২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ১১:৪১:১৫ অপরাহ্ন


বুকটা ফাইট্টা যায়..
হাবিব রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০২-২০২৪
বুকটা ফাইট্টা যায়..


‘বন্ধু যখন বউ লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া রঙ কইরা হাইট্টা যায়, ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়।’ না, আমার বুকটা ফাটে না। এটি বাংলাদেশের লোকগানের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এবং প্রাক্তন সংসদ সদস্য মমতাজের ধামাকা গানের ক’টি লাইন। তবে আমার বুকটা ফাইট্টা যায় অন্য একটি কারণে। সে প্রসঙ্গে যাবার আগে ভূমিকাটা সেরে নেই।

১৯৭৪ সালে আমি বিএ পরীক্ষা পাস করি। সে সময় পাসের হার ছিল ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ শতকরা ৮৬ শতাংশ ছাত্র ফেল করে। এরপর থেকে শিক্ষাব্যবস্থা গতি হারায়। পাসের হার পরবর্তীতে কততে পৌঁছে সে প্রসঙ্গ না হয় নাই টানলাম। ঢাকা শহরেই বড় হয়েছি। মা, ভাই-বোন সবাই বর্তমান। ভাইদের মধ্য আমি সবার ছোট। সংসারের কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। তাই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াই। টুকটাক গল্প-কবিতাও লিখি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বিকাল হলে আড্ডা মারতে যাই বইপাড়াখ্যাত বাংলাবাজারে। মদীনা পাবলিকেশন্সের স্বত্বাধিকারী, বিশিষ্ট লেখক মাওলানা মুহিউদ্দীন খান আমার আত্মীয়। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তার সম্পাদিত মাসিক মদীনা তখন খুব জনপ্রিয়। ওখানেও কিছু লেখালেখি করি। তার পত্রিকায় দুটি বিভাগ ছিল খুব জনপ্রিয়। একটি সমকালীন প্রশ্নের জবাব এবং অন্যটি মুসলিম জাহান। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সঙ্গে বিভিন্ন মুসলিম দেশের খুবই সফল যোগাযোগ ছিল। অনেক মুসলিম দেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার ছিল খুব আন্তরিক সম্পর্ক। যেমন তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ফয়সলের সঙ্গে ছিল তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মুতামারে আলমে আল ইসলামি নামক সৌদিভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন সৌদি বাদশাহ ফয়সল। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানের সেক্রেটারি জেনারেল। শ্রীলঙ্কার একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এমনিভাবে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামি সংগঠনের সঙ্গেও ছিল তার গভীর সম্পর্ক। সেসব প্রতিষ্ঠানের নানা ম্যাগাজিন আসতো তার কাছে। এগুলো তিনি আমাকে দিতেন যেন ওখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ নিউজগুলো নিয়ে মুসলিম জাহান পাতাটি সমৃদ্ধ করি।

প্রায় সময় মাগরিব নামাজ পড়তাম শ্রীশ দাশ লেনের বিখ্যাত বিউটি বোর্ডিং-সংলগ্ন মসজিদে। নামাজের পর রাস্তাসংলগ্ন ঘাসে বসে আড্ডা দিতাম। এ সময় আড্ডায় নিয়মিত শরিক হতেন লেখক-সাংবাদিক মাওলানা আখতার ফারুখ। তিনি তখন দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক। তিনি একজন ভালো অনুবাদকও ছিলেন। সে সময় তার অনূদিত ‘আল-ফারুখ’ বইটি বেরিয়েছে। খলিফা ওমর (রা.) জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে উর্দুতে লিখা বইটির তার সাবলীল অনুবাদ আমাকে খুবই আকৃষ্ট করে। আমি একনাগাড়ে বইটি পড়ে শেষ করে পরে একদিন এক সান্ধ্য আড্ডায় বইটি নিয়ে তার সঙ্গে একটা দীর্ঘ আলোচনায় মিলিত হই। আখতার ফারুখ তার বই নিয়ে আমার আলোচনায় এতোই প্রীত হন যে, তিনি আমাকে দৈনিক সংগ্রামে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। সংগ্রাম পত্রিকার অফিস তখন বংশাল রোডে। একজন সাব-এডিটর হিসেবে আমি সংগ্রামে যোগদান করি। তখন টেলিপ্রিন্টারের যুগ। নিউজগুলো সব ইংরেজিতে আসতো। শিফট ইনচার্জ তা ভাগ করে দিতেন সাব-এডিটরদের অনুবাদ করার জন্য। নিজের অনুবাদ করা অখ্যাত নিউজগুলোও পর দিন পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে দেখে শিহরিত হতাম।

ক’দিন কাজ করার পর মনে হলো বাংলা ভাষাটা আরো একটু ভালো করে জানা দরকার। কাউকে কিছু না বলে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। অনেকে ব্যঙ্গ করলো। সমালোচনাও করলেন অনেক বন্ধু। বিএ পাস করে যেখানে এমএ ভর্তি হওয়ার কথা। সেখানে ডিমোশন নিয়ে অনার্স ভর্তি হওয়ার জন্য। যাকগে তিন বছর পর অনার্স শেষ করলাম। আবার মাথায় ভূত চাপলো। ভাবলাম, সাংবাদিকতা যখন করবো, তখন সাংবাদিকতাইবা মাস্টার্সটা শেষ করি না কেন। বাংলায় মাস্টার্স পড়ে এক সময় করে নেবো ক্ষণ।

ভর্তি পরীক্ষায় পাস করার পরও সাংবাদিকতায় মাস্টার্সে ভর্তি হতে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন তৎকালীন বিভাগীয় চেয়ারম্যান শামসুল মজিদ হারুন। তিনি বললেন, এমন পিকিউলিয়ার সার্টিফিকেট আমি আগে দেখিনি। পাস কোর্সে বিএ, বাংলায় অনার্স। এখন আবার এসেছো সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করতে। এক বছর তো বাকি। বাংলায় মাস্টার্সটা করে তারপর একটা চাকরিতে ঢুকে পড়ো। এই বিভাগে একটা সিট অনেক মূল্যবান। নতুন একজনকে পড়তে সুযোগ দাও।

আমি আমার কাহিনীটা তাকে খুলে বললাম। জানালাম, আমার খুব আশা সাংবাদিকতা করার। তাই এ লাইনে আরো দক্ষ হওয়ার জন্য আমাকে সাংবাদিকতায় দুই বছরের এই মাস্টার্স কোর্সটা করার সুযোগ দিলে খুবই উপকৃত হবো। আমার অনুনয় বিনয়ে তার মন গললো। ভর্তি হওয়ার সুযোগ দিলেন।

আমাদের সময়ে সাংবাদিকতা বিভাগে বেশির ভাগ শিক্ষক ছিলেন পার্টটাইম। বিভিন্ন পত্রিকার সিনিয়র সব সাংবাদিক। যেমন ডেইলি অবজারভারের এডিটর ড. মুনিম, ডেইলি নিউ নেশনের হাসান সাঈদ, দৈনিক বাংলা থেকে খোন্দকার আলী আশরাফ, বিটিভি থেকে একজনসহ এমনি আরো অনেকে।

আমাদের রিপোর্টিং ক্লাস নিতেন আতাউস সামাদ এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রার কাজী জাওয়াদ। কাজী জাওয়াদ ক্লাসে রিপোর্টিংয়ের থিউরিটিক্যাল দিকটা পড়ালেও আতাউস সামাদ স্যার রিপোর্টিংয়ের জন্য নিয়ে যেতেন ফিল্ডে। যেমন বিরোধীদলের ডাকা রেডিও-টেলিভিশন ঘেরাও। স্যার আমাদের নিয়ে যেতেন রেডিও বা টিভি অফিসের সামনে। পুরো সময় সেখানে অবস্থান করে প্রত্যেককে নিজের নিজের মতো রিপোর্ট করে স্যারের কাছে জমা দিতে হতো। রাস্তার পাশে বসেই স্যার খাতা দেখতেন। কার রিপোর্টে কি ত্রুটি আছে, তা তুলে ধরতেন। যার রিপোর্ট ভালো হতো তার রিপোর্টটা তিনি কণ্ঠ দিয়ে বিবিসিতে পাঠাতেন। উল্লেখ্য, আতাউস সামাদ স্যার সে সময় বিবিসির রিপোর্টার ছিলেন।

দৈনিক বাংলার সাংবাদিক খোন্দকার আলী আশরাফ আমাদের ফিচার পড়াতেন (সে সময় তিনি দৈনিক বাংলায় একটি জনপ্রিয় রম্য কলাম-‘দুর্জন উবাচ’ লিখতেন)। তিনি কখনো থিউরিটিক্যাল পড়ানোয় বিশ্বাস করতেন না। সব সময় বাইরে পাঠাতেন বিষয় নির্ধারণ করে দিয়ে। যেমন বললেন, যাও আজ তোমার বিষয়-ফুটপাতে চশমা বিক্রেতা ইত্যাদি। বায়তুল মোকাররম, পল্টন, নিউমার্কেট ইত্যাদি ঘুরে সপ্তাহখানেক সময় ব্যয় করে একটা রিপোর্ট তৈরি করে স্যারের কাছে জমা দিতে হতো।

এতোক্ষণ এতো বড় ভূমিকা টানলাম, অন্য একটি কারণে। গত কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখলাম, লোক নিয়োগের। বিজ্ঞাপনের ভাষাটা ছিল এমন-‘টেলিভিশনে কাজ করার জন্য প্রেজেনটার ও রিপোর্টার প্রয়োজন। অভিজ্ঞতা লাগবে না, যোগাযোগ করুন।’

আমার জানামতে, টেলিভিশনের একজন নিউজ প্রেজেনটার হতে হলে একটা নির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াও থাকতে হয় সুন্দর বাচনভঙ্গি, স্পষ্ট ও আকর্ষণীয় উচ্চারণ, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি। অন্যদিকে একজন রিপোর্টার হতে হলে অবশ্যই বেসিক জার্নালিজমটা জানতে হয়। একটি সম্ভাবনাময় ও চ্যালেঞ্জিং পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা আজ দেশে-বিদেশে অনেক উঁচুমাপের পেশা। পৃথিবীতে যতগুলো পেশা আছে, সাংবাদিকতা তার মধ্যে প্রথম সারিতে অবস্থান করছে। সাংবাদিকতায় অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ পেশায় প্রবেশ করতে পারলে একটি সম্ভাবনাময় ও উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়া সম্ভব।

ভাবছিলাম একজন সফল রিপোর্টার হওয়ার জন্য কত কাঠখড় পোড়ালাম। সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করলাম। কাজও করলাম বহু বছর। তারপরও নিজকে একজন সফল সাংবাদিক বা রিপোর্টার বলতে ভয় হয়। আর এখন টেলিভিশনের মতো একটা টেকনিক্যাল কাজের জন্য অভিজ্ঞতাহীন প্রেজেনটার, রিপোর্টার চাওয়া হয়, তখন চিৎকার করে বলতে হচ্ছে হয়-ধরণী দ্বিধা হও! অথবা শিল্পী মমতাজের ভাষায় বলতে হয়-ফাইট্টা যায়, বুকটা ফাইট্টা যায়।

শেয়ার করুন