১৩ মে ২০২৫, মঙ্গলবার, ০৮:৬:১২ পূর্বাহ্ন


বন্দর বিদেশী কোম্পানির কাছে তুলে দেওয়ার চেষ্টা
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৫-২০২৫
বন্দর বিদেশী কোম্পানির কাছে তুলে দেওয়ার চেষ্টা চট্টগ্রাম বন্দর


চট্টগ্রাম বন্দরের স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণকারী নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দুবাইভিত্তিক অপারেটর কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে সৌদি কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডকে (আরএসজেটিআই) দেওয়া পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালে (পিটিসি) অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গত ৩ মে শনিবার প্রথমবারের মতো এই টার্মিনালে আমদানি পণ্য নিয়ে ভিড়েছে বিদেশি জাহাজ। চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল এবং লালদিয়ার চরও বিদেশিদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।

এদিকে গত ২ মে শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম চট্টগ্রাম সফরে এসে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগের প্রক্রিয়া শেষ করতে চায় সরকার। এই বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসাবে গড়ে তোলার ইচ্ছা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে তিনটি কনটেইনার টার্মিনাল রয়েছে। এগুলো হলো-চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি), পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। এ ছাড়াও সাউথ কনটেইনার ইয়ার্ড (এসসিওয়াই), ওভার ফ্লো ইয়ার্ড, জেনারেল কার্গো বার্থসহ (জেসিবি) বেশকিছু ইয়ার্ড রয়েছে।

যেখানে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ছাড়াও বাল্ক কার্গোও খালাস হয়ে থাকে। সিসিটি ও এনসিটি সাইফ পাওয়ারটেক পরিচালনা করছে। পিসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সৌদির আরএসজেটিআইকে। বে-টার্মিনাল ও লালদিয়ার চর বিদেশি বিনিয়োগে চালু করার জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরও বিদেশি বিনিয়োগে হচ্ছে।

২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই একটি টার্মিনালেই ১ কোটি ১৮ লাখ ৬৩ হাজার টিইইউএস (২০ ফুট সমমানের) কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। এই টার্মিনালে বর্তমানে যে পরিমাণ ইক্যুইপমেন্ট আছে তা দিয়ে আগামী ১৫ বছর চালানো যাবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ এই টার্মিনালটি বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারই প্রক্রিয়া শুরু করে। সেই প্রক্রিয়াই বর্তমানে চলমান রয়েছে।

কিন্তু এর বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল, বন্দর শ্রমিক ফেডারেশন, জামায়াতে ইসলামী, এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্রতিবাদ করে। তারা এনসিটিসহ লাভজনক কোনো টার্মিনাল বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপিও পাঠায়।

বন্দর নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা 

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম শুক্রবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বন্দরকে সামনে রেখে বাংলাদেশকে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ হিসাবে গড়ে তুলতে চান প্রধান উপদেষ্টা।

এ জন্য বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে এর সক্ষমতাও বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বন্দর ঘিরে মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে। যেসব কোম্পানি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ৬০ থেকে থেকে ৯০টি বন্দর হ্যান্ডলিং করছে তাদের সঙ্গেই আলোচনা চলছে। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ কাজ শেষ করতে চায় সরকার।

প্রেস সচিব আরও বলেন, তরুণদের জন্য প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হলে শুধু দেশের ১৮ কোটি মানুষের জন্য নয়; পুরো রিজিওনের ৩০-৪০ কোটি লোক এর সুফল ভোগ করবে। চট্টগ্রামের লালদিয়া, বে টার্মিনাল, পতেঙ্গা টার্মিনাল, মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরসহ পুরো অঞ্চলটাই বন্দরের উপযোগী।

তথ্য দিয়ে তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দর ও আশপাশের টার্মিনালগুলোর সক্ষমতা ১ দশমিক ২৭ মিলিয়ন টিইইউএস (২০ ফুট দীর্ঘ) কনটেইনার। এ সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে এই সক্ষমতা ৭৮ লাখ ৬০ হাজার টিইইউএস-এ নিয়ে যাওয়া। অর্থাৎ ছয় গুণ বাড়ানো। বাংলাদেশকে ইকোনমিক হাব, ম্যানুফ্যাকচারিং হাব করতে হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধিই হচ্ছে এক নম্বর পূর্বশর্ত।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও এরসঙ্গে জড়িত। তাই বন্দর নিয়ে আমরা যাই করি না কেন, তা যেন ভেবেচিন্তে দেশের স্বার্থে করি। সরকারকে এটা মাথায় রাখতে হবে।

বাম জোটের নিন্দা 

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং বন্দর বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার নিন্দা জানিয়েছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা। তারা বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এর সাথে শুধু বাণিজ্যিক লেনদেন নয়, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি যুক্ত। বন্দরের তত্ত্বাবধানে টার্মিনালটি ভালোভাবে পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও বিদেশী কোম্পানির কাছে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নেয়া হলো সেটা স্পষ্ট নয়। এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে নেতৃবৃন্দ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। 

বাম গণতান্ত্রিক জোটের সভা ৫ মে সোমবার বাসদ (মার্কসবাদী) কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এসব প্রসঙ্গ উঠে আসে। বামজোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদের সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল- বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, 

বাসদ (মার্কসবাদী) -এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক মাসুদ রানা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আব্দুল আলী, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, সিপিবির সহ সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ।

সভায় হেফাজতে ইসলামসহ উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর নারীদের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। সভার এক প্রস্তাবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে হেফাজত-জামাতসহ উগ্র ধর্মান্ধ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠির নারী বিদ্ধেষী উস্কানিমূলক বক্তব্য এবং সংস্কার কমিশনের সদস্যদের “বেশ্যা” ইত্যাদি অশ্লীল গালিগাজের ঘটনায় গভীর উদ্বেগপ্রকাশ করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়।

এছাড়া সভায় বলা হয়, যুদ্ধ আক্রান্ত আরাকানে মানবিক করিডর প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত একটি স্পর্শকাতর বিষয়। এ ধরনের সিদ্ধান্তের সাথে দেশের নিরাপত্তা, সামরিক ঝুঁকি, সার্বভৌমত্ব, এ অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর এ বিষয়ে অবস্থান- ইত্যাদি অনেকগুলো বিষয় যুক্ত এবং প্রত্যেকটিই গভীর পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা ও সরকারের পক্ষ হতে পুরো বিষয়টি স্পষ্ট তুলে ধরে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে।

সভায় চট্রগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং বন্দর বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার নিন্দা জানানো হয়। সভায় বলা হয়, “চট্টগ্রাম বন্দর গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর। এর সাথে শুধু বাণিজ্যিক লেনদেন নয়, দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নটি যুক্ত। বন্দরের তত্ত্বাবধানে টার্মিনালটি ভালোভাবে পরিচালিত হওয়া সত্ত্বেও বিদেশী কোম্পানির কাছে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নেয়া হলো সেটা স্পষ্ট নয়। এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে নেতৃবৃন্দ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। 

সভায় সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য লাকী আক্তারের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতারকৃত শ্রমিক নেতাদের মুক্তির দাবি জানানো হয়।

কর্মসূচি :

আগামী ৭ মে ‘২৫ নারী বিদ্বেষী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিকাল ৪ টায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। 

আগামী ১৫ মে’২৫ মানবিক করিডোর প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্তের শর্তসমূহের শ্বেতপত্র প্রকাশ ও নিউমুরিং বন্দর বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে সারা দেশব্যাপী মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

শেয়ার করুন