২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ৬:৫৭:৪৮ অপরাহ্ন


দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে জ্বালানি সংকট
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৮-২০২২
দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাবে জ্বালানি সংকট


বাংলাদেশে চলছে দুঃসহ জ্বালানি- বিদ্যুৎ সংকট। বৃষ্টিবিহীন শরতের তীব্র দাবদাহের সময়ে চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে এসে দুই সপ্তাহে আমার মতো মানুষ হাঁফিয়ে উঠেছি। এমন আরো অনেকেই বলছেন। যারা এসেছেন ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আমাদেরও একই অবস্থা। কেউ কেউ ছুটি সংক্ষিপ্ত করে ফিরে গেছেন টিকতে না পেরে। তবে সত্তর ছোঁয়া জীবনে আমি এখনো ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজে ডুবে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।  সাধারণত আমি দ্রুত পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত। 

কিন্তু সেই আমি আমার দীর্ঘ কর্মময় জীবনে এই প্রথম নিজ দেশে এসে ভীষণ কষ্ট লাগছে। ১৯৭৭-২০০৫ বাংলাদেশ জ্বালানি সেক্টরের মাঠকর্মী ছিলাম। কাজ করেছি অনেক জাদরেল অগ্রজ, মেধাবী সহকর্মীর সঙ্গে। দেশব্যাপী প্রাকৃতিক গ্যাস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ কাজে কিছুটা অবদান রেখেছি। আমার শেষ পদবি ছিল পরিচালক (অপারেশন) জিটিসিএল। জাতীয় গ্যাস গ্রিড পরিচালন করতাম একটি ডায়নামিক অসীম সাহসী দলের নেতা হয়ে। বর্তমান সময়ে জ্বালানি সেক্টরের চলছে নিদারুণ সংকট। নিবিড়ভাবে দেখেশুনে মনে হচ্ছে, জ্বালানি সেক্টরে সুশাসনের অভাব আর অবাধ দুর্নীতি। প্রমাণিত। 

গ্যাসসম্পদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। কয়লা উত্তোলনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত শিকায় ঝুলছে। অগভীর উপকূলে জ্বালানি আমদানির বিশাল চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ অনেক বিলম্বে বুঝেছে। নিজেদের গ্যাস, কয়লা মাটির নিচে রেখে আমদানিকৃত জ্বালানির মরীচিকার পেছনে ছুঁতে এখন হা-পিত্তেশ করছে। জ্বালানির অভাবে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও ১৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না।  আর তাই সকল শ্রেণির গ্রাহক এখন তীব্র জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটে।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর সাড়ে ৩ বছর দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক কখনো বাংলাদেশে জন্ম নেবেনা। তিনি বিশ্বাস করতেন এবং সেই বিশ্বাসকে কাজে রূপান্তর করতে বাংলাদেশের কনস্টিটিউশনে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর জনগণের সার্বভৌমত্ব স্থাপন করেছিলেন। পেট্রোনাস, পের্টামিনার আদলে গড়ে তুলেছিলেন বিওজিসি (পেট্রোবাংলা) এবং বিএমডিসি (যা এখন বিলুপ্ত)। করপোরেশন দুটি প্রথম শ্রেণির মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু দু’জন প্রখ্যাত ভূ-তত্ত্ববিদকে সচিবের মর্যাদা দিয়ে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেন। 

১৯৭৩ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় প্রথম তেল সংকট সৃষ্টি হলো। দূরদর্শী জাতীয় নেতা স্বল্পসময়ে মডেল উৎপাদন বণ্টন চুক্তি তৈরি করে তার ভিত্তিতে ৬ কোম্পানিকে বঙ্গোপসাগরে ৮ ব্লকে তেল অনুসন্ধানের দায়িত্ব দিলেন। এমনকি মর্মান্তিক মৃত্যুর ৬ দিন আগে তাঁর জ্বালানি দ্যূতিয়ালির কারণে তিতাস, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, রশিদপুর, কৈলাশটিলা গ্যাসক্ষেত্র মাত্র ৪.৫ মূল্যে অধিগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছিল। মালয়েশিয়ার নেতা মাহাথির মোহাম্মদ তাঁর দেশের ভূমিপুত্রদের দিয়ে গড়ে তুলেছেন মালয়েশিয়ার প্রতীক পেট্রোনাস। বঙ্গবন্ধু না থাকায় তাঁর  দেশের সোনার ছেলেরা দেশ প্রবাসে ছড়িয়ে পড়লে, পেট্রোবাংলা এখন আনাড়িদের হাতে অস্তিত্বের লড়াই লড়ছে।

২০০০-২০২২ ন্যূনতম গ্যাস অনুসন্ধান হয়নি। কয়লার কথা না হয় বাদ দিলাম। প্রমাণিত গ্যাস মজুদ নিঃশ্বেস হবার পাশাপাশি বিকল্প আমদানিকৃত এলএনজি সরবরাহ শুরু করতেই ৮ বছর কালক্ষেপণ হয়। ২০১০ থেকে দুর্নীতির কারণে লক্ষ লক্ষ অবৈধ সংযোগের কারণে রাজস্ব হারায় পেট্রোবাংলার বিতরণ কোম্পানিগুলো। জলে স্থলে পরে থাকে অনাবিষ্কৃত বিপুল জ্বালানি আর খনিজসম্পদ। বিশাল সমুদ্রসীমা জয় হলেও সমুদ্রসম্পদ অধরা থেকে যায়। 

সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে সংস্থানের চেয়ে তিনগুণ অতিরিক্ত সচিব প্রমোশন দিয়ে ওদের সেক্টর করপোরেশনে দায়িত্ব দেয়ার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে পেট্রোবাংলার শীর্ষ তিন পদে আসীন আমলারা। ১৩ পেট্রোবাংলা কোম্পানির প্রতিটির পরিচালক পরিষদে আমলাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ। কোম্পানিগুলো হারিয়েছে স্বকীয়তা আর দক্ষতা। সুশাসনের অভাব আর অবাধ দুর্নীতির কারণে সৃষ্টি হয়েছে গভীর জ্বালানি সংকট। পরিত্রাণের একমাত্র পথ বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আমলামুক্ত পেশাদারি প্রশাসন, সর্বস্তরে জবাবদিহির পরিবেশ। জ্বালানি সেক্টরের সমস্যা আশু সমাধান এখন সময়ের দাবি। 

বাংলাদেশে এখনো অনেক জ্বালানি আর খনিজসম্পদ মাটির নিচে রয়ে গেছে। নিজেদের সম্পদ মাটির নিচে রেখে কোনোভাবে বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর হয়ে উন্নত দেশে পরিণত হতে পারবে না।


শেয়ার করুন