড়ী, দিঘিপাড়া, খালাশপীর অঞ্চলে স্বল্প গভীরতায় উন্নত মানের কয়লাসম্পদের সন্ধান মেলে। বড়পুকুরিয়া এবং জামালপুরসহ ৫টি আবিষ্কৃত কয়লা ক্ষেত্র থেকে বিপুল কয়লাসম্পদ আহরণের সুযোগ সৃষ্টি হলেও সকল সরকারের ব্যর্থতায় একমাত্র বড়পুকুরিয়া ছাড়া অন্য চার কয়লাক্ষেত্রের কয়লা মাটির নিচে পড়ে রয়েছে। জ্বালানি দুর্ভিক্ষের সময় মূল্যবান কয়লা সম্পদ মাটির নিচে পরে থাকা শুধু ভুল না রীতিমতো পাপ।
বর্তমান সংকটের জন্য ১৯৯০-২০২৪ সব সরকারের ভ্রান্ত পরিকল্পনা, দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতার কারণে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ মাটির নিচে রেখে আমদানিকে গুরুত্ব দেওয়া, সেক্টরের পেশাদারিত্বের বিকাশ রুদ্ধ করে আমলাদের প্রাধান্য দেওয়াকে দায়ী করবো। অন্তর্বর্তী সরকার শ্বেতপত্রে দুর্নীতি অব্যবস্থাপনার স্বরূপ উদ্ঘাটন করলেও দুর্নীতির মহানায়কদের আইনের আওতায় আনার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। মনে হয় না সরকারের অবশিষ্ট সময়ে সেটি সম্ভব হবে। ফলে এখনো বুঝে আসছে না, কীভাবে সামাল দেওয়া হবে ২০২৫-২০২৬ সাল গ্যাস বিদ্যুতের মহাসংকট।