২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৮:২৬:২৩ অপরাহ্ন


ভোর সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে ব্লু মাউন্টেইন দেখে আবার হোটেলে ফিরে আসতে গভীর রাত হয়ে যায়
ভালোলাগার শহর সিডনি
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০৪-২০২২
ভালোলাগার শহর সিডনি


গতকাল খুব ধকল গেছে শরীরে।ভোর সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে ব্লু মাউন্টেইন দেখে আবার হোটেলে ফিরে আসতে গভীর রাত হয়ে যায়।তাই আজ দূরের কোন প্রোগ্রাম রাখিনি।গাইডকে আগেই বলে রেখেছিলাম আজ সিডনি শহরটা ঘুরে দেখবো।সিডনি শহরটা দুই ভাগে বিভক্ত-সিডনি মহানগরী এবং সাব আরবান সিডনি ।আমরা আজ দেখবো সিডনি মহানগরী।এটি সর্বাধুনিক স্হাপত্য এবং আধুনিক অবকাঠামোতে নির্মিত এক প্রাণচঞ্চল পর্যটক নগরী।

গাইড বলছিলো সিডনির গল্প।১৭৮৮-র জানুয়ারি, ১১টি জাহাজ ভরে ক্যাপ্টেন আর্থার ফিলিপের নেতৃত্বে ‘বটানি বে’তে এসে পৌঁছাল হাজারখানেক ‘সেটলার’। তাদের মধ্যে ৭৭৮ জন আবার ‘অপরাধী’। ব্রিটেন থেকে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৭৮৭-র ১৩ মে। নেহাতই সাদামাটা সেই যাত্রা শেষ পর্যন্ত বেশ বর্ণময় হয়ে উঠেছিল। ‘বটানি বে’তে নামার প্রায় দিন তিনেক পর এই ‘নৌ-যাত্রী’রা অপেক্ষাকৃত ভাল একটি জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যায় তাদের ‘গৃহস্থালী’। জায়গাটির নাম পোর্ট জ্যাকসন। সেখানেই ‘সিডনি’ নামের এক ছোট উপসাগরের পাড়েই গড়ে ওঠে নতুন ‘বসতি’, দিনটি ছিল ২৬ জানুয়ারি, ১৭৮৮। এই দিনটিই পরে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবস ‘অস্ট্রেলিয়া ডে’ হিসেবে পালিত হয়। সে বছরের ফেব্রুয়ারিতেই ফিলিপকে সিডনির গভর্নর ঘোষণা করা হয়। তখন এ দেশে বসবাস ছিল সভ্যতার আলো থেকে বহু দূরে থাকা বিক্ষিপ্ত কিছু আদিবাসী মানুষের। সিডনির উত্তরণের সেই শুরু।পৃথিবীর নানা জায়গার মানুষের ভিড়ে সিডনি আজ যথার্থই ‘কসমোপলিটন’। ‘সিডনিসাইডার’ ও ভ্রমণপিপাসুদের জন্য ‘সিটি অফ সিডনি’ সারা বছরই কিছু না কিছু উত্সবের আয়োজন করে থাকে।

গাড়ী এসে থামলো সিডনি হারবার ব্রীজের সামনে। পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিজগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে 'সিডনি হারবার ব্রিজ'। গিনেজ বিশ্বরেকর্ড অনুযায়ী বিশ্বের একক স্পানবিশিষ্ট সবচেয়ে প্রশস্ত সেতু হলো সিডনি হারবার ব্রিজ। গাইড জানালো প্রায় ১ হাজার ১৪৯ মিটার দীর্ঘ আর ১৩৪ মিটার উচ্চতার এ সেতুটি নির্মাণ করতে সে সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় দশ বছর। ৫২ হাজার ৮০০ টন ইস্পাত লাগে সেতুটি তৈরি করতে।৭০ লাখ স্ক্রু লাগানো হয়েছে এই ব্রীজে।আর সব স্ক্রু নাকি হাতেই লাগানো হয়েছে।সেতুটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৩২ সালের ১৯ মার্চ খুলে দেওয়া হয়।সেতুটি নির্মাণে সে সময় খরচ হয়েছিল প্রায় ৬২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড। সিডনির বাসিন্দারা আদর করে ডাকে “কোট হ্যাঙ্গার' ।কারণ দূর থেকে দেখলে সেতুটিকে কোটের হ্যাঙ্গারের মতই লাগে।এ সেতুটিকে যখন খুলে দেওয়া হয় তখন এটি প্রথমবারের মতো সিডনির বিখ্যাত পোতাশ্রয়ের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তের মধ্যে সংযোগ রচনা করে। চালু হওয়ার প্রথম দিকে প্রতিদিন সেতুটি অতিক্রম করত প্রায় ১১ হাজার যানবাহন। কিন্তু বর্তমানে সেতু ব্যবহারকারী যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬০ হাজারে। এখানে অনুষ্ঠিত হওয়া বিশ্ববিখ্যাত আতশবাজির খেলা হচ্ছে সিডনি হারবার ব্রিজের মূল বিশেষত্ব।ব্রীজে ৮ লাইনে গাড়ী চলে। দুটো ট্রেন লাইন,একটা সাইকেল ট্রাক, আর পায়ে হাঁটার ফুটপাথ রয়েছে।

প্রতি বছর ইংরেজি নববর্ষের সময় সেতু, নিকটবর্তী সিডনি অপেরা হাউস ও তত্সংলগ্ন পোতাশ্রয়ের দুই প্রান্তে অনুষ্ঠিত হওয়া আতশবাজির খেলা উপভোগ করতে সারাবিশ্ব থেকে এখানে ভিড় জমায় উত্সাহী পর্যটকরা ।গাইড জানায়,হারবার ব্রীজ থেকে পুরো শহরের সুন্দর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।পায়ে হেঁটে ব্রীজে উঠার ব্যবস্হা রয়েছে।সুর্যোদয় এবং সুর্যাস্তের সময় ছবি তোলার জন্য পর্যটকরা এসে ভীড় জমায়।আমাদের হাতে সময় ছিলোনা ব্রীজের উপরে উঠে দেখার ।গাইডের তাড়নায় গাড়ীতে এসে বসলাম।আমাদের পরবর্তী গন্তব্য বন্ডাই ব্রীজ।

এবার বন্ডাই বিচের গল্প।বন্ডাই আদিবাসীদের একটা শব্দ।এর অর্থ ঢেউয়ের আওয়াজ।গাইড জানায়,বন্ডি বিচ বা বন্ডাই বিচ সিডনির নামকরা সৈকতগুলোর মধ্যে একটি।গরমের সময় সূর্যস্হান করতে এখানে বিপুল পরিমান মানুষের সমাগম হয়।সাদা বালি,শান্ত ঢেউ,এবং ক্যাফে রেস্টুরেন্টের জন্য বনিডাই বীচ পর্যটকদের কাছে বিপুল জনপ্রিয় ।এই বিচে সারা বছরই ভীড় লেগে থাকে।প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে বন্ডাই বীচে অনুষ্ঠিত হয় অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় ঘুড়ি উড়ানো উত্সব ।অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও সারা পৃথিবী থেকে আসে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে শত শত প্রতিদ্বন্দ্বী। এই ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতায় থাকে পৃথিবীর নানা বর্ণের ও বৈশিষ্ট্যের ঘুড়ি (নামকরা কার্টুন চরিত্র, থাকছে নানা প্রজাতির প্রাণী, ফাইটার জেট, বাহারী রঙের ফুল, বাক্স এবং আরও অনেক জাতের ঘুড়ি।উতসব উপলক্ষ্যে বীচে বসে বিভিন্ন খাবারের দোকান, শিশুদের নানাবিধ আনন্দের কার্যক্রম , পাপেট শো এবং নানা ধরণের বিনোদনের ব্যবস্থা।

বিচের পাড়ে এসে গাড়ী থামলো।প্রায় ১ কিলোমিটার লম্বা সৈকতটি সাদা ঝকঝকে বালির চাদরের মতো। সৈকত থেকে ১০০ গজ দুরে গাড়ি পার্কিং, তারপর হোটেল মোটেলের সারি। নীল পানি আর সাদা বালুর সৈকতটাকে কেউ পছন্দ না করে পারবেনা। আকাশের সাথে পানির রঙ একেবারে মিশে আছে। সৈকতের শেষ মাথায় সুইমিংপুলসহ একটা রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে সমুদ্রের ঢেউ এসে বাড়ি খায়।বিচে রয়েছে পিকনিক করার সুব্যবস্হা।ইলেক্ট্রিক চুল্লিতে বার বি কিউ করার ব্যবস্হা রয়েছে ।আছে মিস্টি পানি এবং টয়লেটের ব্যবস্হা।বলা যায় সমুদ্রকে যতভাগে উপভোগ করা যায় সব আয়োজনই আছে এই বীচে ।

বন্ডাই বিচটা খুবই জমজমাট।প্রচুর লোকের ভীড়। দেশী বিদেশী পর্যটকে ঠাসা।বেশীরভাগই যুগল।বালির উপর অনেকেই জোড়া বেধে শুয়ে আছে।প্রায় সবার পরনেই সংক্ষিপ্ত পোষাক।কেউ চেয়ার পেতে সমুদ্রের পানি সামনে নিয়ে বসা।পানিতে লাইফ গার্ডের স্পীড বোট চক্কর দিচ্ছে।বিচের আছে নিরাপত্তা কর্মী।আছে বিচের সঙ্গী সী গালও।

গাইড আমাদের নিয়ে এলো সাগর পাড়ের একটা রেস্টুরেন্টে।জানালো অস্ট্রেলিয়ার বিফ স্টেক খুবই সুস্বাদু যা এখানেও পাওয়া যাবে।অনেকেই অর্ডার দিলো।হালাল হারামের প্রশ্ন বিধায় আমি ফ্রেন্চ ফ্রাই, এবং কোল্ড ড্রিঙ্কসের অর্ডার দিলাম।আমার পাশের একজনের অর্ডার মেতাবেক ওয়েটার বিফ স্টেক নিয়ে আসলো।বড়থালায় হাড়বিহীন প্রায় ৩০০ গ্রাম উজনের গরুর গোস্তের স্লাইস।নানা দাতের মসলা সহকারে ওয়েলডান কুক।খাওয়ার পর বিচে কিছুক্ষন ঘুরে ফিরে আবার পথচলা।

এবার গাড়ী এসে থামলো ডার্লিং হারবারে।জায়গাটা শহরের পশ্চিম প্রান্তে।সময় কাটানোর সুন্দর জায়গা।প্রচুর ওয়াটার ফ্রন্ট রেস্টুরেন্ট ।হাত বাড়ালেই সমুদ্র।হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো সিডনি এ্যাকুরিয়াম,মেরিটাইমএ্যাকুরিয়াম,আইম্যাক্স থিয়েটার ইত্যাদি।হারবার থেকে জাহাজে করে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো যায়।সমুদ্র ভ্রমনের পাশাপাশি জাহাজ থেকে অপেরা হাউজ,হারবার ব্রীজ, এবং আশেপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।

ঘুরতে ঘুরতে দিন ফুরিয়ে বিকেল।আজকের মত ডিউটি শেষ গাইডের।কাল আবার অন্য কোথাও।এবার ফিরে যেতে হবে হোটেলে।


শেয়ার করুন