২৬ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৮:৫৯:১৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি ঠেকাতে
লুটপাটের মেগা প্রকল্প বাদ দিতে হবে
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৭-২০২২
লুটপাটের মেগা প্রকল্প বাদ দিতে হবে


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয়কে জয় করেছেন। তিনি ভয় পান না। ভয়ের স্থানকে তিনি অভয়ারণ্য দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন, কিন্তু সম্প্রতি তিনি জোরেশোরে বলছেন: কৃচ্ছতা এবং কৃচ্ছতাসাধনই ভবিষ্যৎ ধস নামানো থেকে বেঁচে থাকার একমাত্র সোপান। বিদেশ যাওয়া কমান, বাড়তি খরচ কমান। কথাটা কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড (আইএমএফ)-এর অবকাঠামোগত সমন্বয় সাধনের মন্ত্র।

বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিলিয়ন ১ (এক) ডলার ঋণ চেয়েছে। আর ঋণের মূলশর্ত অবকাঠামোগত সমন্বয় (স্ট্র্যাকচারেল অ্যাডজাস্টমেন্ট)। আরো অনেক শর্ত রয়েছে, তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃচ্ছতার মূলমন্ত্র উচ্চারণ করছেন। তবে তিনি বলছেন না। আইএমএফের শর্তসাপেক্ষ কৃচ্ছতা করুন। কিন্তু বিষয়টা তাই। তাহলে কি বাংলাদেশ এখন শ্রীলঙ্কার পরিণতি দেখে বিপন্নবোধ করছে? প্রধানমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবার নয়।

বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ভারত কিংবা পাকিস্তানের চাইতে বেশি। এদিক থেকে বাংলাদেশের জনগণের অবস্থা তাদের চাইতে উন্নত। সামাজিক উন্নয়ন সূচকও ভালো। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ১০ ডলার। ভারতের মাথাপিছু আর ১ হাজার ৯০০ ডলার আর পাকিস্তানের ১ হাজার ২৮০ ডলার। কিন্তু বাংলাদেশে এখন চলছে হরিলুটের ব্যবসা। অস্ট্রেলিয়ায় সিমেন্টের দাম প্রতি টন ৯ হাজার ৮৬২ ডলার আর পদ্মা সেতুতে ব্যবহারের জন্য সিমেন্ট কেনা হয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে টনপ্রতি ১৫ হাজার  ডলার করে।

হরিলুটের পন্থাটা এখানেই। কে করছে, তা না বলেই বলা চলে বাংলাদেশে আজ শ্বেতহস্তী প্রকল্পের ছড়াছড়ি।  বাংলাদেশ ২০১১ সালের পড়ে আইএমএফ থেকে ঋণ চায়নি এবার চেয়েছে। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা হয়েছে। অথচ প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে আইএমএফ এর ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। শ্রীলঙ্কার যে টালমাটাল অবস্থা তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হলেও বাংলাদেশের সময় এসেছে সতর্ক হওয়ার। প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবার্তাকে অর্থাৎ কৃচ্ছতা সাধনের বার্তাকে এ জন্য সাধুবাদ দিতে হলেও বিষয়টা সহজ নয়। শ্রীলঙ্কায় পেট্রল স্বল্পতা, ওষুধ স্বল্পতা ও বিদেশি মুদ্রার স্বল্পতার কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ক্রাইসিস সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে আইএমএফের কাছে হাত পাততে হয়েছে। কৃচ্ছতাসাধন করেও কূল রক্ষা হয়নি। রাজাপাকসে পরিবার ছিন্নভিন্ন। ভুতুড়ে সরকার সৃষ্টি হয়েছে। সংখ্যাধিক্য সংসদ কোনো কাজে আসেনি পরিস্থিতি সামাল দিতে। যে পাকসে পরিবার তামিলদের সম্পূর্ণ বর্বরতার সঙ্গে দমন করেছে সে পরিবার আজ বিচ্ছুরিত।

বাংলাদেশেও অনেক সমালোচক মনে করে একই পরিস্থিতি হতে পারে যদিও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়া মানে সামগ্রিক ন্যাশনাল আয় বাড়া নয়, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়ছে। বাড়ছে বিদেশি ঋণের বোঝা।

বাংলাদেশ ৬১.৫২ বিলিয়ন ডলার পণ্য আমদানি করছে ২০২১-২২ সালের প্রথম নয় মাসে যা গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ৪৩.৯ শতাংশ বেশি।  আর একইসাথে রফতানি মাত্র ৩২.৯ শতাংশ বেড়েছে। বিদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স ২০১২ সালের প্রথম চার মাসে কমেছে ২০ শতাংশ। আর তার পরিমাণ ৭ বিলিয়ন ডলার। 

জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলের এক রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন বাণিজ্য ঘাটতি আগামী বছরসমূহে আরো দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। অর্থনীতিবিদদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘এই বছর আমদানি ৮৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। আর রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে না। আর ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি রেমিট্যান্স দিয়ে পূরণ হবে না। এই বছর প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি হব। এদিকে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রায় রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে ৮ মাসে। বছরের আগামী মাসগুলোতে তা আরো ৪ বিলিয়ন ডলার কমবে। যদি আমদানির বিপরীতে রফতানি কমে যায়, আর যদি কোনো পন্থায় গ্যাপ পূরণ না হয়, বাংলাদেশে বিদেশি রিজার্ভ আগামী ৩-৪ বছরে আরো কমে যাবে। এ জন্য আইএমএফ ঋণ চাওয়া আর তাতে ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি কারেন্সির মূল্যমান কমে যাবে। যার পতন এখনই দেখা যাচ্ছে।

সমালোচনাকারীরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশ এখন আর নতুন করে ঋণ নিচ্ছে শ্বেতহস্তীর মতো প্রকল্পের জন্য। এই প্রকল্পসমূহ ব্যয়বহুল। এসব প্রকল্প যখন ঋণ পরিশোধের সময় আসবে, তখন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। হোয়াইট এলিফ্যান্ট বা শ্বেতহস্তী প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রূপপুর আনবিক শক্তি প্রকল্প। রাশিয়া এখানে ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে মাত্র ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য। এই ঋণ প্রতি বছর ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার করে পরিশোধ করলে ২০ বছরে পরিশোধ করা যাবে। ২০২৫ সাল থেকে তা পরিশোধ করতে হবে। এই প্রকল্প সবচেয়ে বড় ধরনের শ্বেতহস্তী।

২০২৪ সাল থেকে দেশকে প্রতিবছর ৪ বিলিয়ন ডলার করে পরিশোধ করতে হবে বকেয়া ঋণের জন্য। এই ঋণ পরিশোধ করা বাংলাদেশের জন্য সহজ হবে না। কারণ বড় প্রকল্পগুলো থেকে আয় তেমন বাড়বে না। ইউএনডিপির ঢাকা অফিসের বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদরা বলেন, এই প্রকল্প বাড়তি খরচ ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে হবে। আর তাহলে সময় মতো ঋণ পরিশোধের সুযোগ হবে। 

বাংলাদেশে গরিব লোকদের ওপর চাপ বাড়বে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম বাড়বে। বাংলাদেশকে ভোজ্যতেল, গম, অন্যান্য খাবার আইটেম আমদানি করতে হয় জ্বালানি তো আছেই। দাম বাড়লে গরিব লোকদের সমস্যা হয়। মাথাপিছু আয় বাড়লেও তাতে লাভ নেই। এ জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তাদের কমদামে রেশন চালু করতে হবে। সারা বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি চলছে। প্রধানমন্ত্রী কৃচ্ছ্রতার স্বাথে যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে রয়েছে। খরচ কমানো, যাতে বিদেশি মুদ্রা বাচে। 

কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সাসপেন্ড করা। তিনি কতিপয় কম প্রয়োজনীয় প্রকল্প স্থগিত রাখার কথা ভাবছেন। প্রাইভেট সেক্টরকেও সাশ্রয়ী হবার কথা বলেছেন। মুসলিম প্রধান দেশে এই সমস্যা বাড়ছে বলেও সতর্ককারীরা বার্তা দিয়েছেন। অর্থনীতিবিদরা, ভালো সরকারি ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়েছেন। তাদের অনেকেই বলেছেন কতিপয় মেগা প্রজেক্ট যেমন ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত রেলওয়ে এবং পায়রা বন্দর, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এবং গুমদুম রেলওয়ে, রূপপর আনবিক শক্তি প্রকল্প, ঢাকা- চট্টগ্রাম- কক্সবাজার বুলেট ট্রেন, দ্বিতীয় আনবিক প্রকল্প, পূর্বাচলে ১১০ ডলার বঙ্গবন্ধু বহুতল ভবন, শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, পাটুরিয়া দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা ব্রিজ, নোয়াখালী এয়ারপোর্ট, দ্বিতীয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট লঞ্চ প্রজেক্ট এবং সেক্রেটারিয়েট ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ার রাজধানী প্রকল্পের কাজ বন্ধ করা প্রয়োজন। 


শেয়ার করুন