১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০২:০৬:৩৩ অপরাহ্ন


এমএসএফের শঙ্কা আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার
বিশেষ প্রতিবেদক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৩-২০২৩
এমএসএফের শঙ্কা আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল


আগামী নির্বাচনগুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় করে এসব কথা বলা হয় এমএসএফের পক্ষ থেকে। এর পাশাপাশি নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বিধানের বদলে রাষ্ট্র কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্য দিয়ে এমএসএফের পক্ষ থেকে গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। 

এমএসএফের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবরণীতে বলা হয়েছে , দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের মতোই উদ্বেগজনক। দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বন্দুকযুদ্ধ, তাদের পরিচয়ে অপহরণ ও অপহরণের চেষ্টা, গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মৃত্যু, নির্যাতন, অপতৎপরতার অভিযোগের মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা কিছুটা নিম্নগামী হলেও তা এখনও উদ্বেগজনক। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অপব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকদের বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা ও নির্যাতন করার মত ঘটনা বন্ধ হয়নি। রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা বেড়েছে। অধিকন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। 

নির্বাচনী পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয় ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত কম। নির্বাচন কমিশনের সূত্রমতে ভোটার উপস্থিতি ছিল ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ। তেমন সহিংসতার ঘটনা না ঘটলেও ভোট কারচুপি, আওয়ামী লীগ- বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, আওয়ামী লীগ ও ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও আচরণবিধির লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুস সাত্তার ভূঁইয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আবু আসিফের নির্বাচনের বেশ কয়েক দিন আগে থেকে নির্বাচন পর্যন্ত নিখোঁজ অবস্থায় থাকা এবং বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে আশরাফুল হোসেন আলম ‘হিরো আলম’ নামে পরিচিত এর অল্পসংখ্যক ভোটের ব্যবধানে হেরে যাওয়া, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন-উত্তর সময়ে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেভাবে সরকারি দলের সার্বিক প্রচেষ্টা এবং তত্ত্বাবধানে ভোট হয়েছে, সে ধরনের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফের নিখোঁজ থাকার ঘটনাটি দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এই প্রথম প্রত্যক্ষ করা গেছে যা আগামী নির্বাচনগুলোকেও প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। 

অন্যদিকে নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সহিংসতার চিত্র তুলে ধরে এমএসএফের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকার দলীয় ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহিংসতা, হানাহানি হতাহতের ঘটনাসহ নাগরিক জীবনে উৎকণ্ঠা বেড়েছে। ফলে হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিস্তারিতভাবে বলতে গিয়ে এমএসের কিছু উদাহরণ টেনে আনে। এতে দেখানো হয় ১১ ফেব্রুয়ারি ইউনিয়ন পর্যায়ে ৪০টি ইউনিয়নে ও ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণে দুইটি পদযাত্রা, ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেটসহ ১১টি মহানগরে ও ২৫ ফেব্রুয়ারি ৬৬টি সাংগঠনিক জেলায় বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচি চলাকালে বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও তার সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যুবলীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, মারামারি, লাঠিপেটা ও সমাবেশ চলাকালে এবং সমাবেশের আগে ও পরে সমাবেশকে সফল না করতে দেওয়া, বাধাগ্রস্ত করা ও বিএনপি কর্মীদের ধরপাকড়ের ঘটনা ঘটেছে ।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ মাসে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতার ৫১টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৬৯১ জন। জানুয়ারি মাসে এর সংখ্যা ছিল ৩৭টি, হতাহতের সংখ্যার মধ্যে তিন জন নিহত, দুই জন নিখোঁজ ও ২২০ জন আহত হন। ফেব্রুয়ারি মাসে গণমাধ্যমে সূত্র অনুযায়ী নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সহিংসতায় মোট ৬৯০ জন আহত ও আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে এক জন কিশোর নিহত হয়েছেন।

২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় সকালে দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের চরকাছিয়া গ্রামে মিয়ারহাট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জেরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ছুরিকাঘাতে রাসেল হোসেন (১৪) নামের এক কিশোর নিহত হয়েছে। 

শান্তিপূর্ণ সভা, মিছিল ও র‌্যালিতে হামলা

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী জানানো হয় যে, ফেব্রুয়ারিতে বিরোধী দল বিএনপির পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বলপ্রয়োগ, বাধাদান, শান্তিপূর্ণ সভা, মিছিল ও র‌্যালিতে হামলার আটটি ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলোতে ১২৩ জন আহত হয়েছেন। এমএসএফের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক হয়রানি, গায়েবি মামলা ও গ্রেফতারের চিত্রও তুলে ধরে বলা হয় যে, বিরোধীদলীয় কর্মকা-কে বাধাগ্রস্ত করার অন্যতম উপায় হিসেবে হয়রানিমূলক মামলা ছাড়াও গায়েবি মামলা দায়ের, গ্রেফতার ও বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এহেন প্রয়াস নাগরিক জীবনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। এ মাসে ৪২টি রাজনৈতিক মামলার মধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে ৩৩টি, জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আটটি এবং গণঅধিকার পরিষদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে। মোট ৫৯৪ জন রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জানুয়ারি মাসে রাজনৈতিক মামলার সংখ্যা ছিল ১৩টি, যার মধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে ৬টি ও জামায়েত ইসলামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৭টি। মোট ৪৯২ জন রাজনৈতিক কর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। এ মাসে রাজনৈতিক কর্মকা- চলমান অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় ৫০৮ জন নেতাকর্মীকে অপরদিকে আদালতে জামিন প্রার্থনাকালে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে ৮৬ জন বিএনপির নেতাকর্মীকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ৪৮০ জন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের, ১১২ জন জামায়াতে ইসলামী এবং দুই জন গণঅধিকার পরিষদের কর্মী।

এছাড়াও এমএসএফের পক্ষ থেকে শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বন্দুকযুদ্ধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও অপহরণের চেষ্টা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মৃত্যু, নির্যাতন, অপতৎপরতার অভিযোগ, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার, কারা হেফাজতে মৃত্যুসীমান্তে হত্যা ও পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরা হয়। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার-অপব্যবহার প্রসঙ্গে বলা হয় যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবলভাবে সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও এ আইনে মামলার নামে হয়রানি কমেনি বরং এর যথেচ্ছ অপব্যবহারের বিষয়টি এ মাসে নতুন মাত্রায় ক্ষোভ ও উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি ২০২৩ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পাঁচটি মামলা হয়েছে এবং ১২ জন গ্রেফতার হয়েছেন। জানুয়ারি মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাতটি মামলায় ১৯ জন আসামির মধ্যে সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

এ সময়ে দুই জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি সাংবাদিক আরিফুজ্জামান খান রিয়াদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও হয়রানিমূলকভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন পিকু। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পাঁচ জন বিএনপি, এক জন জামায়াত, তিন জন সাধারণ যুবক ও তিন জন ব্যাংক কর্মকর্তা রয়েছেন। সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্ট/শেয়ার/মন্তব্য করার অভিযোগে তিনটি মামলা, মেয়েদের ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল এর জন্য একটি মামলা ও অপর একটি মামলা হয়েছে জমিসংক্রান্ত বিরোধের অভিযোগে। বলা হয় যে নাজিরপুর উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবু হাসান খানসহ পাঁচ জনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন খানের করা মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। এছাড়া তিন জন ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে মামলা, সুনামগঞ্জ-২ আসনের (দিরাই-শাল্লা) সংসদ সদস্য জয়া সেনগুপ্তাকে নিয়ে কটূক্তি করায় এস এম শামীম (৪৫) নামের জামায়াতের কর্মী ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রয়াত স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকে নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের আশকার পাইন ওরফে আশকারুল (৩৮) নামের এক যুবক এবং নোয়াখালীর হাতিয়ায় জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এক জন ও ঢাকায় দারাজ অনলাইন শপের পণ্য ডেলিভারি দিতে গিয়ে কৌশলে গোপন মুহূর্তের ছবি নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করার অভিযোগে এক জন যুবককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এসব তথ্য দিয়ে এমএসএফ মনে করে, বাংলাদেশ দন্ডবিধি আইনে মামলা না করে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলা করা হয়রানিমূলক ও অগ্রহণযোগ্য।

সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশে হামলা 

দৈনিক দিনকালের ঘোষণা বাতিল করেছে সরকার, যা স্বচ্ছ গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ। এমএসএফ মনে করে, একটি সংবাদপত্র বন্ধ করা গণতান্ত্রিক নীতির লঙ্ঘন। এ ছাড়া এ মাসে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

শেয়ার করুন