২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৬:৩৭:৩৯ পূর্বাহ্ন


অর্থবহ স্বাধীনতাই জন আকাংখার প্রতিভু
এস এম মোজাম্মেল হক
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৩-২০২২
অর্থবহ স্বাধীনতাই  জন আকাংখার  প্রতিভু



স্বাধীনসত্তা নিয়ে জন্ম হয় বলেই স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার তবুও নানাবিধ কারণে স্বাধীনতা ভোগের সে অধিকার খর্ব হয়ে থাকে। স্বাধীনতার সাথে গণতন্ত্রের সম্পর্ক অতি নিবিড়। স্বাধীনতার মূল বিষয় হলো দায়িত্ববোধের সাথে নিজের অধিকার ভোগ করা। স্বাধীনতা রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের প্রাপ্য অধিকারের নিশ্চয়তা বিবেচনা করা হলেও স্বাধীনতা পরিবার থেকে শুরু করেরাষ্ট্র সমাজ, এমনকি জীবনের সকল ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শাসক এবং শাসিতের মধ্যে যেমন স্বাধীনতার সম্পর্ক কাম্য, তেমনি পরিবার সমাজ অফিস আদালত সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার গুরুত্ব সমানভাবে প্রযোজ্য।

ওপরে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের নিকট থেকে তার অধীন লোকজন সহমর্মী, মানবিক ও ন্যায়ানুগ আচরণ থেকে বঞ্চিত হলে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও প্রাপ্যস্বাধীনতা ভোগ থেকে তারা বঞ্চিত হতে বাধ্য। এরূপ আচরণ স্বল্প পরিসরে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ঘটে বলে তেমন প্রচার পায় না, কিন্তু এটিও স্বাধীনতা বিকাশের পথে মস্ত বড় অন্তরায়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অধস্তনের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন অনেক সময় অধস্তনকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কথা কালে-ভদ্রে শোনা যায়। তাই বিষয়টিকে আরো আধুনিকায়ন  ও ভারসাম্যপূর্ণ করা যায় কিনা ভেবে দেখার সময় এসেছে। যে কোনো দেশে সুশাসনের জন্য সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আইনের প্রয়োজন ততোধিক। এতদসত্ত্বেও স্বাধীনতার এতো বছর পরেও শতাব্দী প্রাচীন বহু আইন এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে, সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে যার আধুনিকায়ন সময়ের দাবি। অন্যথায় স্বেচ্ছাচারী লোকজনের হাতে আইনের দুর্বল দিকের অপব্যবহারের কারণে প্রতিকারে অক্ষম লোকজন ভোগান্তির শিকার হতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে মানুষ বিভিন্ন পর্যায়ে পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে প্রকারান্তরে অনেকটা দাসত্বের পর্যায়ে সীমাহীন কষ্টভোগে বাধ্য হতে পারে, যার প্রতিকার রাষ্ট্র কর্তৃক জনগণের অধিকার বৈকি! স্বাধীনতা কেবল একটি শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, স্বাধীনতার ব্যাপ্তি জীবনের সকল পর্যায়ে ন্যায্যতা ও সুখানুভূতিসম্পন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডনির্ভর হওয়া বাঞ্ছনীয়। স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা ও তা লাভের ফলে অর্জিত বিজয় উভয়ই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। 

স্বাধীনতা কোনো কেতাবি মন্ত্র বা ছেলের হাতের মোয়া নয় যে, চাইলেই অনায়াসে পাওয়া যায়। স্বাধীনতা লাভ করা ও দায়িত্বশীলতার সাথে ভোগ করা একটি বহুপক্ষীয় কার্যক্রম, অব্যাহত চর্চার মাধ্যমে যা পরিপুষ্ট হয়। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা লাভ সবসময় আপস-মীমাংসার মাধ্যমে সংঘটিত হবার নজির খুবই কম। আবার বহু ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা সবসময় জনআকাক্সক্ষা পূরণে সফল বহু স্বাধীন দেশেই এমন চিত্র সবসময় লক্ষ করা যায় না। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত আইনকানুন যথাসম্ভব জনবান্ধব হওয়া ও রাষ্ট্রপরিচালনায় মানবিক গুণাবলির প্রয়োগ। শাসক এবং শাসিত উভয়ের সম্মিলনে একটি রাষ্ট্রের বুনিয়াদ, যা কোনো একপক্ষের সদিচ্ছায় সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে না, এজন্য প্রয়োজন উভয় পক্ষের আন্তরিকতা। এর ব্যত্যয় ঘটলে পুরা রাষ্ট্রব্যবস্থায় নেমে আসে অশান্তি, যার কুফল শাসক শাসিত উভয়কেই ভোগ করতে হয়। মনে রাখা দরকার কিছু সময়ের সুখ-সমৃদ্ধির আশায় নিয়মবহির্ভূত অসাধু উপায় অবলম্বন করা কখনোই দীর্ঘমেয়াদের জন্য মঙ্গলজনক নয়। ইতিহাসের পরতে পরতে যার প্রমাণ পরিলক্ষিত। সুতরাং ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে ন্যায্যতানির্ভর জীবনাচার অবলম্বন দীর্ঘস্থায়ী সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। 

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে কর্মসংস্থান, ব্যবসা বা অন্য বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে যেমন অস্থায়ীভাবে গমন ও বসবাস করে থাকেন, তেমনি অভিবাসন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসে ব্রতী হন। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় যারা ভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন, জন্মভূমির প্রতি মমতা নিজ দেশে বসবাসকারী ব্যক্তিদের চেয়ে তাদের মোটেও কম নয়। তাছাড়া তাদের বহু আত্মীয়-স্বজন নিজ দেশে বসবাস করার কারণে তাদের প্রতিও তাদের প্রচণ্ড টান ও সহমর্মিতা বিদ্যমান। ফলে উভয় দেশের প্রতিই তারা দায়িত্বশীল ও হৃদয়বান। দেশের আর্থিক বুনিয়াদ রচনায় দেশে বসবাসকারী ব্যক্তিদের যেমন অবদান রয়েছে বিদেশে অবস্থানকারীদের ভূমিকাও কোনো অংশে কম নয়, বরং বৈদেশিক মুদ্রার জোগানদার হিসেবে তাদের অবদান সর্বাধিক। উভয় দেশের প্রতি তারা সমান প্রতিশ্রুতিশীল থাকায় আমেরিকার ক্যাপিটল ভবনে হামলার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি কুঠারাঘাতে তারা যেমন মর্মাহত হয়, নিজ দেশে কোনো অনিয়মের কারণে জনদুর্ভোগেও তারা সমানভাবে ব্যথিত হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণই রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি এটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলমন্ত্র। তার ওপর ভিত্তি করে বহু আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে স্বাধীনতার জন্য এক নদী রক্ত বিসর্জন এবং বহু জীবন বলিদানের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার মূল আকাক্সক্ষা ছিল সমাজে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা তথা, রাষ্ট্র কর্তৃক ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্ত সম্মান ও নাগরিক হিসেবে সমমর্যাদার নিশ্চয়তা, ভোটাধিকারের সুষ্ঠু প্রয়োগ, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা। শিক্ষা, চিকিৎসা ও অপরাপর সরকারি আনুকূল্যের যথাযথ নিরপেক্ষ প্রয়োগ। সরকারি সম্পদের সুষম বণ্টন হোক তা সরকারি সাহায্য বা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্পর্কিত ব্যয়, যা একটি কল্যাণরাষ্ট্রের মূল প্রতিপাদ্য। এর বাস্তবায়ন ব্যতীত মুখে কল্যাণরাষ্ট্র বললেই কোনো রাষ্ট্র কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হয় না, রাষ্ট্রকে কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য জনকল্যাণে সম্ভাব্য সকল কল্যাণকর (উপাদান) সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। গত পঞ্চাশ বছরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কর্তৃক দেশ শাসিত হয়েছে ফলে এই পঞ্চাশ বছরেদেশের জনগণ স্বাধীনতার প্রতিশ্রুত ফলাফল কতটুকু ভোগ করতে পেরেছে, তা যেমন জনগণের মূল্যায়নের বিষয়, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদেরও আত্মোপলব্ধির বিষয়। এ বিষয়ে উভয়পক্ষের নিরপেক্ষভাবে একমত হবার কোনো বিকল্প নেই।  যত তাড়াতাড়ি এটা অর্জিত হবে দেশ জাতি ও সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য ততোই মঙ্গল। 


লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক 

জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক 


শেয়ার করুন