যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রাঙ্গণ ক্যাপিটল হিলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল আমেরিকান মুসলিমদের সর্ববৃহৎ বার্ষিক নাগরিক অ্যাডভোকেসি কর্মসূচি ১০ম ‘ন্যাশনাল মুসলিম অ্যাডভোকেসি ডে’। আয়োজক সংগঠন ইউএস কাউন্সিল অব মুসলিম অর্গানাইজেশনস জানায়, ২৭টি অঙ্গরাজ্য থেকে আগত ৭৫০ জনেরও বেশি মুসলিম প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন এ বছরের আয়োজনে। তারা কংগ্রেসের ২১০টিরও বেশি হাউস ও সিনেট অফিসে সাক্ষাৎ করেন এবং মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন করেন তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি : মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অলাভজনক সংস্থাগুলোর অধিকার রক্ষা, বৈষম্যমূলক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বাতিল এবং গাজা ও অন্যান্য দেশে মুসলিম জনগণের ওপর চলমান নিপীড়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর হস্তক্ষেপ। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হয়েছে- আমেরিকান মুসলিমরা এখন শুধু ভোটার হিসেবেই নয়, এক শক্তিশালী নীতিগত পক্ষ হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
২৮ ও ২৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই অ্যাডভোকেসি ডেতে মুসলিম প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের ২১০টিরও বেশি হাউস ও সিনেট অফিসে নাগরিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের জন্য আমেরিকান মুসলিমদের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠ সাক্ষাৎ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের প্রতিনিধিদল অনেকগুলো অতিরিক্ত ‘ড্রপ বাই’ ভিজিট করেন, যাতে কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ ও জোরালোভাবে তাদের দাবিগুলো তুলে ধরা যায়। এবারের মুসলিম অ্যাডভোকেসি ডে-তে আলোচনার মূল তিনটি ইস্যু ছিল: ১. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও অলাভজনক সংস্থাগুলোর অধিকার রক্ষা: কংগ্রেস সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় যেন তারা ম্যাকার্থি যুগের মতো তদন্ত ও দমনমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, যা বিশেষ করে মুসলিম, আরব, ফিলিস্তিনি, ইহুদি ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। ২. বৈষম্যমূলক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বিরোধিতা: প্রতিনিধিরা নো ব্যান অ্যাক্ট পাসের দাবি জানিয়ে বলেন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর নাগরিকদের ওপর পুনরায় চরমপন্থী ভিসা সীমাবদ্ধতা আরোপ গ্রহণযোগ্য নয়। ৩. বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর পদক্ষেপ: গাজা, সুদান, চীন (জিনজিয়াং), বার্মা (মিয়ানমার) ও ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর চলমান সহিংসতা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিক্রিয়া জানাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি আহ্বান জানান প্রতিনিধিদল।
ইউএস কাউন্সিল অব মুসলিম অর্গানাইজেশনসের সেক্রেটারি জেনারেল উসামা জামাল বলেন, এই বছরের মুসলিম অ্যাডভোকেসি ডে আমেরিকান মুসলিমদের নাগরিক সচেতনতা ও অঙ্গীকারের এক শক্তিশালী প্রতিফলন। মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা, বৈষম্যমূলক ট্রাভেল ব্যান প্রত্যাখ্যান ও গণহত্যার বিরুদ্ধে অবস্থান। এই প্রতিটি বিষয়ে আমাদের কণ্ঠ ছিল নীতিগতভাবে স্পষ্ট এবং দৃঢ়। তিনি আরো বলেন, ছাত্র আন্দোলনকারী এবং মিত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আমরা দৃঢ়ভাবে বলেছি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জবাবদিহিতা চাই।
জাতীয় মুসলিম অ্যাডভোকেসি ডে স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান ও কেয়ারের গভর্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর রবার্ট এস ম্যাকক বলেন, ক্যাপিটল হিলে শত শত মুসলিম প্রতিনিধির পদচারণা কেবল প্রতীকী নয়, বাস্তব পরিবর্তনের ইঙ্গিত। আজকের কংগ্রেস যেভাবে গণহত্যা ও দমনপীড়নের জন্য দায়ী বিদেশি সরকারগুলোকে অর্থায়ন করছে, সেখানে আমাদের উপস্থিতি একটি নৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে। আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি- আমরা যুদ্ধাপরাধে সহযোগী হব না, আমরা চুপ থাকব না যখন মানবিক সাহায্য ও মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এই অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে সোমবার সকালে ইউএস ক্যাপিটল ভিজিটর সেন্টারের অডিটোরিয়ামে একটি শক্তিশালী নীতি ও অ্যাডভোকেসি প্রশিক্ষণ সেশন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে শত শত অংশগ্রহণকারীকে কারিগরি দিক থেকে প্রস্তুত করা হয় নাগরিক অধিকার ও বৈদেশিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোর পক্ষে সোচ্চার হওয়ার জন্য। সপ্তাহজুড়ে প্রতিনিধিদল রেবুরন হাউস অফিস বিল্ডিংকে একটি অ্যাডভোকেসি হাব হিসেবে ব্যবহার করে। এটি একটি কার্যকর ও সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ তৈরি করে, যেখানে উপস্থিত প্রতিনিধিরা দ্রুত যোগাযোগ ও সহযোগিতার মাধ্যমে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
এই ১০ম মুসলিম অ্যাডভোকেসি ডে ছিল ইউএস কাউন্সিল অব মুসলিম অর্গানাইজেশনসের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক কংগ্রেসনাল অংশগ্রহণসমৃদ্ধ অনুষ্ঠান। এতে প্রমাণিত হয়েছে, আমেরিকান মুসলিম সম্প্রদায় কেবল নিজেদের অধিকার নিয়েই সচেতন নয়, বরং জাতীয় ও বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের পক্ষে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।
১০ম বার্ষিক মুসলিম অ্যাডভোকেসি ডে ছিল কেবল একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি নয়, বরং এটি ছিল আমেরিকান মুসলিমদের নাগরিক দায়িত্ববোধ, সামাজিক অঙ্গীকার এবং বৈশ্বিক ন্যায়বিচারের প্রতি দৃঢ় অবস্থানের একটি প্রতীকী প্রকাশ। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বৈষম্যহীন নীতিমালা এবং নিপীড়িত মুসলিম জনগণের প্রতি সংহতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধিদল কংগ্রেসের সামনে তুলে ধরেছেন এক নৈতিক ও মানবিক বার্তা- যে বার্তা বলে দেয়, আমেরিকান মুসলিমরা কেবল নিজেদের স্বার্থ নিয়েই চিন্তিত নয়, বরং তারা বিশ্বব্যাপী ন্যায়, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই ঐতিহাসিক অংশগ্রহণ ভবিষ্যতের জন্য একটি দিশানির্দেশ হয়ে থাকবে, যেখানে মুসলিম সম্প্রদায় আরো সংগঠিত, সচেতন ও সক্রিয়ভাবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখবে।