১৯ এপ্রিল ২০১২, শুক্রবার, ১০:৩৪:২৮ অপরাহ্ন


২০২২-এর ঢাকা : একটি পর্যবেক্ষণ
কাজী জহিরুল ইসলাম
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৩-২০২২
২০২২-এর ঢাকা : একটি পর্যবেক্ষণ


সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটি কৌতুক  পড়লাম। কৌতুকটি পাঠিয়েছেন আমাদের নিউইয়র্ক-প্রবাসী বন্ধু শহীদ উদ্দিন, তিনি মন্দিরা বাজান বলে আমরা তাকে মন্দিরা শহীদও বলে থাকি। কৌতুকটি হচ্ছে, অফিসের বড়োকর্তা গল্প করছেন, অধস্তনেরা সব আনন্দে হেসে কুটিকুটি। কিন্তু একজন নারী সহকর্মী কিছুতেই হাসছেন না, তিনি চুপচাপ বসে আছেন। বড়োকর্তা অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার, আপনি হাসছেন না যে? তিনি মুখের স্বাভাবিক গাম্ভীর্য ঠিক রেখেই জবাব দেন, হাসিটা আমি আর কাজে লাগাতে পারবো না স্যার, কাল থেকে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। 

সমাজের সর্বত্রই এরকম কৃত্রিম হাসি, কৃত্রিম আচরণ, কৃত্রিম রাজনীতি-সমর্থন চোখে পড়ে। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে ঢাকায় এসেছি। একজন মানুষকে অনেকদিন পর দেখলে যেমন তার শারীরিক পরিবর্তনগুলো সহজেই চোখে পড়ে, একটি ভূখণ্ডেও অনেকদিন পর পা রাখলে সেই ভূখণ্ডের বাহ্যিক পরিবর্তনগুলো সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়ে। ট্রাফিক জ্যাম, মশা, ধুলোবালি, পথচারিদের হুড়োহুড়ি ঢাকা শহরে কবে না ছিল? খুব সহজেই নতুন যা চোখে পড়ে তা হচ্ছে সারা শহর জুড়ে এলিভেটেড রাস্তা নির্মাণের ম্যাসিভ কনস্ট্র্রাকশন। এতে জনদুর্ভোগ হচ্ছে বটে তবে এই নির্মাণকাজগুলো সম্পন্ন হলে শহরের অভ্যন্তরঢু সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি  হবে, শহরবাসী উপকৃত হবে। আমি মনে করি এটি একটি দরকারী, সাহসী এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ।

ইন্টারনেটের সুফল এখন বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জেও পৌঁছে গেছে। গাজীপুরের মাওনায় আমাদের একটি বাগানবাড়ি আছে। বৃক্ষশোভিত সেই বাড়িটিতে গেলে আমরা বেশ প্রশান্তি অনুভব করি। বাড়ির নাম কাজীর গাঁ। এই বাড়ি থেকে ঘুরে এসে কবি কাজী রোজী একটি দৈনিক পত্রিকায় দীর্ঘ কলাম লিখেছিলেন। 

গত শুক্রবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, বেশ সকাল সকাল পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। রাজেন্দ্রপুর চৌরাস্তায় যাত্রাবিরতি নিই। বেশ চালু এবং পরিচ্ছন্ন একটি রেস্টুরেন্ট খুঁজে আমরা প্রাতঃরাশের টেবিলে বসি। খেতে খেতে ঠিক করি পথেই তো নূহাশ পল্লী একটু দেখে যাই। আম্মা এবং টুশি খুব আগ্রহ দেখালেন। আমিও ভাবলাম হুমায়ূন আহমেদের কবরটা দেখে যাই, তার জন্য একটু দোয়া করে যাই। জীবদ্দশায় একটি ছেলেমানুষী অভিমান থেকে ১৯৯৪ সালের পর আর তার সঙ্গে দেখা করিনি। কিন্তু তার ক্যানসারের খবর শোনার পর থেকেই মন কেঁদেছে। 

আমরা বোধহয় পথ হারিয়ে ফেলেছি। গাড়ির চালক লিটনকে বলি, এলোমেলো না ছুটে কাউকে জিজ্ঞেস করো। লিটন একটি গ্রাম্য চায়ের দোকানে গাড়ি থামায়। দীর্ঘ শুভ্র শশ্রুমণ্ডিত বৃদ্ধ চা-বিক্রেতা গাড়ি দেখে তার টঙ দোকান থেকে নেমে আসেন। তাকে আমরা জিজ্ঞেস করি, নূহাশ পল্লী যাবো কীভাবে? তিনি হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলেন বটে, তবে আমাদের ওপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, নেটে সার্চ দেন। আমার মনে হচ্ছে নেটের সুফলের কথা শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল বাংলাদেশির কাছেই পৌঁছে গেছে। সামান্য পড়তে পারেন, এমন গৃহিণীকেও দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সরব। এটি একটি বড়ো ধরনের পরিবর্তন এবং এই পরিবর্তন পরিশ্রমী মানুষের ভাগ্য বদলে দেবে, বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নেবে। 

আমাদের খাদ্য সংস্কৃতিতে কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে। নানান দেশের খাবার পাওয়া যায় এমন রেস্টুরেন্ট শহরের অভিজাত এলাকাগুলোতে সব সময়ই ছিল, এখন একটু বেশি আছে। এইসব রেস্টুরেন্ট একটি দেশের খাদ্য-সংস্কৃতিতে খুব দ্রুত কোনো পরিবর্তন ঘটায় না, ঘটায় খুব ধীরে ধীরে। কিন্তু যখন ভিনদেশি খাবার ও পানীয় সুলভ রেস্টুরেন্টগুলোতে পাওয়া যায় তখন খুব দ্রুতই খাদ্য-সংস্কৃতি বদলে যেতে থাকে। বাংলাদেশের সর্বত্রই এখন কফি পাওয়া যায়, প্রায় সব খাবারের দোকানেই লুচি পাওয়া যায়, দোসা পাওয়া যায়। চায়ের বদলে কফি, পরোটার বদলে লুচি, ভাতের বদলে দোসা ঢাকার তো বটেই, অন্য শহরগুলোর খাদ্য ও পানীয় সংস্কৃতিতে একটি বড়ো পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া দহি ফুচকা, ভেলপুরি, পানিপুরি, চাপ, গ্রিল, চিকেন নাগেট, বার্গার, পিজা মিলছে বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট ও ফাস্ট ফুডের দোকানে। বইমেলায় দেখি মাটির ভাঁড়ে চা পরিবেশন করছে চা-ওয়ালা। 

ঢাকা শহরে প্রচুর সুপার মার্কেট হয়েছে, প্রচুর অভিজাত কফিশপ হয়েছে। দুদিন দুটো অভিজাত কফিশপে আমাকে নিয়ে গেলেন বহুমাত্রিক এবং বহুপ্রজ লেখক হাসনাত আবদুল হাই। এই কফিশপগুলোতে বসে থাকলে মনেই হয় না, আমি ঢাকায় আছি। পৃথিবীর যে কোনো উন্নত শহরের একটি কফিশপের সকল খাবার, পানীয় এবং সেবাই এখানে পাওয়া যায়। ক্রোসান্ট, স্যান্ডুইচ, মাফিন, এস্প্রেসো, কাপুচিনো, আমেরিকানো কী নেই। 

কর্মজীবী মেয়েদের দেখেছি পাঠাওয়ের বাইকে পুরুষ চালকের পেছনে স্বাচ্ছন্দ্যে দু’পাশে দু’পা রেখে উঠে বসছেন, কাজে যাচ্ছেন। এটি খুব বড়ো একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।

এখন বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের বেতন কাঠামোর মধ্যে বেশ ভালো একটি ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীরা সৎ জীবনযাপন করার মতো যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেন। আমার স্মার্ট আইডি কার্ড তোলার জন্য নিকটস্থ নির্বাচন অফিসে গেলাম। নির্বাচন কর্মকর্তার অফিসকক্ষে ঢুকে নিজের পরিচয় দিতেই তিনি বসতে বললেন। দু’মিনিটের মাথায় এক দশাসই লোক দুজন সঙ্গীসহ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন। তার হম্বিতম্বি দেখে আমি দ্রুত (এবং ভয়ে) হাত বাড়িয়ে নিজের নাম বললাম। তিনিও বেশ গর্বিত ভঙ্গিতে নিজের পরিচয় দিলেন, আমি আমির হোসেন বাবুল, জাতীয় ফুটবল দলের ম্যানেজার। মনে হলো লোকটি স্থানীয় এবং নির্বাচন কর্মকর্তার পূর্ব-পরিচিত। তিনি একটি খাম নির্বাচন কর্মকর্তার টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দিতে চাইলে কর্মকর্তা লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, করেন কী, করেন কী! লোকটি হয়তো তখন বুঝলেন কাজটি আমার সামনে করা উচিত হচ্ছে না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘এইখানে কিছু কাগজ আছে, আপনার লাগবে, কাজটা করার জন্য আপনার কাগজ লাগবে না? নইলে করবেন কেমনে?’। আমার কাছে কেন যেন মনে হলো, অনেকেই সৎ জীবনযাপন করতে চাইছেন, কিন্তু এতো অনায়াসে এই দেশে অবৈধ অর্থ চলে আসে তখন নিজেকে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমি যখন আমার মেয়াদোত্তীর্ণ টেম্পোরারি আইডি নির্বাচন কর্মকর্তার হাতে তুলে দিলাম, তিনি তা তার পিয়ন বা সহকারীকে দেবার জন্য অস্থির হয়ে কলিংবেল খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও কলিংবেল খুঁজে পাচ্ছিলেন না এবং অপ্রস্তুতভাবে এখানে-সেখানে হাতড়াচ্ছিলেন আর মুখে বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। এই সময়টাতে আমি তার ভেতরটা পড়ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার স্মার্টকার্ড চলে এলো। উঠতে উঠতে তাকে আমার একটি বই উপহার দিলাম এবং বললাম, ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ধারণাটি ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে আমিই প্রথম একটি দৈনিকের কলামে লিখি। লোকটি তখন বেশ উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন, কী বলেন আপনি, এটি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের আন্দোলন-সংগ্রামের ফসল। বুঝলাম লোকটি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করে নিজের শক্ত অবস্থানের কথা আমাকে জানাচ্ছেন। পাশাপাশি এ-ও ভাবছিলাম, এতো সামান্য ক্রেডিটও প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয়?

কৃত্রিম হাসির কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। কৃত্রিম আচরণের কথা দিয়ে শেষ করি। বাংলাদেশের মানুষ এখন দুই ধরনের ভাইরাসের আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে মুখোশ পরে। করোনার ভয়ে যে মুখোশ পরে তা দেখা যায়। অন্য একটি ভাইরাল-সন্ত্রাসের হাত থেকে বাঁচার জন্য এখন দেশের প্রায় সকলেই বেশ কিছু রাজনৈতিক মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। মুখোশগুলো হচ্ছে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ হাসিনা। নিজের নিরাপত্তার জন্য এই মুখোশগুলো পরে চলাফেরা করতে হয়। বসন্তের উতল হাওয়ায় কখনো মুখোশ খসে পড়লে এক ঝলকের জন্য তাদের প্রকৃত মুখ দেখা যায়। সেই মুখে দাহকালের আতঙ্ক। 

প্রকৃত দেশপ্রেমিক, বঙ্গবন্ধু-প্রেমিক বা আওয়ামী লীগ-প্রেমিকের সংখ্যা খুবই কম। ভয়ে, আতঙ্কে কিংবা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় তারা এসব মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। করোনা চলে যাবে, কিন্তু মুখোশ পরার অভ্যাস আমাদের অনেকেরই থেকে যাবে, অনেকেই আমৃত্যু মুখোশ পরে রাখবেন। মুখোশ আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠছে। হয়ত দূরের পৃথিবীতে মানুষের প্রকৃত মুখ আমরা খুব কমই দেখতে পাবো। 


ঢাকা। ২ মার্চ ২০২২।


শেয়ার করুন