২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৩:৫০:১৯ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম :
‘শেরে বাংলা আপাদমস্তক একজন পারফেক্ট বাঙালি ছিলেন’ বিএনপির বহিস্কৃতদের জন্য সুখবর! মে দিবসে নয়পল্টনে বিএনপির শ্রমিক সমাবেশ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেয়ার জের, বিএনপির বহিস্কার ৭৬ থাইল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আহ্বান ‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়


বাস পরিবহন খাত চলছে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসব
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৩-২০২৪
বাস পরিবহন খাত চলছে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসব


বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন খাত আপাদমস্তক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। “ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও সিন্ডিকেট এই খাতকে জিম্মি করে রেখেছে, ক্ষেত্রবিশেষে এই আঁতাতের সামনে সরকারও ক্ষমতাহীন হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় শুদ্ধাচার নিশ্চিতে ১৫ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।

বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মূলে থাকা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও সিন্ডিকেটের ভূমিকা উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন খাত আপাদমস্তক অনিয়ম দুর্নীতিতে জর্জরিত। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় বলীয়ান মালিক ও শ্রমিকদের সংগঠনের আঁতাত। গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের মালিক ও পরিচালনা পর্ষদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে, ৮০ শতাংশ ক্ষমতাসীন দল ও বাকি ১২ শতাংশ অন্যান্য দলের। এর ফলে এই জনগুরুত্বপূর্ণ খাতটি যাত্রীবান্ধব গণপরিহন হয়ে উঠবে এমন প্রত্যাশা থাকলেও, বাস্তবে তা জিম্মি হয়ে গেছে এসব মালিক শ্রমিকদের সংগঠনের কাছে। আর এই জিম্মিদশার সুযোগ নিয়ে অনৈতিক সুবিধা ভোগ করছে সিন্ডিকেট। এই জিম্মি দশা এতটাই প্রকট যে মালিক-শ্রমিকের আতাতের কারণে তাদের আচরণ অবস্থাদৃষ্টে সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হিসেবে মনে হয়। ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে সরকার তার নিজের প্রণীত আইন ও নিয়মনীতি বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না। প্রত্যাশিত সেবাও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না, একইসঙ্গে এ খাতের সাধারণ শ্রমিকরাও তাদের মৌলিক অধিকারসহ ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’ 

পরিবহন খাতের সংশ্লিষ্টদের ভূমিকার সমালোচনা করে ড. জামান বলেন, ‘বাস পরিবহন ব্যবসায় বিভিন্ন আঙ্গিকে চাঁদাবাজি ও অবৈধ লেনদেনের ঘটনা ঘটে। এ সকল ক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশন, হাইওয়ে পুলিশ, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের যোগসাজস রয়েছে। বিআরটিএ তার নির্ধারিত ভূমিকা পালন করতে স্পষ্টতই ব্যর্থ হয়েছে, যাত্রী সেবার ব্যর্থতা ঢাকতে লোকবল সংকটকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিআরটিএ-এর অনিয়ম-দুর্নীতি ও অবৈধ লেনদেন-এর সবই চলছে যোগসাযোশের মাধ্যমে। অবস্থা প্রকটতর হয়ে ওঠার কারণ হচ্ছে, এই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থনৈতিক লাভের অংশীদার কম-বেশি সংশ্লিষ্ট সকলে। এ খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সকলকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে আহ্বান জানাই আমরা। কারণ, দুর্নীতি অনিয়ন্ত্রিত থাকলে তা আরো বিকশিত হয়।’

টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়, বাস পরিবহন খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির মহোৎসবের কেন্দ্রে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থনপুষ্টদের দ্বারা পরিবহন ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। মালিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের অধিকাংশ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত। জরিপে অংশগ্রহণকারী ২২টি (১৩.১ শতাংশ) কোম্পানির কাছে ৮১.৪ শতাংশ বাসের মালিকানা রয়েছে এবং এ সকল বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যগণের সাথে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল (৮০ শতাংশ) এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের (১২ শতাংশ) প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা মালিক ও শ্রমিক সংগঠনে একচেটিয়া ক্ষমতা চর্চার পাশাপাশি নীতি করায়ত্ব করার মাধ্যমে আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা তৈরির মাধ্যমে খাতটিকে জিম্মি করে রেখেছেন।

বাস পরিবহনে অনিয়ম ও দুর্নীতির আরো প্রকট উদাহরণ হলো, জরিপে অংশগ্রহণকারী কর্মী/শ্রমিকদের ৪০.৯ শতাংশের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে। ২৪ শতাংশ কর্মী/শ্রমিকের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কোনো না কোনো বাসের ফিটনেস সনদ নেই এবং ২২ শতাংশ বলেছেন বাসের রুট পারমিট নেই। তাছাড়া, ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসে পেশাদার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও লাইসেন্সধারী চালকের সংকট আছে। এছাড়া জরিপে অংশগ্রহণকারী ১১.৯ শতাংশ বাস মালিক জানান তাদের কোম্পানিতে এক বা একাধিক পেশাদার লাইসেন্সবিহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্সধারী চালক আছে। জরিপের ২২.২ শতাংশ কর্মী/শ্রমিকের তথ্যানুযায়ী মদ্যপান বা নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালক গাড়ি চালান এবং কন্ডাক্টর/হেলপার/সুপারভাইজার বাসে দায়িত্ব পালন করেন। তা ছাড়া চলন্ত বাসে চালকেরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে, ফলে অনেকসময় প্রাণহানিসহ দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

বাস পরিবহনে অনিয়মের উদাহরণের মধ্যে আরো রয়েছে প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, অতিরিক্ত আসন সংযোজন, নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ইত্যাদি। জরিপে অংশগ্রহণকারী সিটি সার্ভিসের ৮৯.২ শতাংশ এবং আন্তঃজেলার ৬০.৪ শতাংশ কর্মী/শ্রমিকের মতে, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পনির বাসে নিয়ম অনুযায়ী টায়ার, ইঞ্জিন ওয়েল, ব্রেক সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি ইত্যাদি পরিবর্তন ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। বাসের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত না করায় তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির গাড়ি সড়ক পথে কালো ধোঁয়া নির্গমন বা নিঃসরণ করে। অনেকক্ষেত্রে বাস মালিকরা নকশা পরিবর্তন করে বাসে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করে যাত্রী পরিবহন করে থাকে। সিটি সার্ভিসের কর্মী/শ্রমিকদের ৪০.৪ শতাংশ বলেছেন, তাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির গাড়িতে নকশা পরিবর্তন করে অতিরিক্ত আসন সংযোজন করা হয়েছে। বাস পরিবহন ব্যবস্থায় আরেক উদ্বেগজনক চিত্র হলো হিসেবে উঠে এসেছে জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩৫.২ শতাংশ নারী বাসযাত্রী যাত্রাপথে কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বা হতে দেখেছেন, এ হার আন্তঃজেলা (দূরপাল্লা ও আঞ্চলিক) বাসের ক্ষেত্রে ৩১.৩ শতাংশ এবং সিটি সার্ভিসের ক্ষেত্রে ৪২.৬ শতাংশ। যৌন হয়রানির শিকার নারীদের মধ্যে ৮৩.২ শতাংশ সহযাত্রী এবং ৬৪.৩ শতাংশ হেলপার দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। গবেষণায় আরো দেখা যাচ্ছে, বছরে প্রায় ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ হিসেবে দিতে বাধ্য হন বাস মালিক ও কর্মী/শ্রমিকরা। এর মধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকা দলীয় পরিচয়ে সড়কে চাঁদাবাজি হয় বলে উঠে এসেছে গবেষণায়। এছাড়া রাজনৈতিক সমাবেশ, বিভিন্ন দিবস পালন, টার্মিনালের বাইরে (রাস্তায়) পার্কিং এবং সড়কের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও ‘টোকেন বাণিজ্যে’র জন্য বাস মালিক ও কর্মী/শ্রমিকরা চাঁদা বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ দেয় বা দিতে বাধ্য হয় বাস মালিক। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো অংশ হলো নিবন্ধন ও সনদ গ্রহণ ও হালনাগাদ বাবদ ঘুষ, বাস মালিক-শ্রমিকদের বিআরটিএকে বছরে ঘুষ দিতে হয় ৯০০ কোটি টাকার বেশি। টিআইবি আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন রিসার্চ ফেলো ফারহানা রহমান, মোহাম্মদ নূরে আলম এবং রিসার্চ এসোসিয়েট মুহাঃ নূরুজ্জামান ফরহাদ।

গবেষণার ভিত্তিতে টিআইবি ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবসায় সুশাসন নিশ্চিতে ১৫ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, সকল বাস কোম্পানিগুলোকে অনানুষ্ঠানিক নিয়োগ বন্ধ করে শ্রম আইন, ২০০৬ অনুযায়ী কর্মী/শ্রমিকদের নিয়োগপত্র প্রদান; প্রয়োজনীয় নীতিমালা (অর্থ ও প্রশাসন, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, জেন্ডার, অভিযোগ গ্রহণ ও নিরসন, তথ্য উন্মুক্তকরণ, ক্রয়, টিকেট ইত্যাদি সংক্রান্ত) প্রণয়ন এবং তা তদারকির আওতায় আনা; জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, বিশেষ করে মালিক ও কর্মী/শ্রমিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্টকরণসহ নৈতিক আচরণবিধি প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা; সকল প্রকার প্রভাবমুক্ত হয়ে সড়ক পরিবহণ আইন, ২০১৮-এর পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদি।

শেয়ার করুন