১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৫:২৮:৩৫ পূর্বাহ্ন


মার্কিন ভিসা-নীতিতে সংক্রান্ত সতর্কতায় তোলপাড়
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রাপ্ত ও প্রত্যাশীদের মধ্যে চরম অস্বস্তি
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৫-২০২৩
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রাপ্ত ও প্রত্যাশীদের মধ্যে চরম অস্বস্তি


বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা-নীতি ( থ্রি-সির অধীন) এক ধরনের মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পূর্ব কঠোর সতর্কতা! তারা জানাচ্ছে এর আওতায় চলে আসতে পারে যে কেউ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য  নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাধাদান করেছেন বা করছেন বা বিরোধী মত প্রকাশের ওপর হামলা বা বাধাদান করেছে বা নির্দেশ দিয়েছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনে হবে, তারাই পাবে না ভিসা। কিন্তু এখন থেকে মার্কিনিরা পছন্দ করেন না এমন যে কাউকেই এখন এ আওতায় ফেলে দিতে পারবে। কারণ ভিসা না দিলে তো কৈফিয়ত দেবে না তারা। ভিসা ফর্মে দিতে হবে বিগত সময়ে যে সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে, সে তালিকা ও লিংকও। এর অর্থ বিগত ওই সময়ে মার্কিনিদের বিরুদ্ধে কেউ যদি বিষেধাগার করেছেন সেটাও তারা আমলে নেবে। প্রকাশ্যে বক্তব্য বা টকশো বা রেকর্ড করা সমালোচনা, সুষ্ঠু নির্বাচন না হওয়ার পেছনে কাজ করা সেগুলো তো আছেই। অর্থাৎ এটা এক ধরনের ভিসা প্রত্যাশার ওপর কতিপয় মানুষের জন্য কঠিন সতর্কতা। 

এ ধরনের এক ভিসা-নীতি বা ভিসাসংক্রান্ত কঠোর সতর্কতা দেবে যুক্তরাষ্ট্র, সেটা সম্ভবত কল্পনাও করেনি কেউ। দীর্ঘদিন থেকেই নিষেধাজ্ঞা আসছে সেটা বাতাসে উড়ছিল। কিন্তু এলো অন্য ধরনের এক পলিসি। যদিও এটা মার্কিনিদের ভিসা-নীতি বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আড়ালে এটাও এক ধরনের নিষেধাজ্ঞাই তো বটে! এখন থেকে এর অধীনে কে কে পড়বেন আর কে কে পরবেন না, সেটা শুধু মার্কিনিরাই ভাল বলতে পারবেন। সম্পূর্ণ তাদের ইচ্ছা অনিশ্চার ওপর চলবে ওই নীতি। 

ধারণা করা হচ্ছিল, কোনো ব্যাক্তি বিশেষের ওপর আসতে পারে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এলো ভিন্ন প্রক্রিয়ার এক নীতি যা নিয়ে বাংলাদেশের সর্বমহল তোলপাড়। দুশ্চিন্তার কালো ভাঁজ অনেকের ললাটে। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এরপরও যে আলোচনা সেটা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন ভিসা-নীতিতে দেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে তো! আমরা ভোট দিতে পারবো তো! .

গত ১০ এপ্রিলে সংসদে প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন, ‘আজকেও আমি বলি, যে দেশটা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) আমাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের ছবক দেয়। আর  আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচন-কোদন করছেন, উঠবস করছেন, উৎফুল্ল হচ্ছেন। হ্যাঁ, তারা যে কোনো দেশের ক্ষমতা উল্টাতে পারেন, পাল্টাতে পারেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘তারা আমাদেরকে এখন গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী?’ তিনি এ ক্ষেত্রে আমেরিকার টেনেসিস রাজ্যের প্রসঙ্গ তুলে সেখানে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র কোথায়? বলে প্রশ্ন তুলেছিলেন। 

শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়, অস্ত্র নিয়ে স্কুলে ঢুকে যায়। বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করছে। শিক্ষকদের হত্যা করছে। শপিংমলে ঢুকে যাচ্ছে। হত্যা করছে। ক্লাবে যাচ্ছে, সেখানে হত্যা করছে। এটা প্রতিনিয়ত, প্রতি দিনেরই ব্যাপার। কোনো না কোনো রাজ্যে অনবরত এই ঘটনা ঘটছে।’ এরপর তিনি যুক্তরাজ্যে সফরকালে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমেরিকা সম্ভবত আমাকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না।’ 

এছাড়াও নানা সময়ে সরকারের মন্ত্রিপরিষদের অনেকেই আমেরিকার সমালোচনা করে আসছেন। জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফর শেষ করে দেশে ফিরেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা আমাদের স্যাংশন দেবে তাদের কাছ থেকে আমরা কিছুই কিনবো না। এটাতেই একটা শঙ্কা আঁচ করা গিয়েছিল যে বাংলাদেশের সঙ্গে তো মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্ক চমৎকার বলে দাবি করা হয়। এরপরও এ ধরনের কঠোর সমালোচনা কী কারণে। অনেকেই এ রহস্য খুঁজতে থাকেন। কিন্তু কুলকিনারা করতে পারেননি সম্ভবত কেউই। এবার সম্ভবত কিছুটা আঁচ করা গেল যে মার্কিনিরা এমন একটা কিছু করছে, যা দেশের নীতিনির্ধারকরা অনুধাবনে সক্ষম হয়েছিলেন আগেই। ওই থেকেই সমালোচনা।

কেন ভিসা-নীতি ঘোষণা

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের জন্য ভিসা-নীতি ঘোষণা করেন ২৪ মে। বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় সুষ্ঠু গণতন্ত্রের স্বার্থে যে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে বাধাগ্রস্থ করবেন তাকে বা তাদের ওপর ছাড়াও তাদের ফ্যামিলি মেম্বারদের ভিসা দেবেনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এমন ঘোষণা ইতিমধ্যে তোলপাড় হয়েছে বাংলাদেশে। 

কারণ এ ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য একটা লজ্জাজনক, অবমাননাকরও। গোটা বিশ্বেই এ ঘোষণা প্রচারিত হয়েছে। যেখানে সবাই জানলো বাংলাদেশে অবাধ গণতন্ত্র ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান হয় না। মার্কিন প্রশাসন দেশের গণতন্ত্রে সুষ্ঠু ধারা ফিরিয়ে আসতে ওই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছে। বিশ্বে এমন ভিসা-নীতি আরো দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার মধ্যে রয়েছে নাইজেরিয়া, সুদানের মতো দেশ। বাংলাদেশ এখন কোন কাতারে নামিয়েছে মার্কিনিরা-এখান থেকে সহজেই অনুমেয়।  

কঠোর সতর্কতা কাদের জন্য? 

গত ২৪ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘ বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কার্যক্রম এগিয়ে নিতে  আমি আজকে একটি নতুন ভিসা-নীতি ঘোষণা করছি। এই নীতির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে সক্ষম হবে।’ যাদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ হবে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারপন্থী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইনপ্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।

বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে, এমন কাজের মধ্যে রয়েছে ভোট কারচুপি। ভোটারদের ভয় দেখানো। সহিংসতার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা। শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার প্রয়োগ করতে বাধা দেয়া এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যমকে তাদের মতামত প্রচার করা থেকে বিরত রাখা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ভোটার, রাজনৈতিক দল, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যমসহ সবার। যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের সবাইকে আমাদের সমর্থন দিতে আমি এই নীতি ঘোষণা করছি।’

কী চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মার্কিন প্রশাসনের এমন ঘোষণায় বিব্রতবোধ করছেন। তারা বলছেন, এটা দেশের জন্য লজ্জা ও অবমাননাকর। বাংলাদেশের ভূরাজনীতির একটা বিষয় রয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের সমন্বয়ে যে কোয়াড গঠিত হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশ যোগ দিক এ চাপ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ চীনকে দমন করার এমন কোয়াডে যুক্ত হওয়ার জন্য রাজি হয়নি। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা রেখে চলছে। এটা ভালো ঠেকছে না কোয়াডের। কেউ বলছেন, মার্কিনিরা বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি চায়। বাংলাদেশ রাজি হচ্ছে না। এজন্য তারা ক্ষেপেছে। তবে কেউ এভাবে বিশ্লেষণ করলেও অনেকে আবার এতে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন। বলছেন, মার্কিনিরা যদি কিছু চেয়েই থাকে বা তাদের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের এমন শক্তি নেই তাতে বাধা দিতে পারে। বরং এগুলোতে তাদের অতটা মনোযোগ নেই। 

বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বিশাল একটা অংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়। বিদেশ থেকে যে রেমিট্যান্স আসে তার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ফলে এখানেও ইচ্ছে করলে মার্কিনিরা হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু সেটা তো তারা করছে না। বরং করোনার সময়ে বাংলাদেশের মানুষকে সুরক্ষা দিতে। গার্মেন্টস কর্মীদের সুরক্ষা দিতে বিশাল পরিমাণ করোনা টিকা এমনিতেই প্রদান করেছে তারা বাংলাদেশকে। বিদেশে ফ্রিতে যেসব টিকা মার্কিনিরা দিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চালান ছিল বাংলাদেশের জন্য। অথচ ভারত অগ্রিম অর্থ নিয়ে টিকা দেওয়ার কথা বলেও ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। কিন্তু মার্কিনিরা দিয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি  ফ্রিতে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি দেশটির ভালোবাসার এটা একটা নিদর্শনও। 

মার্কিনিদের আসল উদ্দেশ্য? 

বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বিশ্বে গণতন্ত্রে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতে শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখে চলছেন। এটা বাইডেন প্রশাসনের নির্বাচনী অঙ্গীকার। ইতিমধ্যে দু’দুবার বাইডেন গণতান্ত্রিক সম্মেলন করেছেন গণতন্ত্র থাকা দেশসমূহকে নিয়ে। এতে সবাইকে আমন্ত্রণ জানায়নি তারা। যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও। বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটা রোডম্যাপ চেয়ে আসছেন তারা। কীভাবে উন্নতি ঘটানো হবে গণতন্ত্রের। কিন্তু বাংলাদেশের জবাবে বাইডেন প্রশাসন খুশি হতে পারেনি সম্ভবত। 

এতে করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনটা যাতে সুষ্ঠু ও অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হয় সে জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বাংলাদেশের দাতা/উন্নয়ন সহযোগী দেশসমূহ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেনদরবার করে আসছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশে অবস্থিত ওইসব দেশের রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নির্বাচনী কর্মকর্তা, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে কথা বলে একটা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছেন। কিন্তু এতে তারা সফল নন। বরং সরকারপন্থী দল ও বিরোধীদলসমূহ যেভাবে একে অপরের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করছে তাতে বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কোনোরকমই সম্ভবপর নয় এমন পরিস্থিতি বিরাজমান। 

এমতাবস্থায় আগামী বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন আবারও এক তরফা হওয়ার দিকেই ধাবিত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কেননা দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি ও সমমনা দলের দাবিÑতত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। সরকারি দল সেটাতে পাত্তাই দিচ্ছে না। বরং বিরোধীদলের ওপর চলছে দমন-পীড়ন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল অভিযোগ করছেন সরকার দলীয় লোকজন এখন বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেও হামলা-মামলা করছে। ক্ষমতাসীনরা বারবার বলছেন তারা একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করবে। যেখানে কোনো কারচুপি বা কোনো প্রভাব থাকবে না সরকারের। কিন্তু বিএনপিসহ সমমনা অন্যদলগুলো সরকারের এ কথায় আস্থা পাচ্ছে না। উদাহরণ টানছে ২০১৪ ও ২০১৮-এর কথা। ওই দুই নির্বাচনের আগেও নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু বাস্তবে বিরোধীদলের প্রার্থীর আশপাশের লোকদের মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে গ্রেফতার ও ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে বলে বিএনপি অভিযোগ করে আসছে। একই সঙ্গে ২০১৮ সালের নির্বাচন আগের রাতে সম্পন্ন হয়েছে বলেও বিএনপির অভিযোগ। ফলে ২০২৩-এর দ্বাদশ নির্বাচন এ সরকারের অধীনে কোনোভাবেই সুষ্ঠু হবে না বলে বিএনপির দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন। এমতাবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওই ভিসা-নীতির ঘোষণা দিয়েছেন। 

আমেরিকাতে না গেলে কী হবে? 

স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নটা উঠেছে, আমেরিকা ভিসা না দিলে তাতে কী হয়েছে? কিন্তু আসলেই কী? আমেরিকা ভিসা দিলো কি দিলো না সেটা বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে সম্ভবত ১৬ কোটি ৯৯ লাখ মানুষেরই মাথাব্যথা নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রয়োজন ব্যবসায়ী, আমলা, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষে কাজ করা লোকদের। যাদের চাকরি বা ব্যবসাকালীন সময়েই ফ্যামিলি বা ছেলে মেয়েরা পড়াশোনার জন্য আমেরিকাসহ উন্নত দেশসমূহে অবস্থান করছেন। চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করার পর তারাও পাড়ি জমান ওইসব দেশে। তাছাড়া বাংলাদেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের সবারই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা প্রয়োজন। কারণ তাদের পণ্য ওইসব দেশে যাচ্ছে। ফলে তাদেরও যেতে হয়। দেশে ব্যবসার পাশাপাশি হয়তো রাজনীতির সঙ্গেও তারা জড়িত। ফলে এমন সতর্কতায় তাদের মধ্যে নেমে এসেছে অস্বস্তি। 

সবাইকেই যে ভিসা দেবে না এটা কিন্তু বলেনি। বিশেষ সাধারণ মানুষ। সাধারণ চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, আর্কিটেক্ট  থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার মানুষ অনায়াসেই যেতে পারবেন। ভিসা দেবে না ওইসব লোকদের তারা যে-ই হোন না কেন। তারা হলেন-যারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করবে, সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট অনুষ্ঠানে বাধাদান করবে। বিরোধী মতের মানুষদের দমন-পীড়ন করবেন। সভা-সমাবেশে হামলা করবে। এসব কাজে নির্দেশদাতা ও বাস্তবায়নকারী উভয়েই ওই ভিসা-নীতির আওতায় পড়ে যাবেন। 

ফলে একদিকে চিন্তা করলে যে কেউই ওই ভিসা-নীতির আওতায় রয়েছেন। আবার ফ্রেশ থাকলে তিনি তার আওতায় থাকবেন না। তবে এটা ঠিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন থেকে প্রতিটা ভিসা আবেদনকারীর প্রোফাইল যাচাই-বাছাই করে ভিসা দেবেন। অর্থাৎ বিগত সময়ের সব কর্মকাণ্ড এককথায় আমলনামা তারা যাচাই করে দেখবেন। যাতে তার অনেক পারসোনাল বিষয়ও মার্কিনিরা তদন্ত করবেন, যা আগে ছিল না। এক দেশে ভ্রমণের জন্য এমন জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে প্রতিটা ভিসা প্রার্থীকে। এছাড়া ভিসা পাওয়া বা কারো কারো ৫ বা ১০ বছরের ভিসা বা গ্রিনকার্ড রয়েছে এমন লোকজনও যদি বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বাধাদানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বলে মার্কিন প্রশাসন প্রমাণ পান, তাদেরও শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবেন। তাদের ভিসা স্ট্যাটাস বাতিল হতে পারে বলে বিভিন্ন ব্যখ্যায় এসেছে। ফলে এমন ঘোষণার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যেতে হবে না। হয়তো মার্কিন মুল্লুকে সফর করতে গেলে বিভিন্ন এয়ারপোর্টেই এখন থেকে বাধাপ্রাপ্ত হতে পারেন। 

মার্কিন প্রশাসন ওই ঘোষণা দিলেও বাস্তবতায় কিন্তু আমেরিকার সার্ভার ব্যবহার করে যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশসমূহ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ উন্নত বিশ্ব। ফলে আমেরিকায় যদি ভিসা রিফিউজ হয় কেউ তাদের জন্য ওইসব দেশেও ভিসাপ্রাপ্তি কঠিন হয়ে যাবে। ফলে অনাগত দিনে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, যারা উন্নত বিশ্বে গমন করতে চাইবেন বিভিন্ন কারণে তাদের জন্য কঠিন একসময় সমাগত। 

রাজনৈতিকভাবে কে লাভবান? 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের জন্য ভিসা-নীতিতে সম্মতি ও স্বাগত জানিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিও। দেশে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে যেন সবাই আন্তরিক। এ আন্তরিকতা কিছুদিন আগে দেখালেও এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হতো না। কিন্তু এখন সবাই বলছে, মার্কিনিরা যা চাচ্ছে, অর্থাৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনা মানুষের মনের চাহিদা ‘সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা’ সেটাতে একমত। কিন্তু বিগত দুই (২০১৪ ও ২০১৮) জাতীয় নির্বাচনের দিকে তাকালে সেটাতে কী চিত্র। সেখানে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে। সেখানে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে এখন এ পরিস্থিতি চলে আসতো না। ইতিমধ্যে আগামী নির্বাচনের বিরোধীতাকারী বিএনপির বিভিন্ন দোষ-গুণ তুলে ধরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাবরে চিঠি দিয়েছে সরকার পক্ষের একজন। সেখানে বিএনপি যে এ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না এবং ভবিষ্যতেও নেবে না সেটা জানানো হয়েছে। যদিও আমেরিকার কাছে কে কী করছে, সেসব তথ্য তাদের রয়েছে।

বিএনপি এখনো ২০১৪ ও ২০১৮ সালে এ সরকার একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে বলে দাবি করে আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের দাবি করে আসছে দীর্ঘদিন থেকেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যদি বিএনপির দাবি না মেনে একতরফা অন্যদের নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে ফেলে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশদ ব্যাখ্যা নেই। যদিও মার্কিনিরা দীর্ঘদিন থেকে সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে এলেও তাদের এখনকার বিভিন্ন ঘোষণায় অংশগ্রহণমূলক কথাটি দেখা যাচ্ছে না। এটা কী ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছেমতো বা সংবিধান অনুসারে যে ধারা বিদ্যমান সেটাতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে মার্কিনিরা মেনে নেবে?

শেয়ার করুন