২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ১০:৪০:০৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


মা-বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্য
আহবাব চৌধুরী খোকন
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৩-২০২২
মা-বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্য


সংবাদপত্রের অনলাইন ভার্সনে চোখ ভোলানো আমার বহু পুরোনো একটি অভ্যাস। কাজ শেষে যত রাত করেই ঘরে ফিরি না কেন, সচরাচর এই অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটে না। সংবাদপত্রের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে চোখের পলকে ঘুরে আসা যায় সমগ্র পৃথিবী। তবে দেশের কিছু কিছু সংবাদ ইদানীং আমাকে প্রায়শই বিচলিত করে। সম্প্রতি দেখছি আমাদের দেশে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি বিশেষ করে বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সন্তানের কদর ক্রমেই কমে আসছে।


যে পিতা-মাতা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সন্তানদের তিল তিল করে গড়ে তোলেন, তারা যদি জীবন সায়াহ্নে এসে স্বীয় সন্তানের নিকট থেকে আদর যত্নের বদলে পান অপমান ও অবহেলা, সেটা তাঁদের জন্য কতোটা দুঃখের বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু দুঃখজনক হলে ও সত্য যে, আমাদের সমাজে এখন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের প্রতি অবহেলা ও অসম্মান প্রদর্শন একটি অতি স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। কী শহর, কী গ্রাম, কী ধনী, কী দরিদ্র সর্বত্র একই অবস্থা। কেন জানি না বয়স্ক বাবা-মাকে যথার্থ সম্মান দিতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। সম্প্রতি শুনলাম খোদ দেশের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী জনাব আব্দুল মাল আব্দুল মুহিত সাংবাদিকদের সাথে আলাপচারিতায় তাঁর এই বৃদ্ধ বয়সে সন্তানদের ব্যবহারে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আমাদের কমিউনিটির এক বড় ভাই এই প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘সন্তানদের শুধু শিক্ষিত করলেই হবে না, সুশিক্ষা দিতে হবে। আমাদের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী সন্তানদের সুশিক্ষা দেননি।’ জনাব মুহিত বাংলাদেশের জীবন্ত এক কিংবদন্তির নাম। তাঁর সমসাময়িক অনেকেই এখন আর ইহজগতে নেই। জীবনের দীর্ঘসময় তিনি দেশের একজন দাপুটে আমলা হিসেবে দেশে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিচারিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। চাকরি জীবন থেকে অবসর নিয়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রথমে এরশাদ সরকার ও পরে শেখ হাসিনা সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে বেশ দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন।


এখন জীবন সায়াহ্নে এসে যদি দেশের এই রত্নগর্ভা ব্যক্তিকে নিজ সন্তান-সন্ততি বা পরিবার-পরিজনের নিকট থেকে অবহেলার শিকার হতে হয় এটা হবে খুবই দুঃখজনক। এই মেধাবী মানুষটি হচ্ছেন গোটা বাংলাদেশের অহংকার। আমাদের মধ্য থেকে গুণীজনেরা একে একে হারিয়ে যাচ্ছেন। সর্বজন শ্রদ্ধেয় জিল্লুর রহমান, আবদুস সামাদ আজাদ, এম সাইফুর রহমান, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, দেওয়ান ফরিদ গাজী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ চলে গেলেন। একজন মুহিত যদি চলে যান হাজার বছরেও আমরা আরেকজন মুহিত পাবো না।  



একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম, পটুয়াখালীর বাউফলে ছেলের নিকট ভরণপোষণ দাবি করায় এক বৃদ্ধা মাকে পিঠিয়েছে তাঁরই পুত্র ও পুত্রবধূ। হতভাগা এই মায়ের নাম জমিলা খাতুন। বৃদ্ধা জামিলা ছেলের নিকট  টাকা চাওয়ায় পুত্র জালাল ও তার স্ত্রী শারমিন  উত্তেজিত হয়ে তাকে প্রথমে লাঠিপেটা ও পরে ইট দিয়ে আঘাত করে মারাত্মক আহত করে। পরে বাড়ির আঙিনায় ফেলে ধারালো দা দিয়ে গলা কাটতে উদ্যত হলে স্থানীয় এলাকাবাসী তাঁকে উদ্ধার করে রাউফল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। আরেকটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম, সামান্য একটু ভাত চাওয়ার অপরাধে বৃদ্ধা মা তসলিমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে তাঁরই গর্ভজাত সন্তান বদির উদ্দিন।  ঘটনাটি ঘটেছে, ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলার ভাঙ্গিপাড়া গ্রামে। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ ত্রিশ বছর পূর্বে দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে বাবা সাকিব উদ্দিন মারা গেলে বিধবা তাসলিমা বহুকষ্টে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেন। কিন্তু এখন সামান্য কিছু হলে ছেলেরা বৃদ্ধা মাকে নির্যাতন করে।


ঘটনার দিন সকালে বৃদ্ধা মা তাসলিমা ছেলের বউয়ের কাছে ভাত চাইতে গেলে পুত্রবধূ রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে গালিগালাজ করে।  এ সময় বড় ছেলে বদির উদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে মার মুখে আঘাত করে। এতে তার বাম চোখের কিছু অংশ কেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। পরে তারা বৃদ্ধা মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। স্থানীয় এলাকাবাসী ঘটনাটি শুনে তাসলিমাকে উদ্ধার করে  হাসপাতালে ভর্তি করে। তৃতীয় সংবাদটি হচ্ছে টঙ্গীতে সত্তর বছর বয়সী বৃদ্ধ দম্পতির একমাত্র অবলম্বন ছিল একটি ঘোড়ার গাড়ি।  সম্প্রতি বাসের ধাক্কায় তার ঘোড়ার একটি পা ভেঙে গেলে এখন তিনি বৃদ্ধ স্ত্রীকে নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ এই দম্পতির তিনটি ছেলে সন্তান থাকলেও এই বিপদে কেউ তাদের খবর রাখছে না। 

অতি সম্প্রতি আমরা দেখেছি, ধনাঢ্য পরিবারের এক ব্যবসায়ী বাবা ফেসবুক লাইভে এসে নিজের মাথায় নিজে গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন।  হতভাগ্য এই বাবার নাম আবু মোহসিন খান। সচ্ছল পরিবারের এই অসহায় ব্যক্তি হয়তোবা একাকীত্বের যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হৃদয়বিদারক এই পথ বেছে নিয়েছেন। ধানমন্ডির একটি ফ্ল্যাটে দীর্ঘদিন যাবৎ একাকী জীবনযাপন করে আসছিলেন। একমাত্র মেয়ে ঢাকাই সিনেমার প্রতিষ্ঠিত নায়ক রিয়াজের স্ত্রী। ছেলে মাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থাকে। একসময় ব্যবসা করলেও ঋণে জর্জরিত হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দেন। মৃত্যুর আগে সুইসাইড নোটে লিখে গেছেন তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কত অসহায় হলে একজন মানুষ এমন কাজ করতে পাবেন সহজে অনুমেয়। সম্প্রতি তাঁর শরীরে মারণব্যাধি ক্যানসার দেখা দিলেও তাঁর ঘরে রান্নাবান্নার জন্য একজন কাজের লোকও ছিল না। তিনি নিজে বাহির থেকে খাবার এনে খাওয়া-দাওয়া করতেন। মৃত্যুর পর গণমাধ্যমে আমরা তাঁর কন্যা ও জামাতার মায়াকান্না দেখলে ও একজন মৃত্যু পথযাত্রী বাবাকে কেন দিনের পর দিন একটি ফ্ল্যাটে একাকী জীবনযাপন করতে হলো এর কারণ জানতে পারিনি। আবার আরেকটি সংবাদ চোখে পড়লো।  দেখলাম তিন-তিনজন প্রতিষ্ঠিত সন্তানের পিতাকে শেষ বয়সে আশ্রয় নিতে হয়েছে আগারগাঁও প্রবীণ নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে।


জানা যায়, অধ্যাপক আব্দুল আউয়াল পেশায় ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি দীর্ঘদিন ঢাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তার তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র মেয়ে রেজিনা ইয়াছমিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। বড় ছেলে অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার ইফতেখার হাসান ঢাকায় থাকে। ছোট ছেলে রাকিব ইফতেখার হাসান অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।  ছেলেমেয়েরা দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হলেও পিতাকে থাকতে হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে।  জনাব আউয়াল জানান, ২০০৬ সালে চাকরি থেকে অবসর নেয়ার কিছুদিন পর ছেলেমেয়েরা তাঁর খোঁজখবর নেয়া বন্ধ করে দেয়। ঢাকা কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটে তার একটি ফ্ল্যাট ছিল।  পল্লবীতেও বেশ কিছু জমি ছিল।  কিন্তু সব কিছু বড় ছেলে সুকৌশলে বিক্রি করে নিয়ে গেছে। জনাব আউয়াল জানান, চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পর কিছুদিন বড় ছেলের সঙ্গে ছিলেন। একদিন বাসায় থাকা অবস্থায় পুত্রবধূর মুখে গালি শুনে তিনি বাসা ছেড়ে চলে যান আর ফিরে যাননি। কেউ খোঁজও করেনি।  ছোট ছেলে ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশে এসে  তাকে না জানিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। অথচ এই ছেলের পড়ালেখার জন্য তিনি পেনশনের টাকা থেকে ২৬ লাখ টাকা অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়েছিলেন। ছেলে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে বাবাকে ভুলে গেছে।  

সুহৃদ পাঠক গল্পগুলো আমাদের সমাজেরই খণ্ডিত অংশ। এরকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে যেগুলো উল্লেখ করে আমি লেখার কলেরব বৃদ্ধি করতে চাই না। আমরা যত আধুনিক ও শিক্ষিত হচ্ছি, ততোই আমাদের মধ্য থেকে মানবিকতা লোপ পাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই, নব্বই শতাংশ মুসলমান অধ্যুষিত এই দেশে আমরা অনেকে নিজেকে ধার্মিক বলে দাবি করি, কিন্তু আমাদের ধর্ম ইসলাম মা-বাবার প্রতি কী রকম আচরণ করতে বলেছে সে ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো বৃদ্ধ বয়সে তার দেশের নাগরিকদের পূর্ণ দায়িত্ব নিলেও যেহেতু আর্থিক অসঙ্গতির কারণে আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে সেটা সম্ভব হয় না, তাই ধনী-গরিব নির্বিশেষে প্রতিটি সন্তান যেন বৃদ্ধ বয়সে তার মা-বাবার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হয়, সেজন্য দেশে আইন করা প্রয়োজন। ভুলে গেলে চলবে না আজকে যাদের শক্তি সামর্থ্য রয়েছে, তাদের জীবনেও একদিন বার্ধক্য আসবে। তাই বৃদ্ধ মা-বাবার অধিকার রক্ষায় প্রতিটি সন্তানের সচেতনতা বাঞ্ছনীয়।

 

লেখক : কলাম লেখক ও কমিউনিটি অ্যাক্টিভিস্ট, নিউইয়র্ক 


শেয়ার করুন