২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ০৫:১৭:৩৯ পূর্বাহ্ন


কথার কথকতা
মাইন উদ্দিন আহমেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১১-২০২২
কথার কথকতা মাইন উদ্দিন আহমেদ


নিউইয়র্ক আসার পর দেখলাম, এখানে জীবনযাপনের জন্য বিশাল ভূগোল লাগে! সেটা কি, নিশ্চয় জানতে চাইবেন। ঢাকার মতো ইচ্ছা করলেই ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের দোকান থেকে চা-সিগ্রেট খেয়ে আসতে পারবেন না। বাজার করতে বা নামাজ পড়তে বা খেলতে নতুবা ব্যায়াম করতে যেতে হবে অনেক দূরে। ডাক্তারের কাছে যাবেন? হয়তো দেখা গেলো তিনি পাঁচ মাইল দূরে। একটা গেঞ্জি বা শার্ট কিনবেন? ভালো দোকানটি পনেরো মাইল দূরে। আপনার প্রাইভেটকার সমস্যা করছে? দেখা গেলো, মিস্ত্রী বাইশ মাইল দূরে! আমার কাছে মনে হলো, এ যেন বড় লোকের বড় বড় জামা- এ রকম একটা ব্যাপার। তবে এই পরিস্থিতি বুঝতে এবং আয়ত্তে আনতে আমাকে সার্বিক সাহায্য করেছেন আমার বড় ভায়েরা রহমান সাহেব এবং ওনার পরিবারের সদস্যবৃন্দ। ওনাদের সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার বড় ভায়েরা দীর্ঘকাল নিউইয়র্কে বসবাস করার কারণে সবকিছু ওনার এতোই চেনাজানা যে, নিজস্ব গাড়ি চালাতে এখানে ওনার কোনো অ্যাপ লাগে না। জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব ক্ষেত্রেই তিনি বেশ অভিজ্ঞ। জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দীর্ঘসময় ধরে তিনি অর্জন করেছেন প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা। বস্তুত এখানে বিভিন্ন জায়গা চিনেছি আমি ওনার সুবাদে। এমনকি জ্যাকসন হাইটের মতো বাংলাভাষীদের প্রিয় জায়গাটিও তিনিই আমাকে চিনিয়েছেন আর চলাচলের জন্য বাস ও ট্রেনের মেজাজ-মর্জি বুঝতে আমাকে করতে হয়েছে অনেক সাধনা। বাস ও ট্রেনের লিংক বা ট্রেন বদলের সিস্টেম, দিশা ঠিক করার ম্যাপ- এসব নিয়ে আমাকে করতে হয়েছে অনেক গবেষণা। কিছু প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিমেন্টও করতে হয়েছে। বাস ও ট্রেন ব্যবহার করে কীভাবে জ্যাকসন হাইট যেতে হয়, এ-ট্রেনের শেষ দুই মাথার স্টেশন কোথায় ইত্যাদি জটিল বিষয়গুলো প্র্যাকটিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট করে শিখতে হয়েছে। ওই সময়ের মজার মজার কষ্টকর ঘটনা আছে, আরেক দিন লিখবো। আজ লিখবো, জ্যাকসন হাইট গেলে আমি প্রধানত কোথায় কোথায় বসি এবং কেন। ওখানে বাংলা মিডিয়াগুলো আবিষ্কারে অবশ্য কাজল সাহেব এবং কিরণ সাহেবের বড় ভূমিকা রয়েছে। ক্রমশ আবিষ্কার করেছি একসময়ের ঢাকাস্থ সাংবাদিকতার উচ্চশির মানুষদের। পেয়ে গেলাম ‘ছবির কবি’ নিহার সিদ্দিকী এবং আরো অনেককে।

জ্যাকসন হাইট গেলে প্রধানত তিনটি জায়গায় আমার বসা হয়। সেগুলো হচ্ছে, গ্রাফিক্স ওয়ার্ল্ড, দেশ পত্রিকা এবং ড্রিম লাইটার অফিস। প্রথমটি হচ্ছে বাংলাভাষাভাষী মানুষদের সংগঠন ‘আমরা জ্যাকসন হাইটবাসী’র প্রধান সবার প্রিয় সাকিল ভাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কিরন সাহেবকে খুঁজতে গিয়ে এটি আবিষ্কার করে ফেলি এবং দেখি যে, সব মেধাবীর প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে এ স্থানটি।

অনেক আগে জ্যাকসন হাইটের ডাইভারসিটি প্লাজা ঘোরাঘুরি আর চা খাওয়া চলছিলো। কিরন সাহেব এবং আরো কয়েকজন কাছের লোক ছিলেন। একসময় এক ইয়াংম্যান উদিত হলেন, কিরন সাহেবের সাথে কুশলাদি বিনিময় করলেন। আমার সাথে পরিচয় পর্বও সম্পন্ন হলো। একসময় কিরন সাহেব বললেন- মাইন ভাই, এই ভদ্রলোক একজন সক্রিয় সাংবাদিক, ওনারা একটা নতুন পত্রিকা বের করতে যাচ্ছেন। আপনি যদি নিয়মিত লেখেন, তাহলে খুব ভালো হয়। ওনারা ভালো কিছু করার চেষ্টা করছেন। এনার নাম মিজানুর রহমান, ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক। পরে অবশ্য প্রকাশক মঞ্জু সাহেবের সাথেও পরিচয় হলো। সেই থেকে ‘কথার কথকতা’ শিরোনামের কলামটি লেখা চলছে। প্রায় নয় মাসের লেখা নিয়ে একই শিরোনামের একটা বইও ছাপা হয়ে গেলো। সময়-সুযোগ মতো এই পত্রিকার অফিসটিতেও বসা হয় মাঝে মাঝে। অবশ্য ওনারা আন্তরিকতার সাথেই বলেন, আমি যেন জ্যাকসন হাইট গেলেই ওখানে বসি। ওনাদের আন্তরিকতায় আমি সত্যিই মুগ্ধ।

কি বললেন? টাইম টিভির কথা বলছেন? সেখানে আমাকে দেখা যায়? জ্বি হ্যাঁ, ওখানে মাঝেমাঝে যাওয়া হয়, তবে অনুষ্ঠান শেষ হলেই চলে আসি। দীর্ঘ আড্ডার সুযোগ হয় না। প্রতি সপ্তায় একবার ‘নিউজ রিভিউ’ এবং মাঝে মাঝে ‘টেবল টক উইথ সাঈদ তারেক’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা হয় টাইম টিভিতে। ধন্যবাদ কর্তৃপক্ষকে।

জ্যাকসন হাইট গেলে আরেকটি জায়গায় লম্বা সময় বসা হয়। এই স্থানটি আমার সাথে সংযোজিত হয়েছে অনেক পরে। এ বছরের শুরুর দিকে বা বিগত বছরের শেষের দিকে ঘটনাটি ঘটে। আমার খুবই প্রিয় এক ব্রাদার-ইন-ল ‘মুন্না ভাইজান’ জ্যাকসন হাইটে এক উকিল সাহেবের কাছে যাবেন। ঘটনাচক্রে সেদিন আমরা পরস্পরকে পেয়ে গিয়েছিলাম। বললাম, চলেন আপনার সাথে আমিও যাই। ওখানে তিনি কথাবার্তা সারলেন। ওখানে বসেই আমরা চা খেলাম। চা খাওয়ালেন অন্যরা- ওই অফিসটি আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে উকিল সাহেব শেয়ার করেন। কথা বলে জানলাম, এটি একটি নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন, নাম হলো ‘ড্রিম লাইটার’। ইয়াংম্যানদের প্রতিষ্ঠান মনে হলো। ওরা খুব আন্তরিকতার সাথে বললো- আবার আসবেন, এলে আমরা খুশি হবো। কীভাবে যেন ওখানে আরো কয়েকবার যাওয়া হয়ে গেলো! আসলে এর মূল কারণ ছিলো একটা বিষয় যেটা আমাকে একরকম অবাকই করেছিলো। আমি জানলাম, ড্রিম লাইটার একটি সরকার অনুমোদিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এরা তাদের ব্যবসার লাভের টাকা দিয়ে বাংলাদেশে গরিব শিশুদের শিক্ষা এবং লালন-পালনের খরচ চালায়। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ছাত্র পাঁচ শতের অধিক এবং স্কুল পনেরোটি। এগুলো এরা চালায়! আমি তো অবাক, এরাতো বুড়ো মানুষ নয়, সব ইয়াংম্যান, এই কঠিন-হিংস্র পৃথিবীতে কি করে যুবসমাজ এরকম মানবিক হয় এবং মানবতার জন্য কাজ করে! আমার এই বিস্ময়ের ঘোর থাকতে থাকতে প্রতিষ্ঠানটির স্বপ্নদ্রষ্টা বললেন- স্যার, আপনি ড্রিম লাইটারের প্রধান উপদেষ্টা, সেই হিসেবে অফিসে বসানো হলো আপনার জন্য নতুন চেয়ার, আপনি বসবেন প্লিজ। তাদের এই মানবিক কাজের প্রশংসা করে আমি যেসব বক্তৃতা করেছি সেগুলো দেখলাম, তাদের ওয়েবসাইটে। বিষয়টি অনারারি কিন্তু বিস্ময়কর। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান লক্ষ্য স্থির করে রেখেছেন যে, ড্রিম লাইটারের এই মানবিক কর্মকা- একসময় ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বব্যাপী। প্রিয় পাঠকবৃন্দ, কথাগুলো আরো বিস্তারিত আমার মুখে শুনতে চান? যোগাযোগ করে চলে আসুন ‘ড্রিম লাইটার’ অফিসে, জ্যাকসন হাইটের নবান্ন রেস্টুরেন্ট বিল্ডিংয়ের দোতলায়। কথা হবে চায়ের টেবিলে, দুই বা ততোধিক মিলে। আসুন প্রার্থনা করি, সমগ্র বিশ্ব খুঁজে পাক সঠিক দিক, হয়ে উঠুক মানবিক।

শেয়ার করুন