২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৬:৪৪:৩৪ পূর্বাহ্ন


অশান্ত মিয়ানমার অশান্ত বাংলাদেশ সীমান্ত
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০৯-২০২২
অশান্ত মিয়ানমার অশান্ত বাংলাদেশ সীমান্ত মিয়ানমারের মর্টার শেল বাংলাদেশের সীমান্তে


মিয়ানমারের অভ্যন্তরের সমস্যা যত তীব্রতর হচ্ছে ততই যন্ত্রণা বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশে। সীমান্তবর্তী দেশে সমস্যা দেখা দিলে তার ছিটেফোটা এপাড়েও পড়ে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মিয়ানমার এখন অতিমাত্রায় পেইন দিচ্ছে বাংলাদেশকে। যতই বিষয়টা ভদ্রভাবে বলা হচ্ছে- কিন্তু তাতে গা-দিচ্ছে না মিয়ানমারের জান্তা সরকার। তাদের অভ্যন্তরের সমস্যার দরুন প্রায় ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। নিছক মানবতার দিক বিবেচনা করে ওই আশ্রয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ বিষয়টির কোনো সুরাহা আজও করতে পারেনি। বাংলাদেশ এ বিষয়গুলো নিয়ে ঘুরছে দ্বারে দ্বারে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি বরং তাদের ইচ্ছা এ ১২ লাখের অধিক (ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া) বাংলাদেশেই রেখে লালন পালন। এ ব্যাপারে বার বার প্রতিবেশী ভারত ও চীনেরও সহায়তা চাওয়া হচ্ছে। তারাও অজ্ঞাত কারণে নীরব। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বা রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে রাজি করাতে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেনা কেউই। 

এ সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলে বলে এখন হয়রান। এর সঙ্গে এখন আবার যুক্ত হয়েছে নতুন আরেক সমস্যা। আবারও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের অভ্যন্তরে তান্ডব চালাচ্ছে। এমন তান্ডবের জের ধরে বাংলাদেশে ঢল নেমেছিল। সেরকম তান্ডব আবারও করছে তারা। জানা গেছে এবার আরাকান আর্মির সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষ। যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশেও। বাংলাদেশের সীমান্তের ওই প্রান্তে এসব সংঘর্ষ  ও আরাকান আর্মিদের দমাতে যেসব মরণাস্ত্র আকাশ থেকে আক্রমণ করা হচ্ছে- তার ছিটে ফোটা এসে পড়ছে বাংলাদেশে। এপাড়ে পরছে এসে মর্টার শেল। যুদ্ধ বিমান, হেলিকাপ্টারও মাঝে মাঝে অতিক্রম করে ফেলছে বাংলাদেশ সীমান্ত। এগুলোর কড়া প্রতিবাদ করছে বাংলাদেশ। 

মিয়ানমারের থেকে তৃতীয় দফায় বাংলাদেশ সীমান্তে গোলা এসে পড়ার ঘটনায় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত উ অং কিয়াউ মোকে তলব করে আবারও কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার অনুবিভাগ ওই দেশের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবাদপত্র দেন।

রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে সাম্প্রতিক ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি এ বিষয়ে সতর্ক করা হয় মিয়ানমারকে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের স্বার্থে রাখাইনে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা প্রয়োজন বলে সেটির বিষয়েও নেপিদোকে ঢাকার তরফ থেকে তাগিদ দেওয়া হয়। এর আগে গত ২০ ও ২৮ আগস্টও মিয়ানমার থেকে মর্টারের গোলা বাংলাদেশ সীমানায় এসে পড়ে। সে কারণে ২১ ও ২৯ আগস্ট মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছিল- ঢাকা। এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘সীমান্তে গোলা পড়ায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছিল। তার কাছে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ভুলবশত গোলা বাংলাদেশের সীমানায় পড়েছে। এটি কোনো ইচ্ছাকৃত ঘটনা নয়।’ তবে ভবিষ্যতে মিয়ানমারকে আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগে আরও রোহিঙ্গা যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে বাংলাদেশ।’ 

এদিকে মিয়ানমারে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় রাখাইন রাজ্যে প্রায় দুই মাস ধরে অব্যাহত সংঘর্ষ চলছে, যার প্রভাব পড়ছে প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপরও। বিশেষ করে বান্দরবানের ঘুমধুম ও তমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। অন্যদিকে এসব রাজ্যের অনেক মানুষ পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। মিয়ানমার বাহিনীর গোলা-বারুদ সীমানায় পরায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তি অঞ্চল।  

আসলে এ সমস্যার মূলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও  আরাকান আর্মি। এক সময় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বোঝাপড়া থাকলেও এখন তারা মিয়ানমার আর্মির ওপর বিভিন্ন জায়গায় হামলা করছে, সেটার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। তবে বাংলাদেশের জন্য বড় দুশ্চিন্তা এ সমস্যার দরুন আবার না রোহিঙ্গার ঢল নামে বাংলাদেশ পানে। কারণ এভাবে সংঘর্ষ হলে জীবন বাচাতে ছুটবে মানুষ দিক-বিদিক। সে পর্যায়ে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তই তাদের গন্তব্য। সেই সাথে সেখানকার বিদ্রোহীরাও সীমান্ত টপকে ভেতরে চলে আসতে পারে। তবে ওই সীমান্ত খুবই দুর্গম। যেখানে টহল দেয়া চাট্টিখানি নয়। সে সুযোগটাই মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা নিয়ে থাকতে পারে। এ অবস্থায় বিজিবি সতর্ক বলে জানা গেছে। 

মিয়ানমারে হচ্ছে টা কী 

বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, আগস্ট মাসের শুরু থেকে সে দেশের রাখাইন, তানপট্টি ও হাকা রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর লড়াই চলছে। একদিকে যেমন রাখাইনে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে, অন্যদিকে গত মে মাস থেকে কায়াহ, কাইন ও চিন রাজ্যেও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই যুদ্ধে হেলিকপ্টার, যুদ্ধবিমানও ব্যবহার করছে সে দেশের সামরিক বাহিনী। মিয়ানমারের শীর্ষ পত্রিকা ইরাবতির খবর অনুযায়ী, গত ৪ সেপ্টেম্বর মংডুতে আরাকান আর্মির (এএ) হামলায় সীমান্ত রক্ষী পুলিশের অন্তত ১৯ জন নিহত হয়। তারা ওই স্টেশনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায়। এরপরই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যুদ্ধবিমান এবং হেলিকপ্টার নিয়ে বিমান হামলা শুরু করে। রাখাইন রাজ্যের একাধিক স্থানে এসব বিমান ও হেলিকপ্টার থেকে গোলাবারুদ এবং ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। গত আগস্ট মাস ধরে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর লড়াই চলছিল। একমাস ধরেই প্রতিদিন সীমান্তের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছে। যাতে তটস্থ বাংলাদেশের সীমান্তে থাকা জনবসতিও। 

এছাড়া বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানিয়ে আসছে গত বছর থেকে সে দেশের গণতন্ত্রকামীরাও আর্মির বিরুদ্ধে প্রচন্ড সংঘর্ষ প্রতিনিয়তই। সেখানে অরো জানা গেছে, ছাত্র-তরুণরা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সে সূত্র ধরে প্রায়শই চলে আসছে সেনাবাহিনীর ক্রাকডাউন ও নির্যাতন। এসব বিদ্রোহ দমনে তীব্র গোলাগুলি, মর্টার ছাড়াও বিমান ও ভারী কামানের গোলা ব্যবহার করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারা সেখানকার একাধিক গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে এবং গ্রামে গ্রামে অভিযান চালাচ্ছে। ফলে এসব এলাকা থেকে বহু মানুষ ভারতের মিজোরামে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বলে শোনা গেছে।

এ নিয়ে সম্প্রতি ঢাকায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “যে জায়গাগুলোতে এটা (গোলাগুলি) হচ্ছে, সেখানে রোহিঙ্গারা থাকেন না। রোহিঙ্গারা থাকেন ঠিক তার বিপরীত দিকে, ইস্টার্ন সাইডে। এটা হচ্ছে পশ্চিমে, আমাদের বর্ডার ঘেঁষে একেবারে। যে জায়গাটা এরই মধ্যে একেবারেই রোহিঙ্গাশূন্য হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর ধরে।” শূন্যরেখার অবস্থান করা রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলে আসতে পারেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “২০১৭ সালে আমাদের কাছে যে তথ্যগুলো ছিল না, এখন অবশ্যই কিছুটা হলেও আছে। সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, আমরা কমেন্ট করতে চাই না। আমরা এবার অন্ততপক্ষে কোনো ঢলের শঙ্কা করছি না বা আশাও করছি না।”

শেয়ার করুন