মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের ফ্যাাসিবাদী যুগের অবসান। দেশ ছেড়ে পালাল টানা সতের বছর ধরে প্রচন্ড প্রতাপে শাসন করে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পুরো দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যেমন হতাশাগ্রস্ত, তেমনি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। দলটির নেতাকর্মীদের জন্য এমন মারাত্মক আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে অভয় দিলেন সতের বছর ধরে লাখ লাখ নিপীড়িত নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক দল বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। টানা সতের বছর মূলত বিএনপি নামের দলটি-কে তিনি দীর্ঘসময় ধরে বিদেশের মাটিতেই বসে পরিচালনা করেছেন। আর বিএনপির এই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পর ৭ আগস্ট ভার্চ্যুয়ালি কিছু বক্তব্য দেন। তিনি ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ আরেকটি বিজয় দেখেছে বলে জানান। তিনি বলেন, আমি বিএনপিসহ গণতন্ত্রকামী প্রতিটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে দলমত নির্বিশেষে অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশের বীর জনগণকে। এর পাশাপাশি তিনি বলেন, ধর্ম-বর্ণ পরিচয়ের কারণে কেউ যাতে নিরাপত্তাহীনতায় না থাকে, সবার আগে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, নৈরাজ্যের পতনে নৈরাজ্য কোনো সমাধান হতে পারে না। সমাবেশে তারেক রহমান প্রতিশোধ এবং প্রতিহিংসা পরায়ণ না হতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় নেতাকর্মীদের ঢাল হিসেবে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। একিই সঙ্গে তিনি ওইদিন দেয়া তার বক্তব্যে বলেন, বর্তমানে একটি চক্র পুলিশের মনোবল ভেঙে দেয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তারেক রহমান বলেন, ‘কেউ বিএনপির নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করতে চাইলে তাকে ধরে আইনের হাতে তুলে দিন। কোন পুলিশের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথ নিয়মে অভিযোগ করুন।’
জয়ের প্রশংসা
সাবেক প্রধনমন্ত্রীর পতনের পর পর বিএনপির এই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এমন বক্তব্য সদ্যপদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র ও সাবেক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ওই সময়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কিছু কথা বলেছেন। জয় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রশংসা করেন তার সাম্প্রতিক বক্তব্যকে (বিএনপির সমাবেশে ভার্চুয়ালি দেওয়া) উৎসাহব্যঞ্জক বলে অভিহিত করে বলেছেন, ‘তিনি (খালোদা জিয়া) অতীত না টানার কথা বলেছেন। এটা শুনে আমি খুশি হয়েছি। আসুন আমরা অতীত ভুলে যাই। প্রতিশোধের রাজনীতি পরিহার করি।’ জয় বলেছেন, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে তিনি বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে চান। পঞ্চমত. তিনি বলেছেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, রাজনীতি ও সমঝোতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা তর্ক করতে পারি। আমরা কোনো বিষয়ে অসম্মত হওয়ার বিষয়ে একমত হতে পারি। আমরা সব সময় সমঝোতার পথ খুঁজতে পারি।’
ঘটনা দুই.... প্রতিবেশীদের অসুবিধা চান না তারেক
দীর্ঘ ১৭ বছর পর গত মঙ্গলবার দেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান। দেশে ফিরে জোবাইদা রাজধানীর ধানমন্ডিতে তার বাবার বাসা ‘মাহবুব ভবনে’ উঠবেন বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে বাসার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন থেকে শুরু করে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া-ও হয়। তার নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে জানিয়ে এ বাসায় পুলিশ পাহারা, আর্চওয়ে বসানোর জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শকের কাছে চিঠি দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার। সেমতে চলছে আয়োজন। তবে নিরাপত্তার নামে প্রতিবেশীদের বিরক্ত না করার নির্দেশনা দিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তারেকের এমন বদান্যতা ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে।
ঘটনা তিন....বিমানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন খালেদা জিয়া
বিমানের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন খালেদা জিয়া- এমন শিরোনামে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বিস্তারিত তথ্যে জানা গেলো যে, অসুস্থতার কথা বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের পক্ষ থেকে তার যাত্রাপথ সহজ করতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা ফিরিয়ে দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। যাতে অন্য যাত্রীদের কোনও ভোগান্তি না হয়। জানা গেছে বেগম জিয়া বিমানের একটি নিয়মিত ফ্লাইটে দেশে ফিরবেন। ৪ মে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টায় লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের ওই ফ্লাইটটি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ ও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে-তার স্বাস্থ্যগত অবস্থা বিবেচনায় ফ্লাইটের নির্ধারিত রুট পরিবর্তন করে লন্ডন-ঢাকা-সিলেট করার। তবে বেগম জিয়া এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তিনি স্পষ্ট করে জানান, তার জন্য বিমানের অন্য যাত্রীদের সামান্য কষ্টেও ফেলতে তিনি রাজি নন।
কিন্তু মাঠে বিপরীত চিহ্ন
প্রশ্ন হচ্ছে এত্তোসব বদান্যতায় বিএনপি’র নেতাকর্মীদের হুশ নেই। মাঠ পর্যায়ে চষে দেখা যায় দলটির একটি অংশ হেন অপকর্ম নেই যে করছে না। তৃণমূলে এর ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে। যেভাবে পারছে বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের পরিচয় দিয়ে একটি অংশ দেশজুড়ে পাল্লা দিয়ে লুটপাট দখল লুটপাটে ব্যস্ত। আবার পতিত ফ্যাসিবাদী দলসহ ভিন্ন মতে বিশ্বাসীদের কোথাও কোথাও, চাপে রেখে মামলা মোকাদ্দমায় ফাঁসিয়ে দেয়া হচ্ছে স্থানীয় আইন শৃংখলা বাহিনীর কতিপয় তথাকথিত ছাত্রদলের একসময়ে সমর্থক কর্মীদের পরিচয় দিয়ে। আর এমন কাজ সুচারুভাবে সম্পাদন করার কারণে রাজধানীসহ সারা দেশে বেশ কিছু থানায় আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা অসহায় সাধারণ সমর্থকদের থেকে বিপুল অর্থ বাগিয়ে নিচ্ছে। খোদ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকদিন পরপরই এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ক্যাম্প গঠন করে চাদাবাজ, দখলদারদের হটিয়ে দেয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। কঠোর পদক্ষেপ নিতে সেনাবাহিনীকে পদক্ষেপ নিতে আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানাচ্ছে। কেননা ওইসব এলাকায় ২০২৪ সালে ৫ আগস্টের সরকারের পতনের পর রাজধানীসহ সারা দেশে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের পরিচয় দিয়ে একটি অংশ চাদা না দিলে সব ধরনের উন্নয়ন কাজ বন্ধ করার হুমকি দিচ্ছে। আর এসব চাদাবাজ ও বিএনপি পরিচয় দিয়ে উঠতি মাস্তানদের জ্বালায় অতিষ্ঠ্য হয়ে রাজধানীসহ সারাদেশের জনগণ। এর পাশাপাশি চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ড-ও হুমকির মুখে পড়ছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ধারীদের স্থানীয় আইন শৃংখলায় নিয়োজিত প্রশাসন কিছুই করতে পারছে না। আর একারণে স্থানীয় গণ্যমান্য অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনীকে ক্যাম্প স্থাপনের আমন্ত্রণ জানিয়ে চলমান উন্নয়ন কর্মকান্ড চালিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করে যাচ্ছে। আর এতে রাজধানীসহ সারাদেশে এলাকায় এলাকায় বিএনপি’র প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে, নষ্ট হচ্ছে দলটির রাজনৈতিক ইমেজ।
কেনো নেতাকর্মীদের এমন আচরণ
বেড়েই চলেছে বিএনপি’র এক শ্রেণীর নেতাকর্মীদের বেপারোয়া আচরণ। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা এলাকায় চাদাবাজির দখলদারের আধিপত্য ও নেতৃত্বের প্রভাব ধরে রাখতে নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ছেন। সম্প্রতি গণমাধ্যমের খবরে দেখা যায় গত আট মাসে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যদের সংঘর্ষ এবং হামলায় ৭০ জন নিহত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেনো বিএনপি’র নেতাকর্মীরা এতো বেপারোয়া। একটি সূত্র জানায়, বিএনপি’র এক শ্রেণীর নেতাকর্মীরা মনে করে যা করার এখনই হাতিয়ে নিতে হবে। দল ক্ষমতায় বসে গেলে হয়ত কিছুই নেয়া বা করা যাবে না। তা-ই যা লুটপাট এখনই সেরে নেয়া ভালো-এমন মনোভাবাপন্ন একটি মহল। আরেকটি মহলের ধারণা, যতো কথা বলুক না কেনো বিএনপি’র হাই কমান্ড বিশেষ করে নির্বাচনের আগে সব দলের ব্যানারে করা সব অপকর্মকারীদের মাফ করে দেবে। কেননা এসব বেপারেয়ারাও মনে করে স্থানীয় বিএনপি’র নেতারা তাদের ছাড়া এলাকায় জয়লাভ অকল্পনীয়। তা-ই এখন অপকর্ম করতে গিয়ে হাইকমান্ড দ্বারা এখন যে ব্যবস্থাই নেয়া হোক না কেনো ঠিক সময়ে সব প্রত্যাহার হয়ে যাবে। তাই এরা নির্ভয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার চাাদাবাজি দখলে পাল্লা দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে।
শেষ কোথায়?
দলের শীর্ষ পর্যায়ে খোদ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজনৈতিক অঙ্গনে বদান্যতা দেখাচ্ছে। দলের কোনো নেতাকর্মীর এমনকি যারা বিএনপি করেন না বা পরিচয় দিয়ে অপকর্ম করছে তাদের আইন শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিতদের হাতে তুলে দেয়ার উদাত্ত আহবান জানাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে হাইকমান্ড নিজের হস্তক্ষেপে বিএনপি নামধানী ওইসব ব্যক্তিদের পুলিশে সোর্পদের ভূমিকা রাখছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। রাজধানীসহ সারাদেশের অনেক স্থানে বিএনপি নামধারী এসব নেতাকর্মীদের নানান ধরনের চাপ হস্তক্ষেপের কারণে স্থানীয়রা কথা কথায় ওইসব স্থানে সেনাবাহিনীর ওপরই আস্থা রাখছে। যা রাজনৈতিক দল হিসাবে বিএনপি’র জন্য অনেক নেতিবাচক। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহলের মতে, স্থানীয় অনেক বিএনপি নেতারা প্রকৃতপক্ষে এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখা বন্ধ করতে কেন্দ্রের নির্দেশ বা ব্যবস্থা ছাড়াই দৃঢ় রাজনৈদিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু মাঠ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে প্রায় এলাকায় বিএনপি’র শীর্ষ নেতারা গা বাচিয়ে চলে। আরেকটি অংশ গোপনে এলাকায় চাদাবাজির দখলদারের আধিপত্য ও নেতৃত্বের প্রভাব ধরে রাখতে নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে লিপ্তকারীদের পক্ষে স্থানীয় প্রশাননকে ভবিষ্যতে দেখে নেয়ার ভয় দেখিয়ে চাপে রাখে। তবে এমন গোপন তৎপরতায় লিপ্তদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এর পাশাপাশি স্থানীয় অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দলের হাই কমান্ড কার্যকর মনিটরিং ও ব্যবস্থা না নিলে জনমত যেকোনো মুর্হূতে ঘুরে যেতে পারে বলে কারো কারো অভিমত। সেক্ষেত্রে দলের শীর্ষ পর্যায়ে যতোই বদান্যতা দেখাক না কেনো দলের ভবিষ্যত বিপর্যয় কেউ ঠেকাতে পারবে না বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।