১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ০৭:০৩:০৩ পূর্বাহ্ন


সুলতানা কামাল বললেন
আওয়ামী লীগ জামায়াতের ভূমিকা পালন করছে
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৬-২০২৩
আওয়ামী লীগ জামায়াতের ভূমিকা পালন করছে মতবিনিময় সভায় বক্তব্য রাখছেন সুলতানা কামাল


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, বিশিষ্ট মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, শিক্ষাব্যবস্থা আরো পশ্চাৎপদ হয়েছে, বাউলেরা মার খাচ্ছে, সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা পুলিশ প্রশাসন এবং সরকারের চেয়ে কার্যকরভাবে শক্তিশালী হয়েছে। এই অবস্থায় জামায়াত নিষিদ্ধ করা না করায় কিছু যায় আসে না। কারণ আপস করতে করতে আওয়ামী লীগ নিজেই আজ জামায়াতের ভূমিকা পালন করছে। 

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সম্মেলনকক্ষে সম্প্রতি ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৪: ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুর অধিকার’ শীর্ষক মতবিনিময়ে সুলতানা কামাল এসব কথা বলেন। 

সুলতানা কামাল আরো বলেন, রাষ্ট্রকেই আজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, রাষ্ট্র মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায় তো দূরের কথা, অস্তিত্ব নিয়ে তাদের টিকে থাকাই দায় হয়েছে। সত্য বলাও তাদের জন্য আজ বিপদ। তিনি বলেন, ৭৫-পরবর্তী ২০ বছরে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ বড় হয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধীরা যা যা করতে চেয়েছিল, তার সবই নিষ্ঠার সঙ্গে করেছে। আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা ছিল তারা এই অবস্থার পরিবর্তন করবে, রাষ্ট্রকে মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু তারা অন্য কাজে ব্যস্ত থেকেছে, সমাজ বদলানোর প্রকৃত দায়বোধ তারা দেখায়নি। তিনি বলেন, পিছিয়ে রাখা মানুষ, বঞ্চিত মানুষদের জন্য বিশেষ কমিশন করা অবশ্যই দরকার। স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে কেবল জিডিপি, রিজার্ভ, উন্নয়নকে প্রদর্শন করলে চলবে না, সব মানুষের সমান অধিকার নিয়ে রাষ্ট্রে বাস করার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি ড. নিমচন্দ্র ভৌমিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ মতবিনিময় সভার শুরুতে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত সূচনা বক্তব্যে বলেন, একদিকে শঙ্কা, অন্যদিকে অদ্যাবধি দাবি পূরণ না হওয়ায় সংখ্যালঘু জনমনে তীব্র ক্ষোভ, হতাশা বিরাজ করছে, যা সামনের নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে। 

রানা দাশগুপ্ত আরো বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আর মাত্র সাত মাস বাকি। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতোমধ্যে নানান মহল থেকে সংঘাত ও সহিংসতার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হচ্ছে। এতে আমরা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। কারণ বাংলাদেশের স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সর্বস্তরের নির্বাচনের পূর্বাপর আমরা লক্ষ্য করেছি, ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও সামাজিক মহল নানান ছদ্মাবরণে নির্যাতন ও সহিংসতা চালায়। নির্বাচন কমিশনসহ রাজনীতি সংশ্লিষ্ট সব মহলকে অতীতে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও আমরা লক্ষ করেছি, এ ব্যাপারটিকে আমলে নিয়ে কেউ কোনো সময় কোনোভাবে যথাযথ ভূমিকা পালন করেনি।

মতবিনিময় সভায় রানা দাশগুপ্ত দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে সমাজের অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব অংশকে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সবাই হাল ধরুন, সবাই জোট বাঁধুন, আসুন মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সবাই মিলে এগিয়ে যাই।

মতবিনিময় সভায় নাগরিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে বক্তব্য রাখেন-অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী খুশী কবির, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, মফিদুল হক, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, দৈনিক প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক সাংবাদিক সোহরাব হাসান, আইনজ্ঞ ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী শামসুল হুদা, অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইঞা, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রী মাসুদা রেহেনা বেগম, সাংবাদিক ও গবেষক সুভাষ সিংহ রায়, সমাজসেবক ড. বেনেডিক্ট আলো রোজারিও প্রমুখ।

এতে  নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ সরকারি দলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুত সংখ্যালঘু স্বার্থবান্ধব অঙ্গীকারসমূহ আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে বাস্তবায়নে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়ে বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ধর্মীয় বৈষম্যবিরোধী মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে তারা একাত্ম্য। তারা এ আন্দোলনকে অধিকতর জোরদার করে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর জোর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আগামী নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের কৌশলগত অবস্থান নিতে হবে। এককভাবে কোন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে ঐক্য না করে নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট যে শক্তি তাদের সুরক্ষা দিতে পারবে সেখানে তাকেই নির্বাচিত করতে হবে। ৯ শতাংশ ভোট নিয়ে অসহায়ের মতো কথা বললে চলবে না। অধিকার প্রতিষ্ঠায় জোরালোভাবে কথা বলতে হবে। সার্বভৌম কণ্ঠস্বরে সোচ্চার হতে হবে।

শাহরিয়ার কবির বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রধান ভুক্তভোগী ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। আমরা দেখলাম, কুমিল্লায় মন্দিরে কোরআন শরীফ রেখে দেশব্যাপী সহিংসতা সৃষ্টির কারিগর ইকবালকে মাত্র ১৬ মাস কারাদ- দেওয়া হলো। অথচ রংপুরে টিটু রায়কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হলো। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনের আগেই গত নির্বাচনের ইশতেহারে সংখ্যালঘুদের দেওয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে হবে।

রামেন্দু মজুমদার বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ আগের চেয়ে দশগুণ সাম্প্রদায়িক হয়েছে। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হলো সাম্প্রদায়িকতার সামাজিকীকরণ হয়ে গেছে। আগামী নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা রোধে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার হলে নির্বাচন কমিশনকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মকে আদর্শ ও চিন্তায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে পারলে নতুন সমাজ গঠন সম্ভব।

মানবাধিকার নেত্রী খুশী কবির বলেন, বাংলাদেশ কার্যত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হয়ে গেছে। 

ডা. সারোয়ার আলী বলেন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ যে দাবি করছে তা মুক্তিযুদ্ধের ধারা প্রতিষ্ঠারই আন্দোলন। 

মফিদুল হক বলেন, ধর্মীয় সত্তার ওপর আক্রমণ কার্যত জাতি ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের অংশ।

সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য প্রথমেই আইনের শাসন দরকার। অথচ রাষ্ট্রে আইনের শাসন নেই, গণতন্ত্র নেই, ভিন্নমত নেই। 

শামসুল হুদা বলেন, ঐক্য পরিষদের উত্থাপিত দাবিগুলো আগামী নির্বাচনের আগেই পূরণ করা সম্ভব। সরকারের এখনো সাত মাস মেয়াদ আছে। যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকে তাহলে এই সময়ের মধ্যে তাদের অঙ্গীকারের অন্তত ৭০ শতাংশ পূরণ করা সম্ভব। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে রাষ্ট্রধর্ম প্রত্যাহার হতেই হবে। 

অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, স্বাধীন রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুর বিপন্নতা বেড়েছে, মুক্তবুদ্ধির মানুষের বিষণœতা বেড়েছে।

ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মসনদে মানবিক মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ছিল। রাষ্ট্রধর্মের মধ্য দিয়ে এ অঙ্গীকারের সঙ্গে আপোস করা হয়েছে। 

সুভাষ সিংহ রায় বলেন, অধিকারবোধ এবং সার্বভৌম কণ্ঠস্বর আজ খুবই জরুরি। নাহলে রাষ্ট্রের ভয়াবহ বিপর্যয় হবে।

শেয়ার করুন