১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৮:৩১:৪৮ পূর্বাহ্ন


হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন ষোলো বছর বয়সেই
ঝলকানি দিয়ে হারিয়ে গেলেন শীলা
আলমগীর কবির
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৪-২০২২
ঝলকানি দিয়ে হারিয়ে গেলেন শীলা শীলা আহমেদ


মাত্র একটা সিনেমায় অভিনয় করেছেন শীলা, তাতেই জিতে নিয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। নক্ষত্রের রাত, খোয়াব নগর বা আজ রবিবারে তার দুর্দান্ত অভিনয়ের কথা তো ভোলা সম্ভব নয়। অথচ তুখোড় এই অভিনেত্রী নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন মাত্র ষোলো বছর বয়সেই। 

নক্ষত্রের রাত নাটকে তার চরিত্রটার নাম ছিল পলিন। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর যে মেয়েটা বাবার সঙ্গে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ মা তাকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারবে না, ভালো জামাকাপড় কিনে দিতে পারবে না, অন্যদিকে বাবা তাকে নিয়ে যাবে আমেরিকায়- স্বপ্নের মতো একটা দেশ, সেখানে কেউ অসুখী থাকে না। যাওয়ার সময় মেয়েটা তার মাকে বললো ‘তোমার ভালোবাসার ক্ষমতা কম মা। আর কম বলেই তুমি আমার বাবাকে বেঁধে রাখতে পারোনি, আমাকেও পারলে না।’

মেয়েটাকে যে কি ভীষণ স্বার্থপর মনে হয়েছিল তখন! অথচ সেই মেয়েটাই কিছুদিন পর মায়ের কাছে চিঠি পাঠালো, একটা ছোট্ট বাক্য শুধু লেখা তাতে- :তুমি কেমন আছো মা?' আমরা পলিনের কাছে শুনতে পাই দূরদেশে বসে মাকে মিস করার গল্প, মায়ের জন্য কেঁদে কেঁদে বোতলের ভেতর চোখের পানি জমানোর গল্প। সেই মেয়েটা একদিন বাবাকে নিয়ে ফিরে এলো দেশে, মায়ের কাছে, মায়ের টানে। সেই নাটকে পলিন চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন শীলা আহমেদ, 'হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে' পরিচয়ের আড়ালে যিনি বিস্মৃত হয়েছেন, অথচ তার সামর্থ্য ছিল, তার প্রতিভা ছিল নিজের নামেই উদ্ভাসিত হবার! 

মাত্র একটা সিনেমায় অভিনয় করেছেন শীলা, বাবার পরিচালিত আগুনের পরশমণি। সেখানে আসাদুজ্জামান নূর, বিপাশা হায়াত, আবুল হায়াতদের মতো তুখোড় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছিলেন কিশোরী মেয়েটা, নিজের প্রতিভা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে জিতে নিয়েছিলেন শিশুশিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও। অথচ এরপরে আর কখনও সিনেমায় দেখা যায়নি শীলাকে। 

আটটা নাটকে অভিনয় করেছেন, সবগুলোই হুমায়ূন আহমেদের পরিচালিত। বাবা তাকে অভিনয়ে এনেছিলেন, ক্যামেরার সামনে শীলা ছিলেন দারুণ স্বতঃস্ফূর্ত। বাবার সঙ্গে শীলার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মতো, হুমায়ূন আহমেদ কিছু লিখলে সেটা দেখার ডাক পড়তো শীলার ওপর, রিভিউ দেয়ার কাজটা তিনিই করতেন। খোয়াবনগর নাটকের শুটিং দেখতে আসা চ্যালেঞ্জারকে হুমায়ূন আহমেদ আচমকাই অভিনেতা বানিয়ে দিলেন, শুটিং শেষ হবার পরে শীলার কাছেই হুমায়ূন জানতে চেয়েছিলেন, নতুন এই অভিনেতার অভিনয় কেমন মা? শীলা রায় দিয়েছিলেন, উনি নূর চাচার (আসাদুজ্জামান নূর) মতোই ভালো অভিনেতা। 

বহুব্রীহি নাটক দিয় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ের হাতেখড়ি। তবে শীলাকে আমাদের প্রজন্ম চিনেছে বোধহয় 'আজ রবিবার' নাটক দিয়ে। কঙ্কা চরিত্রে তার অসাধারণ অভিনয় তো ভুলে যাওয়ার মতো নয়। প্রধান চরিত্র না হয়েও পুরো নাটকটা একরকম তিনিই টেনে নিয়েছেন, তার মাধ্যমেই আমরা বাকি চরিত্রগুলোর সাথে পরিচিত হই ধীরে ধীরে। অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন ‘খোয়াব নগর’ নাটকেও, ‘ওইজা বোর্ড’নামের একটা নাটকে বিপাশা হায়াতের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন তিনি, সেটার কথাও স্মৃতিতে গেঁথে আছে এখনও। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে ছিলেন আফসানা মিমির বোনের চরিত্রে, খুব বেশি কিছু করার ছিল না সেই নাটকে। প্রিয় পদরেখা, হিমু আর নিমফুল নামের তিনটে নাটকও করেছেন এর আগে-পরে। 

‘আগুনের পরশমনি’ সিনেমায় যতবারই তিনি স্ক্রিনে এসেছেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা আর সিনেমার দমবন্ধ ভাবটা কেটে গিয়ে যেন এক পশলা শীতল বাতাস এসে হাজির হয়েছে তখন। অপলা নামের যে চরিত্রটায় শীলা অভিনয় করেছিলেন, তার উচ্ছলতা, তার প্রাণচাঞ্চল্য যেন অক্সিজেন হয়ে ছিল গোটা সিনেমায়। আসাদুজ্জামান নূর বা বিপাশা হায়াতের সঙ্গে তার সিকোয়েন্সগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই মেয়ের বয়স তখন এগারো-বারো বছর মাত্র! আগমনী সিনেমা দিয়েই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার তো শীলা শুধু শুধু জেতেননি! 

তবুও শীলার অভিনীত চরিত্রগুলোর মধ্যে নক্ষত্রের রাতের পলিনই আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের, লেখার শুরুটাও তাই তাকে দিয়েই করেছিলাম। বাবাকে নিয়ে দেশে ফিরে আসার পরে মায়ের সঙ্গে পলিনের কথোপকথনের দৃশ্যটা এখনও যেন চোখে ভাসে। মা মেয়ের একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কান্না, এক চোখে হাসি আরেক চোখে জল- কঠিন দৃশ্যেও কিভাবে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করতে হয়, সেটা শীলা আহমেদ খুব ভালোভাবেই জানতেন। 

অথচ দারুণ এই অভিনেত্রী খোয়াব নগরের পর আর কোন নাটকে অভিনয় করেননি, দাঁড়াননি ক্যামেরার সামনে। কারনটা অনুমান করা কঠিন নয়, অভিমানেই নিজেকে আড়াল করে নিয়েছিলেন, চাকচিক্যের দুনিয়া থেকে সরে গিয়ে সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চেয়েছেন। মাত্র ষোলো বছর বয়সে 'অভিনেত্রী শীলা'র পথচলা থেমে গেছে, আটটা নাটক আর একটা সিনেমায় থমকে গেছে তার ক্যারিয়ার, শীলা নিজেই দাড়ি টেনেছেন গল্পটায়। 

অভিনয় ছাড়ার সিদ্ধান্তটা শীলা আহমেদের একান্তই ব্যক্তিগত, সেটাকে আমরা শ্রদ্ধা করি। তবু আফসোস হয় জানেন? শীলা যদি অভিনয়টা চালিয়ে যেতেন, যদি শ্রাবণ মেঘের দিন, চন্দ্রকথা, শ্যামল ছায়া, উড়ে যায় বকপক্ষী- হুমায়ূনের এসব সৃষ্টিতে শীলা জড়িত থাকতেন, কী হতো তাহলে? আরও কত কিছু পাওয়ার কথা ছিল অসাধারণ এই অভিনেত্রীর কাছ থেকে, এটা ভাবতেই অদ্ভুত একটা শূন্যতা গ্রাস করে। অভিনয়ের সহজাত প্রতিভা ছিল শীলার, এমন মেধাবী অভিনেত্রীর ক্যারিয়ারে হাতেগোনা কয়েকটা কাজ মাত্র- এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়। 


ইতালিয়ান একটা প্রবাদ আছে- ভিনি, ভিডি, ভিসি। বাংলা করলে দাঁড়ায় এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। শীলার গল্পটায় শেষে শুধু ‘হারিয়ে গেলাম’ যোগ হবে। ১৯৮২ সালের আজকের দিনে জন্ম হয়েছিল তার, ধুমকেতুর মতো এসে তিনি আপন প্রতিভায় জয় করেছিলেন দর্শকের হৃদয়, তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগে আবার পর্দার আড়ালেও চলে গেলেন- শীলা আহমেদ তাই আমাদের কাছে ভালোবাসার পাশাপাশি অনন্ত এক শূন্যতারও নাম।


শেয়ার করুন