০৬ মে ২০১২, সোমবার, ০৭:৫৭:১৫ পূর্বাহ্ন


নতুন জাতীয় গৌরবে বাংলাদেশ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৬-২০২২
নতুন জাতীয় গৌরবে বাংলাদেশ


 অন্তত তিনটি কারণে ২৫ জুন ২০২২ বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আলোকিত দিন হয়ে থাকবে। দিনটিতে বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা, বাংলাদেশের জনগণের অর্থে নির্মিত পদ্মা বহুমুখী সেতুতে সড়ক সংযোগ উদ্বোধন করে, দক্ষিণ বাংলার ২১ জেলার ৬ কোটি মানুষকে মূলধারার অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত করেছেন। খুলে গেছে দক্ষিণের দুয়ার। তেঁতুলিয়া থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, টেকনাফ থেকে সুন্দরবন এখন সরাসরি সড়কপথে সংযুক্ত।

সেতুর প্রভাবে গোটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন জ্যামিতিক হারে হতে থাকবে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। বড় কথা, সেতুটি শুধু বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থে বাস্তবায়িত মেগা প্রজেক্ট নয়, এটি হলো অনেক অসম্মান এবং অপমানের জবাব। বাংলাদেশ প্রমাণ করলো কৃতকল্প জাতিকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না। উত্তর দক্ষিণের মিলন মোহনা সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকন্যা মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত করলেন। 

বাবার সারাজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, বঞ্চিত বাংলার সকল মানুষের সমানভাবে ভাগ্যোন্নয়নের। হয়তো দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে (হাসিনা, রেহানা দেশে না ঢাকায় বেঁচে যান) হত্যা না করলে, হয়তো জাতি অনেক আগেই বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছতো। খুনিচক্র বঙ্গবন্ধুর লাশ পর্যন্ত গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নিভৃত পল্লীতে দাফন করতে বাধ্য করেছিল। এখন থেকে যতদিন যাবে, সেই টুঙ্গিপাড়া হবে বাংলাদেশের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। ইতিহাস যাকে বরণ করে কি সাধ্য আছে কারো আঁধারে দেখে রাখার। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে আলো জ্বলার কাজটি বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে আগেই সম্পাদিত হয়েছে।

বলছিলাম বহুমুখী সেতুর কথা। অনেকেই জানেন নদীতে জলপ্রবাহ, খরস্রোতের বিবেচনায় শুধু আমাজন নদী পদ্মার সাথে তুলনীয়। হিমালয় পর্বতমালা বিধৌত করে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনার মিলিত স্রোত পদ্মা নদী হয়ে সাগরে মিলেছে। পদ্মা, যমুনা বাংলাদেশকে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণকে বিভাজিত করে রেখেছিলো। কাকতলীয়ভাবে যমুনা বহুমুখী সেতুটিও বঙ্গবন্ধুকন্যার শাসনামলে ১৯৯৬-২০০১ সময়ে সম্পাদিত হয়েছিল। ২০০১ সালে সরকারে আসতে পারলে হয়তো পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন আরো আগে হয়ে যেতো।

পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন কারিগরিভাবে অনেক জটিল এবং দুরূহ ছিল। তদুপরি, বাংলাদেশ বিরোধীমহল মিথ্যা প্রচার চালিয়ে সংকটাপন্ন করে তুলেছিল সেতুর বাস্তবায়ন। দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগে একসময় প্রতিশ্রুতি দিয়েও বিশ্বব্যাংক প্রথমে এবং ওদের দেখানো পথে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান সরকার সরে দাঁড়ায়। মিথ্যা অভিযোগ ঘরে নিয়ে মন্ত্রিত্ব থেকে বাদ হন আবুল হোসেন। সরিয়ে দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ডক্টর মশিউর রহমানকে। চাকরিচ্যুত করে জেলে পাঠানো হয় সেতু সচিবকে। অভিযোগ ছিল সেতুর পরামর্শক নির্বাচনে কথিত দুর্নীতি। প্রধানমন্ত্রী, শেখ রেহানা, জয়,পুতুল, রেহানার ছেলে ববির বিরুদ্ধেও দুর্নীতির গুজব ছড়ানো হয়।

মানসিকভাবে আঘাত পেয়েও দমে যাননি হাসিনা। সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের নিজেদের অর্থে সেতু নির্মাণের। সড়ক সেতুর সঙ্গে রেলসেতু যুক্ত হয়। গ্যাসলাইন, ফাইবার অপটিক্স লাইন আগেই পরিকল্পনায় ছিল। সেতু সমান্তরালে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। যুক্ত হয় দু’পাড়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে উঁচু ক্ষতিপূরণ প্রদান, ওদের জন্য আধুনিক  আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা আর তীর ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উভয় পাশে বিশাল নদীশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছিল আরো এক মহাযজ্ঞ। 

 কানাডার আদালতে সুস্পষ্ট হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে কোনো দুর্নীতি হয়নি। জানিনা এই পর্যায়ে বিশ্বব্যাংক এবং তাদের অনুসরণ করে অন্যান্য সংস্থা যারা বাছবিচার না করেই সরে গিয়েছিলো, তারা ক্ষমা না চাক, দুঃখ প্রকাশ করবে কিনা। তবে বাংলাদেশের যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল বা এখনো বাঁকা চোখে দেখে তাদের জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী ভাষণে।

যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এরকম করেছে সেতু ডিজাইন। বিশ্বখ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন করা জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, পার্ল হারবার মেমোরিয়াল সেতু, আবুধাবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিঙ্গাপুর মেরিন বে, সিডনি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেতু নির্মাণে বিশেষজ্ঞ পণ্যের চেয়ারম্যান আমার প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক, একুশে পদক জয়ী ডক্টর জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনেছি। এমনকি স্যারের প্রয়াণের একদিন আগেও উনি আমার সঙ্গে ডিজিটালি একটি প্রোগ্রামে সেতু নিয়ে কথা বলেছেন। আমি নিশ্চিত সেতু নিয়ে পরামর্শক, ঠিকাদার নিয়োগে কোনো দুর্নীতি হয়নি।  

অনেকে এখন সেতুর খরচ নিয়ে জেনে না জেনে কথা বলেন। এমনকি মহান জাতীয় সংসদেও কেউ কেউ কথা বলেছেন। সেতুটি কেন অসাধারণ অনন্য তা ওপরে লিখেছি। সেতু হিসেবে এটি ভারতের ভূপেন হাজারিকা সেতু দূরের কথা বৃহৎ তিনটি সেতু, হংকং-ম্যাকাও সেতু, যুক্তরাষ্ট্রের লেক পন্যাচাতরাইন কজওয়ে এবং কুয়েতের শেখ জাবের আল সাবাহ কজওয়ের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। সেতুটি দ্বিতল। ওপরে চলবে সড়ক বাহন, নিচে রেল, আছে গ্যাসসঞ্চালন পাইপলাইন। আছে দুনিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ নদীশাসন ব্যবস্থা, কিছু পাইপ যদি তলদেশ থেকে ১২০ মিটার গভীরে ড্রাইভ করতে হয়েছে। ৯ রিখটার মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয় করার জন্য ১০ হাজার টন ক্ষমতার ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বেয়ারিং লাগানো হয়েছে। সেতুতে সংযোজিত লাইট পসগুলো ২২০ কিলোমিটার ঝড়ের সময়েও দাঁড়িয়ে থাকবে। 

সেতুটি দক্ষিণ বাংলাসহ বিশাল এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়নের সৃষ্টি করেছে। বিদ্যুতের ব্যবস্থা নিশ্চিত আছে, গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা চলমান। এলাকায় প্রযত্ন সুবিধা সম্প্রসারঅতীত হবার ব্যাপক সুযোগ আছে। বিশ্ব হেরিটেজ সুন্দরবন, পায়রা উপকূল এখন হাতের নাগালে। বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা বিভাগে যাতায়াত এখন অকল্পনীয়ভাবে সহজ। এগুলো জেনেও কেউ কি বলবেন সেতুটি প্রয়োজন ছিল না?

যারা বলছেন তাদের মোক্ষম জবাব দিয়েছেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। 

শুধু বলবো স্মরণ রাখতে হবে, দক্ষিণাঞ্চল কিন্তুমারাত্মক ক্লাইমেট ঝুঁকিতে আছে। উন্নয়ন যেন পরিকল্পিত এবং পরিবেশবান্ধব হয়। দুটি রফতানি প্রক্রিয়াকরণ, ১৭টি বিশেষায়িত শিল্পাঞ্চল যেন কোনোভাবেই জলবায়ু বা মাটিদূষণ না করে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে যেন প্রাধান্য দেয়া হয়। পরিকল্পিতভাবে যেন ঢাকা মহানগরীর কিছু কার্যক্রম পদ্মার অপর পাড়ে স্থানান্তর করে মহানগরীর যানজটমুক্ত করা হয়।


শেয়ার করুন