২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ০৬:৪৯:৪৫ অপরাহ্ন


২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্ধোধন
বিএনপি ঘায়েলে দাওয়াতী সরকার
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৮-০৬-২০২২
বিএনপি ঘায়েলে দাওয়াতী সরকার উদ্ধোধনের অপেক্ষায় পদ্মা সেতু/নিজস্ব ছবি


পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আর বাকি কয়েকটা দিন। বাংলাদেশের জনগণের অহংকারের প্রতীক এ-সেতু । তবে এটি নিয়ে এক দিকে যেমন উচ্ছ্বসিত পদ্মাপাড়ের মানুষ তেমনি জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশ নিয়ে রাজনীতিতে মেতে উঠেছে সরকার ও বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপি। 

সরকারের দাবি, বেকায়দায় বিএনপি

স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে বর্তমান সরকার বেশ সরব এই বলে যে এটি দেশবাসীর হাতে তুলে দিতে পারায় পুরো কৃতিত্ব তাদের। তাছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় অবকাঠামোর বাস্তবায়ন রীতিমতো অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করা হয়েছে এ সরকারের আমলে। বৃহৎ এই প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করে উন্নত বিশ্বকে নিজেদের সামর্থের কড়া বার্তা দিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। আর এর পাশাপাশি স্বপ্নের এই সেতু নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র, বিতর্ক, দুর্নীতির অভিযোগসহ সবকিছুর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দেশে বিদেশে কয়েকজন ব্যক্তি ও সংস্থার পাশাপাশি বিএনপি’কে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, দেদারসে বক্তব্য রাখছে। যদিও এর জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম দাবি করেছেন যে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তÍর স্থাপন করেছেন। 

আর সাথে সাথে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের তার (ফখরুল) কাছে জানতে চেয়ে বলেন, ‘কবে, কখন এ ভিত্তিপ্রস্তরর স্থাপন করেছেন? নব আবিষ্কৃত সেই ভিত্তিপ্রস্তরের ছবি দেখতে চাই বলে জানিয়েছেন। যদিও এর প্রমাণপত্র বিএনপি দেখানোর তাগিদ লক্ষ্য করা যায়নি। তবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে বর্তমান সরকার বেশ সরবই আছেন। কেননা একথা ঠিক যে সব মিথ্যা প্রমাণিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ও দৃপ্ত পদক্ষেপে সেতুকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।  যা সত্যিই বিশ্বের অনেক দেশের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এছাড়া সম্প্রতি বিদেশের গণমাধ্যমেও বেশ কয়েকটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। পাকিস্তানের সর্বাধিক প্রচারিত ‘ডেইলি টাইমস’ পত্রিকায় শেখ হাসিনার প্রশংসা করে পদ্মা সেতুর গল্প নিয়ে এক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষক ড. মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাক তার নিবন্ধে বলেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের মূর্তিমান প্রতীক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মতো বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশাল প্রতিবন্ধকতার পথে তাকে হাঁটতে হয়েছে কিন্তু তিনি তার গন্তব্যে ঠিকই পৌঁছেছেন। সেতুর নির্মাণের সময় যে ষড়যন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছিল তিনি তা দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেও ঔ নিবন্ধে তুলে ধরা হয়। আর এসব ঘটনায় বিএনপি বেশ বেকায়দায় আছে বলে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

কিন্তু হঠ্যাৎ দাওয়াতী কেনো সরকার?

যোগাযোগ ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করতে যাচ্ছে যে স্বপ্নের পদ্মা সেতু তাকে নিয়ে সরকারের যেমন আছে অহংকার তেমনি আছে সুচতুর রাজনৈতিক খেলা। যে খেলায় বিএনপি একপ্রকার ধরাশাহী হয়ে আছে। সরকার কৌশলে সভা সমাবেশে বেশ জোড়েসোড়েই বলে বেড়াচ্ছে, প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে বিএনপি পদ্মা সেতু নির্মাণ বিরোধী একটি দল। আর এর বিপরীতে বিএনপি এক্ষেত্রে খুব একটা পেরে উঠতে পারছে না বলেই রাজনৈতিক মহল মনে করেন। বিএনপি যেনো এক্ষেত্রে বাক-রুদ্ধ হয়ে আছে। 

সেতু নিয়ে সরকারের সুচতুর কৌশলের মধ্যে আরেকটা হলো তাদের দাওয়াতী ভূমিকা। সম্প্রতি মির্জা ফখরুল বলেছেন, মাওয়া ও পদ্মার অপর প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর  স্থাপন করেছেন খালেদা জিয়া। সে প্রসঙ্গ টেনে আওয়ামী নেতা ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন যে ‘মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির নেতারা ইদানীং এমন অনেক দিবাস্বপ্ন দেখছেন। এটিও সেই দিবাস্বপ্নেরই অংশ। পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তুর নিয়ে ফখরুল সাহেবের এ বক্তব্য বছরের সেরা আবিষ্কার। পদ্মা সেতু নিয়ে বিএনপি মিথ্যাচার এবং গুজব রটিয়ে বেড়াচ্ছে বলে সরকার পক্ষের অভিযোগ। অভিযোগ থাকলেও সেতুর উদ্বোধনীতে সব রাজনৈতিক দল দাওয়াত পাবে, পেতে পারেন খালেদা জিয়াও। জানালেন ওবায়দুল কাদের। এর পাশাপাশি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংক কান্ট্রি ডিরেক্টরকেও আমন্ত্রণ জানানো হবে বলে জানান ওবায়দুল কাদের।

 রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন বক্তব্য বেশ রহস্যের জন্ম দেয়। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের থেকে এমন বক্তব্যের পর সাংবাদিকরা জানতে চাইলে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘নিয়মের মধ্যে পড়লে অবশ্যই দেব। এখন উনি তো সাজাপ্রাপ্ত। তারপরও বিএনপি চেয়ারপারসন হিসেবে পাওয়ার কথা। তবে আমরা নিয়ম জেনে (দাওয়াত) দেব।

 বিএনপি’র বিরুদ্ধে এতো বিষোদগারের পরও খোদ দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দাওয়াত দেয়া নিয়ে রাজনীতি এখন বেশ সরব। আবার দেখা গেছে এনিয়ে আইনগত বৈধতার প্রশ্নেও খোদ আইনমন্ত্রীও মুখ খুলে ফেলেছেন তিনি। যেনো সব কিছু আগে ভাগেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় দাওয়াত দিতে আইনি বাঁধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আইনমন্ত্রী জানান, খালেদা জিয়ার ব্যাপারে দুটি শর্ত আছে, তা হলো তিনি বাংলাদেশের ভেতরে চিকিৎসা গ্রহণ করবেন আর বিদেশে যেতে পারবেন না। সে কারণে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সময় তাকে দাওয়াত দিতে আইনি কোনো বাঁধা নেই।

নেপথ্যে কি? কি প্রমাণ করতে চায় সরকার?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের অনুষ্ঠানটি দেশ-বিদেশের একটা গুরুত্বপূর্ণ নজর থাকবে বাংলাদেশের ব্যাপারে। যে যেভাবেই বিশ্লেষণ করুক না কোনো স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে করেছে। এত বড় অবকাঠামোর বাস্তবায়ন রীতিমতো অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করাটা বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থার কাছে খুব একটা সুখকর না। কেননা পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ এনে সরে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বব্যাংক। এজন্য সরকার পদ্মা সেতু নিয়ে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানটি একদিকে যেমন তুলে ধরতে চায় তেমনি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ইস্যুতে তাদের বেকায়দায় থাকার বিষয়টি থেকে সবার দৃষ্টি দূরে ফিরিয়ে নিতে চায়। কেননা র‌্যাব ও তার ৭ কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লংঘনের দায়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনায় সরকার বেশ বিব্রতকর অবস্থায় রয়েছে। 

র‌্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের উপর দেওয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে র‌্যাব ও এর সাবেক-বর্তমান কর্মকর্তাদের উপর দেওয়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, এটা ‘জটিল ও কঠিন’ বিষয়। 

আবার অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ৬৬টি গুমের বিষয়ে দেওয়া তথ্য অপর্যাপ্ত বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল। তাছাড়া বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির অবস্থান আগের চেয়ে বেশ শক্ত। এছাড়া ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকিও বলেছেন, গতবারের তুলনায় এবার বাংলাদেশে ভালো নির্বাচন প্রত্যাশা করে জাপান। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার পদক্ষেপ নেবে বলে আশা জাপানের। 

সেক্ষেত্রে দেশের মুলত প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দাওয়াত দেয়া ও তার উপস্থিতিকে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে সরকারের সহনশীলতা তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও কেউ কেউ মনে করেন। বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারের আগ্রহ বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলির নজরে আছে। খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিএনপি’র নেতাকর্মীসহ পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনকে কিছুটা কাছে টানা যাবে এই বলে যে সরকার এখন বিরোধী মতের ব্যাপারে অনেক নমনীয়। 

কেননা গুঞ্জন রয়েছে এ সরকারের অধীনেই বিএনপি একটি সমঝোতামূলক নির্বাচনমুখী করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। যদিও দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এব্যাপারে তীব্র আপত্তি আছে। তবে এসব বিষয়ের পাশাপাশি বিএনপি’কে রাজনৈতিকভাকে ঘায়েল করতেই সরকার দাওয়াতী হয়ে উঠেছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। যদিও সেতুর উদ্বোধনীতে সব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও শেষতক আসলেই দাওয়াত পাচ্ছেন কি-না তা পরিষ্কার না। তবে সে-খবর যদি ইতিবাচক হয় তাহলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আরো অনেক কিছু নিয়ে আলোচনার জন্ম নেবে বলেই পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন।


শেয়ার করুন