২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৭:১৬:১৭ অপরাহ্ন


২৫ বছর পর কানাডা থেকে ফেরত পাঠানো হলো মাহফুজ আলমকে
কানাডা প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০৬-২০২২
২৫ বছর পর কানাডা থেকে ফেরত পাঠানো হলো মাহফুজ আলমকে নাতিদের সাথে মাহফুজ আলম


দীর্ঘ ২৫ বছর পর কানাডা থেকে গত ২৭ মে শুক্রবার দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে মোহাম্মদ মাহফুজ আলম (৬১) নামের এক বাংলাদেশিকে। তাকে ফেলে আসতে হচ্ছে নিজের ছেলে ও নাতিদের। ১৯৯৬ সালে দেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি পালিয়ে যান কানাডায়। সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। দেশে রেখে যান স্ত্রী ও দুই সন্তানকে। আশা ছিল একদিন তারাও তার সঙ্গে যোগ দেবেন। কিন্তু পরে তার আশ্রয়ের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়। তারপর থেকে গত ২৫টি বছর তিনি কানাডায়ই কাটিয়ে দেন। দেশে ছেলে ও মেয়ে যাতে সুশিা গ্রহণ করতে পারে সে জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। এমনকি সেখানে একটি ভালো বাড়িও ক্রয় করেন। আশা ছিল একদিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেখানে বসবাস করবেন। 

তার ছেলে শাহেদ ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর দ অভিবাসী হিসেবে ২০১৫ সালে কানাডায় পাড়ি জমান। পিতার সঙ্গে মিলিত হন তিনি। সেখানেই সংসার পাতেন শাহেদ। তারও সন্তানসন্ততি হয়। দাদা হন মাহফুজ আলম। কিন্তু তাদের সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য আর হয়নি মাহফুজের। 

জানা গেছে, বছরের পর বছর কানাডার বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সির কাছে প্রতি মাসের তৃতীয় বুধবার রিপোর্ট করেছেন মাহফুজ আলম। কখনো সেটা ফোনে, আবার কখনো ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে কর্মকর্তাদের নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি অদৃশ্য হয়ে যাননি। যদিও কারো আশ্রয়ের প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান হওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব তাকে তার দেশে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু আপিল প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তিবিশেষের ভ্রমণ সংক্রান্ত ডকুমেন্টের অভাব থাকার কারণে তাদেরকে ফেরত পাঠাতে কয়েক বছর লেগে যায়। এই সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সেখানে কাজ করতে পারেন। ট্যাক্স দিতে পারেন। স্থানীয় নাগরিকরা যেমনভাবে বসবাস করেন, তিনি সেভাবে বসবাসও করতে পারেন। 

গত নভেম্বরে মাহফুজ আলম ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে সাাৎকার দিতে ব্যর্থ হন। ফলে বর্ডার গার্ড কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ৭ মে তাকে গ্রেফতারে করেন তারা। তারপর যা হবার তাই হচ্ছে। তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হলো। 

তার ছেলে শাহেদ স্থানীয়ভাবে একটি ওয়ারহাউজের সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তিনি বলেন, কর্তৃপ বাবাকে কানাডায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত হতে অনুমোদন দিয়েছে। এ সময়ে কানাডায় তিনি সব কিছু ত্যাগ করে অবস্থান করেছেন। অবদান রেখেছেন। তার কাছ থেকে ট্যাক্স নেয়া হয়েছে। তার শ্রমকে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এখন দ্রুততার সঙ্গে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হলো। আমাদের কাছে এর কোনো অর্থ নেই। 

বর্ডার এজেন্সির রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৭ সালেই মাহফুজ আলমের আশ্রয়ের আবেদন খারিজ করে দেয়া হয়। তারপর আপিল শুনানি শেষ হয় ২০০০ সালে। কিন্তু ২০০৯ সাল পর্যন্ত নয় বছরে আর তেমন কিছু হয়নি। তাকে কানাডা থেকে বের করে দেয়ার জন্য নির্ধারিত এক সাাৎকারে ডাকা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য পাসপোর্টের আবেদন করতে। ২০১২ সালে মাহফুজ আলমের মনে হয় বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া তার জন্য এখন অনেকটাই নিরাপদ। কিন্তু এ জন্য তার প্রয়োজন একটি জন্ম সনদ। আবার ২০১৬ সালে তাকে সাাৎকারে ডাকা হয়। ২০১৮ সালে তার ভ্রমণ সংক্রান্ত ডকুমেন্টের ফলোআপের জন্য ডাকা হয়। গত আগস্টে তিনি আবার সাাৎকার দিতে উপস্থিত হন। তাকে বলা হয় ভ্রমণ সংক্রান্ত ডকুমেন্টের জন্য আবেদন করতে। নভেম্বরের সাাৎকারে উপস্থিত না হওয়ার কারণে তাকে ৭ মে গ্রেফতার করা হয় চারদিন আটকে রাখা হয়। শাহেদের অভিযোগ, তার পিতা বা তাদের পরে আইনজীবী কেউই ২৮ নভেম্বরের সাাৎকারের নোটিফিকেশন পাননি। তবে বর্ডারএজেন্সির নোটিশে বলা হয়েছে, ওই চিঠি পাঠানো হয়েছিল একটি ভুল ঠিকানায়। তা সত্তে¡ও মাহফুজ আলমের ব্যক্তিগত ই-মেইল ঠিকানায় এর একটি কপি পাঠানো হয়েছিল। মাহফুজ আলমের ইমেইলে সেই চিঠির একটি কপি উদ্ধার করেছেন ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা। 

শাহেদ বলেন, যখন আমার বাবাকে গ্রেফতার করা হয়, তখন তিনি কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে তার ফোনে সার্চ করে ওই ই-মেইল বের করে দিতে। তিনি প্রশ্ন রাখেন- যদি তারা ইমেইল করেই থাকতো, তাহলে কেন বাবা তাদেরকে ফোন দিয়ে তা সার্চ করে বের করে দিতে বলবেন? বাবা তো প্রযুক্তির বিষয়ে অতোটা জানেন না। ফলে তিনি ই-মেইল নিয়ে অতো ঘাঁটাঘাঁটি করেন না। 

দেশে অবকাঠামো নির্মাণ সম্পর্কিত সাপ্লাই বিষয়ক স্টোরের মালিক মাহফুজ আলম। বলেছেন, কানাডায় অবস্থানকালে তিনি হোটেলে থালাবাসন মাজার কাজ করেছেন। প্রথমে টরোন্টোতে যাওয়ার পর তিনি কাজ নেন ‘লাইন কুক’-এর। গত ২০ বছর ধরে তিনি একজন মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করছিলেন। বলেছেন, আমি সপ্তাহের প্রতিটি ঘন্টা দেশে পরিবারের জন্য কাজ করেছি। টরন্টোতে তার কেনা বাড়ির প্রসঙ্গে বলেন, ২০০৪ সালে তিন লাখ ডলার দিয়ে এই বাড়িটি কিনেছি, যাতে একদিন আমার পরিবারের সবাই এখানে এসে বসবাস করতে পারে। আশা করেছিলাম হয়তো সামনের বছর তারা আসতে পারবে। আবার পরের বছর একই ভাবনা। কিন্তু তারা আর আসতে পারেনি। 

প্রতি মাসে মাহফুজ আলম যে অর্থ উপার্জন করেছেন তার অর্ধেকটাই বাংলাদেশে পরিবারের সদস্যদের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাকি অর্ধেক দিয়ে বাড়ির মর্টগেজ দিয়েছেন। শাহেদ বলেছেন, বাবার সংস্পর্শ ছাড়া তিনি বড় হয়েছেন। তবে তার জন্য সবই করেছেন তার পিতা। ‘তিনি আমার জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। তিনি যখনই এখানে বাসায় থাকতেন তখনই রান্না করতেন। মজা করে খেতেন। আবার ঘুমাতেন। আমি এখন বাবাকে মিস করবো।


শেয়ার করুন