২৩ এপ্রিল ২০১২, মঙ্গলবার, ৬:১৬:২৩ অপরাহ্ন


কী বার্তা দিলেন পিটার হাস
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০৬-২০২২
কী বার্তা দিলেন পিটার হাস ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস/ফাইল ছবি


বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই বিদ্যমান কী? এমন এক প্রশ্ন অনেকের মাথায়ই ঘুরপাক খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো এতো বড় দেশের বাংলাদেশ প্রসঙ্গেই বা এতো মাথাব্যাথা কেন? এ প্রশ্নটাও আছে। কেউ কেউ বাংলাদেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্যোগগুলো সেগুলোকেও সাধুবাদ জানাচ্ছে। একটা স্বাধীন দেশে অন্যএকটি দেশের এমন চাওয়া পছন্দনীয় নয়। তবে বাংলাদেশের বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনের প্যাটার্ন দেখলে গণতন্ত্রটা যে কোনো পর্যায়,একইসঙ্গে বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে দেশের রাজনীতিবিদদের গলা ফাটানো চিৎকারে যে কিছুতেই কিছু হচ্ছেনা এবং এমনি মুহূর্তে মার্কিনিদের উদ্বেগটা (র‌্যাব ও তার সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা)  যে আসলেই যথার্থ সেটাও মনে করছেন কেউ কেউ। 

তবে বাংলাদেশ ইস্যুতে মার্কিনিদের সার্বিক বিষয়াদি অনেককেই কুরে খাচ্ছে এটা বাস্তব। কিন্তু কেন, কীসের জন্য সেব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই।তবে সাম্প্রতিককালের কিছু বাগযুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করলে এসব বিষয়গুলো খুব স্পষ্ট হয়ে যাবে। গত পয়লা জুন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের যে পরামর্শ দিয়েছিলেন মার্কিনিদের প্রসঙ্গে, সেটাতে কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে। জনাব মোমেন এক বার্তায় সাংবাদিকদের জানান, ‘আপনারা অনুগ্রহ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে প্রশ্ন করবেন, কেন তাঁরা তাঁদের নিজ দেশে এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে পারেন না? দ্বিতীয়ত. প্রতিবছর প্রায় এক লাখ মার্কিন নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে নিখোঁজ হয়। এমনকি শিশুরা তাদের হিস্পানিক মা-বাবার সঙ্গে পুনর্মিলন থেকে বঞ্চিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন করুন, বাংলাদেশ সম্পর্কে নয়।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমাদের এদেশ শাসন এবং এর উন্নয়নের দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের নয়। যুক্তরাষ্ট্র যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চায়, তাহলে আরটি (রাশিয়ান টেলিভিশন) সম্প্রচারে কেন বাধা দিয়েছে? তারা যদি জবাবদিহি চায়, তাহলে কেন প্রতিবছর এক হাজারেরও বেশি নাগরিককে (বেশিরভাগ কৃষ্ণাঙ্গ ও হিস্পানিক) হত্যার দায়ে মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনী বা পুলিশের কোনো শাস্তি বা জবাবদিহি হয় না?’

সাংবাদিকদের উদ্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো পরামর্শ দিয়ে লিখেছেন, ‘আপনারা কেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে প্রশ্ন করেন না, যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু হয়, তাহলে কেন তরুণ আমেরিকানরা তাদের নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করে না এবং কেন তরুণ আমেরিকানদের মধ্যে ভোট দেওয়ার হার কম? প্রতিটি নির্বাচনে কেন তাদের ভোটারদের প্রায় ২৫ শতাংশ ভোট দেয়? এটা কি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রক্রিয়া?’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই পরামর্শমূলক নির্দেশনার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে কোনো অনুষ্ঠানে পাওয়া না গেলেও তার ওই পরামর্শ মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়। 

ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত সে পরামর্শমূলক প্রশ্নের উত্তরদানের সুযোগ খুঁজছিলেন এবং সেটার জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন, নিজেদের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদ্যপ্রতিষ্ঠা করা ইউটিউব চ্যানেল ‘এমটক’-এ। 

গত ১৭ জুন ওই এমটকে দীর্ঘ আলোচনায় বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অনেকগুলো ইস্যু নিয়েই তিনি বিস্তারিত বলেন। সেখানে তিনি র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাংলাদেশের বিস্ময় দেখে যুক্তরাষ্ট্রও ‘প্রায় বিস্মিত’ সেটাসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন। 

র‌্যাব নিষেধাজ্ঞা ও প্রশিক্ষণসংক্রান্ত 

র‌্যাব ইস্যুতে পিটার হাস বলেন, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশের বিস্ময় দেখে যুক্তরাষ্ট্রও ‘বিস্মিত’। কারণ র‌্যাবের কর্মকাণ্ডে মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগের বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বছর ধরে আলোচনায় তুলেছে। র‌্যাবের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা দু’দেশের বিস্তৃত সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত। তিনি জানিয়েছেন, তাঁর মনে হয়, লোকজন র‌্যাবের নিষেধাজ্ঞার ওপর খুব বেশি মাত্রায় মনোযোগ দিচ্ছেন। তাঁরা চলমান অন্যান্য সহযোগিতার বিষয়গুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন। আইন প্রয়োগ, সন্ত্রাসবাদ দমন ও সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দু’দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা রয়েছে। এসব বিষয়ে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী সহযোগিতা রয়েছে।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমরা বিচার বিভাগ, আইনজীবী ও পুলিশের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকি। এই যে এতো প্রশিক্ষণ ও অংশীদারিত্ব আমরা করছি, সামনের দিনগুলোতে তা চালিয়ে যেতে এবং আরো গভীর করতে আমরা খুবই আগ্রহী। তবে এটা ঠিক যে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের বিষয়টি আছে। যেখানে গত ডিসেম্বরে আমরা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি। তার পর থেকেই আমরা অনেকবার শুনেছি যে, বাংলাদেশ এতে কত অবাক হয়েছে। সম্ভবত তাদের এই বিস্ময় দেখে আমরাও প্রায় বিস্মিত। ২০১৮ সালেই যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দেয়া বন্ধ করেছিল। এটা করা হয়েছিল মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ থেকে। বেশ কয়েক বছর ধরেই তাঁদের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এসব উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এসব তুলে ধরা হয়েছে। ফলে নিষেধাজ্ঞাটা বিস্ময় হিসেবে এলেও যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্বেগ ছিল, সেটি নিয়ে তো বিস্ময় থাকার কথা নয়। 

র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবে এ নিষেধাজ্ঞায় যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি না, সে বিষয়ে অনেকের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় বলে জানান মার্কিন রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ‘আমি শুধু তাদের বলি, এমন হতে হবে, আমি তা মনে করি না। আমাদের মধ্যে অনেক বিস্তৃত ক্ষেত্রে যেখানে আমরা পরস্পরকে সহযোগিতা করি, এটি তার একটি।’ 

নির্বাচন প্রসঙ্গ 

বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, তাঁর স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে মার্কিন গণতন্ত্রও নিখুঁত নয়। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের পর ব্যাপক আত্মমূল্যায়ন ও তর্কবিতর্ক হয়েছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে, তাদের কার্যপ্রণালি ও রীতিনীতি নিয়ে, তাদের জবাবদিহি নিয়ে। এটি এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে লড়াই করতে হয়েছে, খোলামেলা বিতর্ক করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই। আবার জনগণ কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে দেখেছে। কারচুপির অভিযোগ এসেছে। এ নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে। এগুলো সবই হয়েছে এটি নিশ্চিত করার জন্য যে গণতন্ত্র চলমান। বাংলাদেশেও কিছু বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার কাজ করতে পারে। 

মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি এটিও স্পষ্ট করতে চাই যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পছন্দ নেই। নির্দিষ্ট কোনো দল বা ফোরামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। এটা যুক্তরাষ্ট্রের কাজও নয়। তবে বাংলাদেশের মানুষ যা দেখতে চায়, আমরা তা দেখতে চাই। সেটি হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক মানের একটি নির্বাচন হবে, যেখানে বাংলাদেশের মানুষ তাদের পরবর্তী নেতাদের বেছে নিতে পারবে একটি অবাধ, প্রতিযোগিতামূলক, সহিংসতাবিহীন ও দমন-নিপীড়নমুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ঠিক এটাই খুব করে দেখতে চাই। তেমন কিছু ইঙ্গিত, কিছু সঙ্কেতকে আমি স্বাগত জানাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানাবে। আমার মনে হয়, এটা গুরুত্বপূর্ণ।’

জিএসপি ইস্যু 

জিএসপি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় ইস্যুগুলোর মধ্যে যেটা প্রায়ই বাংলাদেশ সরকার সামনে আনে, তাহলো জিএসপি সুবিধা আবার চালুর অনুরোধ। রানা প্লাজা ধসের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা কেড়ে নিয়েছিল। আমরা বারবার বলেছি যে, জিএসপি আবার শুরু করার আগে বাংলাদেশ শ্রমিক, শ্রমঅধিকার, শ্রমিকদের নিরাপত্তার স্বার্থ সুরক্ষায় ব্যবস্থায় নিয়েছে- এটা দেখতে চাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ এখনো সেগুলো পূরণ করেনি। কিন্তু ক্রমাগতভাবে তারা জিএসপির বাধা তুলে নিতে বলছে।’

রাষ্ট্রদূত জানান, ‘বাংলাদেশ যতোক্ষণ পর্যন্ত না জিএসপি সুবিধার জন্য যোগ্য হচ্ছে, ততোক্ষণ এটি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উন্নয়ন অর্থায়ন করপোরেশন থেকে তহবিল গ্রহণের অনুমতি পাবে না। নতুন উন্নয়ন অর্থায়ন করপোরেশন গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু কাজের জন্য। রাজনৈতিক ঝুঁকিবীমা প্রদান তার একটি ইকুইটিভিত্তিক অর্থায়ন, এটি প্রকল্পের জন্য ঋণভিত্তিক অর্থায়নও হতে পারে। সাধারণত এগুলো হয় বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প, রাস্তাঘাট, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা খাত, টিকা উৎপাদন-সংক্রান্ত।

দু’দেশের সম্পর্ক 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্কে ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকারের বিষয়ে পিটার হাস বলেন, ‘পরের ৫০ বছর কেমন হতে পারে, তা ভেবে আমি রোমাঞ্চিত। আমরা ততোটাই দ্রুত যেতে তৈরি রয়েছি, যতোটা বাংলাদেশ এই অংশীদারত্বকে এগিয়ে নিতে আগ্রহী। সহযোগিতার আরো অনেক ক্ষেত্র আছে, যেখানে আমরা কাজ করতে আগ্রহী।

এর একটি নিরাপত্তা সহযোগিতা, সামরিক দিকে যেখানে আমরা অনেক যৌথ মহড়া করে যাচ্ছি বাংলাদেশ ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে, যেখানে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নেতৃত্বে রয়েছে গোটা বিশ্বে, যেখানে আমরা শিখতে পারি এবং তাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজের মাধ্যমে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারি বিশেষ অভিযান, দুর্যোগে মানবিক ত্রাণসহায়তা ও অন্য বিষয়গুলো। আমরা সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি নিয়েও কাজ করতে চাই।’

পিটার হাস বলেন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ উভয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে দু’দেশের অনেক কিছু করার আছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু উদ্বেগও আছে বাংলাদেশে এবং এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে তাঁরা কুণ্ঠিত নন। তবে এসব আলোচনা হতে হবে খোলামেলা এবং উপলব্ধি করতে হবে যে এসব নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।


শেয়ার করুন