২০২৪ সনের ৫ আগস্ট ক্ষমতা পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া একাধিক পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, গত এক বছরে দেশের ব্যাংকিং খাত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছে। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গত বছরের আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারায় ছিল।’ গত ১০ আগস্ট রোববার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ৩৬৫ দিন’ শীর্ষক এক সংলাপে গভর্নর এ কথা বলেন।
সংলাপের আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমাদের প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ ছিল সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করা এবং আর্থিক খাত সংস্কার করা। এক বছরে সংস্কার সম্পূর্ণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু আমরা প্রতিটি ক্ষেত্রে তা শুরু করেছি।’
গভর্নর জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন যাতে ঋণ সুবিধা বজায় থাকে। তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের আশ্বস্ত করেছি, আমাদের কাছে পাওনা এক পয়সাও আমরা বাকি রাখবো না এবং সে অনুযায়ী পরিশোধ করেছি। আমাদের অবস্থা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো হয়নি।’ তার মতে, ঋণ পরিশোধে সবচেয়ে বড় সহায়তা এসেছে গত এক বছরে প্রবাসী আয় এবং রফতানি আয় থেকে। ড. মনসুর বলেন, বাংলাদেশ কখনো বৈদেশিক অর্থ পরিশোধে খেলাপি হয়নি এবং ভবিষ্যতেও হবে না।
তিনি বলেন, ‘রেমিট্যান্স অসাধারণ সহায়তা দিয়েছে, রফতানি খাত ভালো করেছে এবং প্রতিটি ব্যাংককে দায়বদ্ধতা পূরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, এটি নিয়ন্ত্রণ করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছরের ১৪ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের একটি ডলারও বিক্রি করেনি, বরং চাপ থাকা সত্ত্বেও ১২২ টাকায় ডলার কিনেছে, বিনিময় হার সমন্বয় করেনি।
মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে এবং এটি ভবিষ্যতে ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশা করেন তিনি। ব্যাংক কমিশন কেন গঠন করা হয়নি এ প্রসঙ্গে মনসুর বলেন, ‘কমিশন করলে সিদ্ধান্ত নিতে ৬ থেকে ৯ মাস সময় লাগত। তাই আমরা ব্যাংক খাত সংস্কার, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম এবং বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে তিনটি টাস্কফোর্স গঠন করেছি।’
গভর্নর বলেন, বৃহৎ পরিসরে আইনি সংস্কার চলছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংস্কার (যাতে সম্পদ পুনরুদ্ধারের ধারা যুক্ত করা হচ্ছে) এবং বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জবাবদিহি ও স্বায়ত্তশাসন বাড়ানো।
এছাড়া দীর্ঘদিনের ঋণখেলাপি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স আইন ও ঋণ আদালত আইন সংশোধন করা হবে। অনিয়মের কারণে কোনো ব্যাংকের তারল্য সংকট দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক যেন সেটি অধিগ্রহণ করতে পারে, এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রেজুলেশন অর্ডিন্যান্সেও সংশোধন আনার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি। সবাইকে সতর্ক করে গভর্নর বলেন, ‘আর কোনো ছাড় নয়। কোনো ব্যাংক যদি সঠিকভাবে চলতে না পারে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা নিজের হাতে নেবে।’ সব ব্যাংক পর্যবেক্ষণের জন্য ‘৩৬০ ডিগ্রি মনিটরিং’ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি।
এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্যাশলেস ব্যবস্থায় রূপান্তরের ওপর জোর দেন গভর্নর । এজন্য কিউআর কোড ব্যবহারে উৎসাহ, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের প্রসার, ক্ষুদ্রঋণ (ন্যানো লোন), স্কুল পর্যায়ে ব্যাংকিং শিক্ষা, শিক্ষার্থীদের জন্য ২০০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, আবাসন খাতে সংস্কার, রাজস্ব বিভাগ পুনর্গঠন এবং স্মার্টফোনের দাম কমিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিং বিস্তারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।