জিনকো জি টেম্পলের সামনে লেখক
জাপানের একসময়ের রাজধানী কিয়োতো স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে রওয়ানা দিয়েছি জাপানের আরেক প্রাচীন রাজধানী ‘নারা’ দেখতে। সঙ্গে আমার গাইড নিকিতা। ট্রেনের জানালা দিয়ে চোখে পড়ছে সবুজ ক্ষেত, ছোট ছোট গ্রাম আর মাঝে মাঝে জাপানি ঐতিহ্যবাহী বাড়ি। আধঘণ্টার মতো সময়েই পৌঁছে গেলাম নারা, জাপানের প্রথম রাজধানী, যেখানে ইতিহাস আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন হাতে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
নারা পৌঁছাতেই মনে হলো আমি যেন সময়ের স্রোত উল্টে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি এক সহস্রাব্দ পুরোনো জাপানে। এই ছোট্ট শহর একসময় ছিল দেশের রাজধানী, নাম ছিল হেইজো-কিও। এখান থেকেই শুরু হয়েছিল জাপানি সভ্যতার সুসংগঠিত পথচলা। আজও নারা তার বুকে ধারণ করে রেখেছে সেই ইতিহাস, ঐতিহ্য আর প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ।
স্টেশন থেকে বের হতেই চোখে পড়ে নারা পার্কের বিখ্যাত হরিণেরা। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এরা দেবতার দূত। তাই তারা অবাধে ঘুরে বেড়ায় মানুষের সঙ্গে একেবারে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নিয়ে। বিশেষ বিস্কুট হাতে নিলেই হরিণেরা এগিয়ে আসে, এমনকি মাথা নুইয়ে বিনীত নমস্কারও করে। দর্শনার্থীদের কাছে এটি এক অনন্য অভিজ্ঞতা। নিকিতা আমাকে নিয়ে যায় তোদাইজি মন্দিরে। সূর্যের আলো তখন কোমল হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ছে। কাঠের বিশাল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো আমি যেন আর আধুনিক কোনো শহরে নেই-দাঁড়িয়ে আছি ইতিহাসের বুকের ভেতরে।
মন্দিরের মূল হলে প্রবেশ করার মুহূর্তেই নিঃশ্বাস আটকে গেল। আমার সামনে দাইবুতসু-ব্রোঞ্জে গড়া ১৫ মিটার উচ্চতার মহান বুদ্ধ। আলো-অন্ধকারের ছায়ায় তার চোখ দুটি যেন স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে, কিন্তু সেই দৃষ্টি ভেদ করে প্রবেশ করছে হৃদয়ের গভীরে। আমি ভিড়ের মাঝেই থেমে গেলাম। মনে হচ্ছিল সময় থেমে গেছে, শব্দ থেমে গেছে, শুধু নীরবতা আর শান্তির ঢেউ আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। হাজার বছর আগে সম্রাট শোমু যখন এই মূর্তি নির্মাণ করালেন, হয়তো তিনিও চেয়েছিলেন-মানুষ এই দৃষ্টির ভেতরে শান্তি খুঁজে পাক, যুদ্ধবিগ্রহ ভুলে যাক।
চারপাশে দেখলাম মানুষ মাথা নুইয়ে প্রার্থনা করছে। এক ছোট্ট জাপানি শিশু মায়ের হাত ধরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে বিস্ময়-ঠিক আমার মতোই। মনে হলো, প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে একই বিস্ময় অনুভব করেছে। ১৫ মিটার উঁচু, সম্পূর্ণ ব্রোঞ্জে গড়া, অথচ চোখে যেন অনন্ত শান্তির প্রতিফলন। মূর্তির বিশালত্বে আমি মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। মনে হলো আমি এক বিন্দু মানুষ আর তিনি এক অনন্ত মহাসাগর। আলো-অন্ধকারের খেলায় বুদ্ধমূর্তির মুখমন্ডল আরো রহস্যময় হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের কথা মনে পড়লো- ৭৪৫ সালে সম্রাট শোমু এই দাইবুতসু নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। হাজারো শ্রমিক, শিল্পী আর কারিগরের হাতের ছোঁয়ায় গড়ে উঠেছিল এই অদ্বিতীয় ভাস্কর্য। যুগে যুগে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও প্রতিবারই জাপানিরা একে পুনর্নির্মাণ করেছে। যেন বুদ্ধ শুধু পাথর বা ব্রোঞ্জ নয়, বরং এক অটল বিশ্বাসের প্রতীক।
নিকিতা জানায়, তোদাইজি মন্দিরের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বুদ্ধমূর্তিটি শুধু জাপানের নয়, বরং বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ নিদর্শন। সম্রাট শোমুর আমলে, ৭৪৫ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। সম্রাট চেয়েছিলেন বৌদ্ধধর্মকে রাষ্ট্রীয় স্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং দেশের অশান্তি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ দূর করতে এক বিশাল প্রতীক তৈরি করতে। মূর্তিটি সম্পূর্ণ ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি (প্রায় ৪৩৭ টন), আর ওপরভাগে ছিল সোনার পাতের প্রলেপ। এর উচ্চতা প্রায় ১৫ মিটার (৪৯ ফুট), মাথার দৈর্ঘ্য ৫ মিটার আর চোখের দৈর্ঘ্য ১ মিটার। এত বড় একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি ঢালাই করা ছিল সেই সময়ের জন্য বিশাল প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ। হাজার হাজার কারিগর, শিল্পী এ কাজে অংশ নেন। বলা হয়, মূর্তির জন্য প্রায় ৪৫৩ টন ব্রোঞ্জ, ৮৭ কেজি সোনা এবং ১৩০ কেজি পারদ ব্যবহার হয়েছিল। ৭৫২ খ্রিস্টাব্দে সমাপ্ত হয় এ দাইবুতসু এবং তখন এক বিশাল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সারা জাপান থেকে মানুষ এসেছিলেন। তবে সময়ের সঙ্গে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অগ্নিকাণ্ডে মূর্তিটি বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে ১২০০ শতকে মাথা ও শরীরের অংশ ভেঙে পড়ে। ১৬০০ শতকে আবারও ক্ষতি হয়। প্রতিবারই এটি আংশিকভাবে পুনর্নির্মাণ করা হয়। আজ যে রূপ আমরা দেখি, তার অধিকাংশই মধ্যযুগীয় পুনর্নির্মাণের ফল। নিকিতা আরো জানায়, আজও দাইবুতসু শুধু এক বিশাল ভাস্কর্য নয়, বরং জাপানের ইতিহাস, শিল্পকলা, ধর্ম ও রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রতীক। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী তোদাইজি মন্দিরে এসে এই বুদ্ধমূর্তির সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে সেই মহিমা অনুভব করে।
মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম ভক্তদের। কেউ নীরবে মাথা নুইয়ে আছে, কেউ প্রার্থনা করছে, আবার কেউ শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমারও মনে হচ্ছিল, আমি যেন হাজার বছরের ইতিহাস, শিল্প আর বিশ্বাসের অংশ হয়ে গেছি। মন্দিরের ভেতরের কাঠের সুবিশাল স্তম্ভ, দেয়ালের অলংকরণ আর মূর্তির মহিমা সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমি যেন এক প্রাচীন জগতে হারিয়ে গেছি। সেখানে সময় থমকে আছে, কেবল শান্তি আর নীরবতার স্রোত বয়ে চলেছে। বেরিয়ে আসার সময় আরেকবার পিছনে তাকালাম। দাইবুতসুর চোখ তখনো নীরবে তাকিয়ে আছে, আমার দিকে নয়, বরং অনন্তের দিকে। যেন বলছেন, তুমি আবার আসবে, আমি এখানেই থাকবো। আর আমি মনে মনে বললোাম, আজকের এই দেখা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিগুলোর একটি হয়ে রইলো।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নারার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান কাসুগা তাইশা শিন্তো মন্দির। নারার সবুজ পার্কের মধ্যে পা দিলেই চোখে পড়ে কাসুগা তাইশা মন্দিরের লাল রঙের কাঠের কাঠামো। হাজার হাজার লণ্ঠনের সারি, প্রতিটি শ্যাওলায় মোড়া, যেন ইতিহাসের নিঃশব্দ গল্প শোনাচ্ছে। আমি গাইডের সঙ্গে ধীরে ধীরে মূল প্রাঙ্গণের দিকে হাঁটছি। চারপাশে শান্ত নীরবতা, মাঝে মাঝে হরিণের নরম পদধ্বনি। মনে হলো, এখানকার প্রতিটি পাথর, প্রতিটি লণ্ঠন, প্রতিটি কাঠের স্তম্ভ যেন সম্রাট শোমুর যুগ থেকে আজ পর্যন্ত নিজস্ব ভাষায় গল্প বলছে। মন্দিরটি ৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ফুজিওয়ারা পরিবারের নির্দেশে নির্মাণ করা হয়। এটি মূলত তাদের দেবতাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং রাজপরিবারের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে বানানো হয়েছিল। পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে ব্রোঞ্জ ও পাথরের লণ্ঠন, যা পূর্ণিমা বা উৎসবের রাতে জ্বলে ওঠে এক অপার্থিব আলোতে। সেই আলোতে আমি মনে করি-প্রতিটি প্রজন্ম এই মন্দিরের সৌন্দর্য আর শান্তি অনুভব করেছে।
প্রাঙ্গণে পৌঁছালে মন্দিরের বিশাল কাঠের দরজা, লাল রঙের কাঠের কাঠামো, আর তাকের ছাদ আমাকে ইতিহাসের জগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়। এখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো, আমি শুধু দর্শক নই, আমি শতাব্দীর ইতিহাসের অংশ। সন্ধ্যা নামতে নামতে সূর্যের আলো লণ্ঠনের ওপরে নেমে আসে, লাল রঙের কাঠ আর সোনালি আলো এক অপার্থিব মিলন ঘটায়। মনে হচ্ছিল, কাসুগা তাইশা শুধু একটি মন্দির নয়-এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, এক অনন্ত শান্তির প্রতীক। পথজুড়ে সারি সারি পাথরের লণ্ঠন, যেগুলো শ্যাওলায় মোড়া। প্রতিটি লণ্ঠন যেন ফিসফিস করে বলে যায় অতীতের গল্প। শত শত বছর ধরে পূর্ণিমার রাতে এই লণ্ঠনগুলো জ্বলে ওঠে আর মন্দির প্রাঙ্গণ তখন রূপ নেয় এক অপার্থিব সৌন্দর্যে।
তোদাই-জি মন্দিরের বিশাল বুদ্ধমূর্তি, কাসুগা তাইশা শিন্তো মন্দির, আর নারা পার্কের মুক্ত হরিণদের সঙ্গে সকালটা কাটিয়ে আমরা মন্দিরের পেছনের পথ ধরে এগোতে শুরু করলাম। নিকাতা জানায়, নারা মানেই শুধু তোদাই-জি নয়-তার আশপাশই লুকিয়ে আছে ইতিহাস, আলো, স্থিরতা আর হাজার বছরের গল্পে ভরা আরো কিছু কিছু অনন্য স্থান যা এখন আমি তোমাকে ঘুরিয়ে দেখাবো। আমরা প্রথমে উঠলাম নিগাতসু-ডো (NIGATSU-DO)-এর দিকে। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই শীতল বাতাস মুখে এসে লাগলো। কাঠের পুরোনো হলটির সামনে দাঁড়াতেই নিকিতা বললো, নারার সবচেয়ে নীরব দৃশ্য দেখতে চাইলে সবাইকে এই জায়গাটায় আসতেই হবে। নিগাতসু-ডোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকাতেই চোখের সামনে খুলে গেল নারা শহর-দূরে পাহাড়, কাছে সবুজ গাছ আর নিচে ছড়িয়ে থাকা মন্দির কমপ্লেক্স। সন্ধ্যার নরম আলোয় মনে হচ্ছিল শহরটা যেন এক চুপচাপ জলরঙে আঁকা ছবি।
নিগাতসু-ডোর পাশেই SANGATSU-DO, নারার প্রাচীনতম কাঠের ভবনগুলোর একটি। ভেতরে অল্প আলো, কিন্তু সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা বৌদ্ধ মূর্তিগুলো যেন শত শত বছরের ধ্যানে মগ্ন, শান্ত আর গম্ভীর। নিকিতা নিচু স্বরে বললো-এই হলটাই তোদাই-জির প্রথম নির্মিত অংশগুলোর একটি। তোদাই-জির কাছে ফিরে এসে আমরা ঢুকলাম নারা ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। এখানে বৌদ্ধ ভাস্কর্য, স্ক্রোল, মুখোশ আর কাঠখোদাই- সবই যেন ইতিহাসের নরম আলোয় জ্বলে উঠছিল। নিকিতা আমার দিকে তাকিয়ে বললো-নারা শুধু মন্দির নয়, জাপানের শিল্পের সোনালি অধ্যায় এখানেই। মিউজিয়ামের প্রতিটি হলে ঢুকে মনে হচ্ছিল বৌদ্ধ শিল্পের হাজার বছরের বিবর্তন চোখের সামনে সাজানো। তোদাই-জির ঠিক পাশেই ইসুইয়েনগার্ডেন (ISUIEN GARDEN)। পুকুর, বাঁকানো সেতু, পাথরের ল্যান্ডস্কেপ-সব মিলিয়ে ক্লাসিক জাপানি বাগানের একটা নিখুঁত উদাহরণ। আমরা বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম। নিকিতা বললো-জাপানে ‘শিন-গিয়ো-সো’ নামে তিন ধরনের বাগান নকশা আছে। ইসুইয়েনে তিনটিই দেখতে পাবে। পুকুরের জলে আকাশের মেঘের প্রতিফলন দেখে মনে হচ্ছিল পুরো নারা যেন শান্ত হয়ে বাগানের ভেতর লুকিয়ে আছে। ইসুইয়েনের পাশে YOSHIKIEN GARDEN। এখানে রয়েছে তিন ধরনের বাগান-পন্ড গার্ডেন, মস গার্ডেন এবং চা-বাগান। মস গার্ডেনে ঢুকতেই মনে হলো সবুজ কার্পেট বিছানো এক ক্ষুদ্র স্বর্গে এসে পড়েছি।
শেষ বিকালে আমরা গেলাম KOFUKU-JI-এর পাঁচতলা প্যাগোডার সামনে। সূর্যের শেষ আলো প্যাগোডার গায়ে পড়ে সেটাকে সোনালি রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছিল। সেখান থেকে কয়েক কদমের পথ SARUSAWA POND-জলের রুপালি পৃষ্ঠে প্যাগোডার প্রতিচ্ছবি যেন সন্ধ্যার আলোয় ভাসছে। মনে হচ্ছিল নারা ভ্রমণ শুধু ইতিহাস বা ধর্মীয় স্থান নয়, বরং প্রকৃতির কাছাকাছি আসারও সুযোগ। পার্কের সবুজ চত্বরে বসে চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করা, হরিণদের অবাধ বিচরণ দেখা কিংবা বিকেলের সূর্যাস্তে আকাশ রঙ বদলানো, সব মিলিয়ে এটি এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। আকাশে কমলা রঙের আভা, গাছের ফাঁক দিয়ে আলো ঝরে পড়ছিল মাটিতে। আমরা ট্রেন স্টেশনের দিকে হাঁটছি, কিন্তু মনে হচ্ছে নারা আমাকে এক টুকরো শান্তি, ইতিহাস আর স্মৃতির উপহার দিয়েছে। নারা যেন বুদ্ধদেবের মতোই ফিসফিস করে বলছে-আবার এসো, আমি এখানেই আছি।
টোকিও থেকে স্বর্গসেতুর পথে
জাপানের আমানোহাশিদাতে (Amanohashidate) হলো দেশের তিনটি সুন্দরতম দৃশ্যের একটি। জাপানি ভাষায় এর অর্থ ‘আকাশের সেতু’। হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য ও প্রাকৃহাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এই স্থানটিকে অনন্য করে তুলেছে। টোকিও থেকে কাছাকাছি যে কটি শহর বা দর্শনীয় স্থান দেখা সম্ভব তা ঘুরে ঘুরে দেখছি। আজ যাচ্ছি আমানোহাসিদাতে ঘুরে দেখার জন্য। ভোরের ট্রেনেই রওয়ানা দিলাম। আজই ফিরে আসতে হবে। টোকিও স্টেশনের ব্যস্ততা আমাকে শুভেচ্ছা জানাল। মানুষের ঢল, স্ক্রিনের আলো, ট্রেনের হুইসেল-সব কিছু মিলিয়ে এক নতুন দিনের প্রারম্ভ। আমি উঠে বসলাম শিনকানসেনের (বুলেট ট্রেন)আসনে। জানালার বাইরে শহরের উচ্চ ভবনগুলো ধীরে ধীরে পিছনে সরে যাচ্ছে। তার সঙ্গে মিলিত হচ্ছে নীল আকাশ, সবুজ মাঠ, আর পাহাড়ের সারি। একটু পরেই শুরু হলো হালকা বৃষ্টি। সূর্য কখনো আকাশে, কখনো মেঘের আড়ালে-এক রঙিন খেলা শুরু হলো।
টোকিও থেকে জাপানের প্রাচীন রাজধানী কিয়োটোর মধ্য দিয়ে ট্রেন এগোতে থাকে। পথের মাঝে ছোট ছোট গ্রাম, চা বাগান আর জাপানের প্রাচীন শহরগুলোর দৃশ্য চোখে পড়ছিল। কোথাও পাহাড়ের পাশ দিয়ে কুলু কুলু শব্দে নদী বয়ে চলেছে। আমার সঙ্গী নিকিতা। জাপান প্যানারমিক ট্যুরসের একজন গাইড। সে আমাকে কোম্পানির পক্ষ থেকে জাপান ভ্রমণে সঙ্গ দিচ্ছে। নিকিতা জানায়, আমানোহাশিদাতে বা ‘স্বর্গসেতু’, এক প্রাচীন স্যান্ডবার যা মিয়াজাকি প্রিফেকচারের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। ঐতিহাসিকভাবে এটি জাপানের তিন সুন্দরতম দৃশ্যের মধ্যে গণ্য। নিকিতা জানায়, এটির নাম এসেছে ‘আকাশের সেতু’ অর্থাৎ এমন একটি সেতু যা স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীকে সংযুক্ত করে। আমানোহাশিদাতে বহু শতাব্দী ধরে স্থানীয়দের আস্থা ও গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচীন কাহিনীতে বলা হয়, স্বর্গের দেবতারা এ সেতু দিয়ে পৃথিবীতে নেমেছিল। লোককথা অনুযায়ী, যদি কেউ চোখ বন্ধ করে সেতুর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত হাঁটে, তার সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ হয়। প্রকৃতিতে এটি ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বালি-দ্বীপ, দুই পাশের বন ও সাগরকে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে রেখেছে।
নিকিতা বলে সন্ধ্যার আলোয় সেতু এক নতুন রূপ ধারণ করে। সূর্য সোনালি ছায়া ছড়ায় সমুদ্রের জলে, পাখির গান ও নীরবতা মিলিয়ে সৃষ্টি করে এক স্বপ্নময় দৃশ্য। উপরের ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে সেতুটি যেন আকাশে ভেসে আছে, সমুদ্রের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার। নৌকায় বা সাইক্লিং করে সেতু পেরোনো যায়।
ট্রেন থেকে নেমে বাসে করে পৌঁছাই সেতুর কাছে
নীরবতা, সাগরের নীল জল আর সেতুর সরু বালি পথ-এ যেন স্বপ্নের মতো দৃশ্য। আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকি, দুই তীরের বনসজ্জা, নদীর নীরব স্রোত, পাখির কুঞ্জন সব মিলিয়ে মনে এক প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়। সন্ধ্যা নেমে আসে, সূর্য হালকা কম্পমান আলো ছড়ায় সাগরের পানিতে। আমি উপরের ওয়াচ টাওয়ারে দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্যটি দেখি-সেতু যেন আকাশের কোলাহলে ভাসছে আর প্রকৃতির সব রঙ একসঙ্গে মিলিত হয়েছে। টোকিও থেকে এই দীর্ঘ যাত্রা আমাকে শুধুই সেতুতে পৌঁছে দেয়নি, এটি আমাকে শিকড়ের সঙ্গে, ইতিহাসের সঙ্গে, জাপানের প্রকৃতি ও মানুষের গল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। আমানোহাশিদাতে-কেবল একটি স্থান নয়, এটি একটি অভিজ্ঞতা, একটি স্মৃতি, একটি স্বর্গসেতু যেখানে পৃথিবী ও আকাশ মিলে মিশে একাকার।
টোকিও থেকে কুরাশিকি
টোকিওর সকালটা ছিল নরম আলোয় ভেজা। স্টেশনের ঘড়িতে তখন ঠিক সাতটা। আমি আর নিকিতা দাঁড়িয়ে আছি টোকিও স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, হাতে ট্রেনের টিকেট- গন্তব্য Okayama, তারপর সেখান থেকে Kurashiki, এক পুরোনো খালপাড়ের শহর। নিকিতা বললো, আজ তুমি সময়ের ভেতর দিয়ে হাঁটবে ৪০০ বছর পেছনে ফিরে যাবে কুরাশিকিতে। আমরা উঠলাম JR Shinkansen Nozomi ট্রেনে। ট্রেন ছুটে চলল ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার বেগে শহরের কংক্রিটের দেওয়াল পেছনে ফেলে। সূর্যের আলো পড়ছে ধানক্ষেতে, মাঝে মাঝে নদীর জল চিকচিক করছে দূরে। প্রায় তিন ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর আমরা পৌঁছলাম Okayama Station-এ। সেখান থেকে Local JR Train-এ চেপে কুরাশিকি-মাত্র ২০ মিনিটের পথ।
স্টেশন থেকে বের হয়েই চোখে পড়লো
পাথরের রাস্তা, কাঠের ঘর, বাঁকানো সেতু আর ধীরে বয়ে যাওয়া খালের পানি। মনে হচ্ছিলো আমি যেন কোনো পুরোনো সিনেমার সেটে দাঁড়িয়ে আছি। নিকিতা বললো, এটাই ’Bikan Historical Quarter’- এডো যুগের আসল কুরাশিকি। খালের দুই পাশে সারি সারি সাদা দেয়ালের গুদামঘর, যেগুলো একসময় চাউল ও পণ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার হতো। এখন সেগুলো রূপ নিয়েছে কফিশপ, গ্যালারি, আর স্থানীয় কারুশিল্পের দোকানে। জলে ভেসে যাচ্ছে ছোট ছোট নৌকা, আর পর্যটকেরা বসে উপভোগ করছেন সেই সুনসান নীরবতা। নিকিতা আমার জন্য একটি Kurashiki River Cruise বুক করেছিল। কাঠের ছোট নৌকায় চেপে আমরা খালের ওপর ভেসে চললাম। নৌকাচালক ঐতিহ্যবাহী কিমোনো পরে গান গাইছিল পুরোনো জাপানি সুরে। চারপাশে পাথরের সেতু, সবুজ গাছ, আর নীরব দর্শক-পুরো দৃশ্যটা যেন এক জীবন্ত চিত্রকর্ম।
নৌকা থেকে নেমে আমরা গেলাম Ohara Museum of Art-এ। এটি জাপানের প্রথম বেসরকারি আর্ট গ্যালারি, যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে ভ্যান গঘ, মনেট, রেনোয়ারের আসল চিত্রকর্ম। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম আমি জাপানে আছি, মনে হলো ইউরোপের কোনো গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ বাইরে এখনো সেই পুরোনো খালপাড়। বিকেলে আমরা বসলাম খালের ধারে একটি ছোট কাঠের কফিশপে। জানালার বাইরে সূর্যাস্তের আলো পড়ছে পানির ওপর। নিকিতা বললো, কুরাশিকি’ মানে ‘সংগ্রহের স্থান’। কিন্তু এখন এটি শুধু ইতিহাস নয়, স্মৃতিও সংগ্রহ করে রাখে। আমি কফিতে চুমুক দিলাম- গরম ধোঁয়ার সঙ্গে যেন ভেসে আসছিল পুরোনো জাপানের সুবাস। সন্ধ্যা নামছে, খালের জলে জ্বলে উঠেছে লণ্ঠনের আলো। ওকায়ামা ফেরার পথে ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি শহরটা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে।
একদিনের পর্বতযাত্রা
সকালের টোকিও তখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। শিনাগাওয়া স্টেশনের বিশাল প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমি আর নিকিতা অপেক্ষা করছি নাগানোর দিকে রওনা দেওয়া Hokuriku Shinkansen ট্রেনটির জন্য। সময় সকাল ঠিক সাতটা। ট্রেন চলতে শুরু করলেই জানালার বাইরে ছুটে চলা টোকিওর উঁচু ভবন আর ব্যস্ততার শহর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল পাহাড়ের সবুজে। মাত্র দেড় ঘণ্টায় আমরা পৌঁছে গেলাম নাগানো স্টেশনে। স্টেশন থেকে কয়েক মিনিট ট্যাক্সি যাত্রায় পৌঁছলাম নাগানোর প্রাণকেন্দ্র Zenko-ji Temple-এ। এটি প্রায় ১ হাজার ৪০০ বছরের পুরোনো একটি বৌদ্ধ মন্দির, যেখানে এখনো প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সময় ঘণ্টাধ্বনি আর ধূপের গন্ধে মুখর থাকে পুরো চত্বর। নিকিতা জানায়, এই মন্দিরেই জাপানের প্রথম বুদ্ধ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। পাথরের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো প্রাচীন আর আধুনিক জাপান যেন হাতে হাত রেখে আছে এখানে।
এরপর গাড়িতে রওনা হলাম Jigokudani Monkey Park-এর দিকে। পাহাড়ের ফাঁকে উষ্ণ প্রস্রবণের ধোঁয়া উঠছে, আর তার ভেতর গরম জলে গা ভাসিয়ে আছে জাপানের বিখ্যাত তুষারবানর। নিকিতা বললো, এরা শুধু এখানেই উষ্ণ জলে স্নান করে। বিশ্বের অন্য কোথাও নয়। বিকেলে ফিরলাম শহরের দিকে। ছোট এক স্থানীয় রেস্টুরেন্টে খেলাম নাগানোর বিখ্যাত Soba noodles-চালের বদলে তৈরি হয় বিশেষ এক ধরনের গম থেকে, যা নাগানোর ঠান্ডা পাহাড়ি আবহাওয়ায় চাষ হয়।সঙ্গে পরিবেশন করা হলো গরম সবজি আর মিসো স্যুপ।
বিকেল ছ’টা নাগাদ আমরা আবার নাগানো স্টেশনে ফিরলাম। সন্ধ্যার আলোয় ট্রেনের জানালা দিয়ে পাহাড়ের দৃশ্যগুলো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। টোকিওর শহুরে আলোর দিকে ফেরার পথে মন কেমন যেন টানছিল পাহাড়ের শান্তি আর নিস্তব্ধতার দিকে।
প্রকৃতির স্বর্গে একদিন
টোকিওর সকালটা সেদিন ছিল রোদেলা, হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে শহরের ব্যস্ত রাস্তায়। আমি আর নিকিতা টোকিও স্টেশনে অপেক্ষা করছি বুলেট ট্রেনের জন্য। আমরা যাচ্ছি জাপানের সবচেয়ে শান্ত জায়গাগুলোর একটি Korakuen Garden দেখার জন্য। আমরা উঠলাম JR Shinkansen Nozomi ট্রেনে-এটি জাপানের দ্রুততম ট্রেনগুলোর একটি। ট্রেন ছাড়তেই জানালার বাইরে ছুটে চলল শহরের কংক্রিটের জঙ্গল, যা ধীরে ধীরে মিশে গেল গ্রামীণ দৃশ্যে চা-বাগান, পাহাড়, নদী, আর সাদা ঘরের সারি। প্রায় তিন ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর আমরা পৌঁছালাম Okayama Station-এ। স্টেশন ছেড়ে ট্যাক্সিতে চেপে গেলাম Korakuen Garden-এর পথে। রাস্তায় উঁচু গাছের সারি, নরম সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে পাতাগুলো, কোথাও কোথাও ফুলে ছাওয়া ঝোপঝাড় মনে হচ্ছিল পুরো শহর যেন এক নিঃশব্দ চিত্রকলা। ট্যাক্সি থামলো korakuen গার্ডেনের সামনে। গেট পেরোতেই চোখে পড়ল বিশাল এক খোলা মাঠ, যার চারপাশে পুকুর, সেতু, ছোট পাহাড় আর বাঁশের বন। এ যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক জীবন্ত ক্যানভাস।
নিকিতা বললো, এই বাগানটি প্রায় তিন শতাব্দী আগে ওকায়ামার রাজা ইকেদা সুনামাসা বানিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক জায়গা, যেখানে প্রকৃতির সৌন্দর্য একসঙ্গে উপভোগ করা যায়। আমরা হাঁটতে লাগলাম বাঁকানো পথে পাথরের সেতু পেরিয়ে গেলাম এক পুকুরের ধারে, যেখানে রাজহাঁসেরা সাদা পাল মেলে ভেসে বেড়াচ্ছে। দূরে দেখা গেল একটা টি হাউস যার ভেতর দর্শনার্থীরা নিঃশব্দে চা পান করছে।
আমরাও অর্ডার দিলাম সবুজ চা এবং মিষ্টি মোচি
নিকিতা বললো, “Korakuen মানে হলো- ‘প্রজাদের সুখের পর নিজের আনন্দ।’ তাই এই বাগান শুধু সৌন্দর্যের জায়গা নয়, এটি এক নীতির প্রতীক।” বাগানের পাশেই কালো কাঠের সেই বিখ্যাত Okayama Castle, যাকে বলে ‘Crow Castle’। বাগানের ভেতর থেকে দুর্গটির দৃশ্য যেন ছবির মতো-নীল আকাশের নিচে কালো দুর্গের প্রতিফলন পড়ে আছে পুকুরের জলে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম।মনে হলো- জাপানের ইতিহাস ও প্রকৃতি যেন একই ফ্রেমে ধরা পড়েছে। সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়ছে, বাগানের পুকুরের জলে তখন সোনালি আলো। আমরা রওয়ানা দিলাম ওকায়ামা স্টেশনের পথে। শিনকানসেন ট্রেন ছুটে চলল টোকিওর দিকে।
জলের শহরে একদিন
ভোরের হালকা কুয়াশায় ঢাকা ইয়োনাগো শহর। ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট লাল রঙের লোকাল ট্রেন, জানালা দিয়ে উঁকি মারছে সকালের আলো। আমার পাশে নিকিতা-সব সময়ের মতো হাসিমুখে। বললো, আজ আমরা যাচ্ছি মাতসুয়ে (Matsue)। যাকে বলা হয় ‘জলের শহর’ (City of Water)। ট্রেন ছুটতে শুরু করল। জানালার ওপারে ছুটে চলা সবুজ ধানক্ষেত, মাঝে মাঝে ছোট ছোট জাপানি গ্রাম। বাঁকবনের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের পাহাড়। নিকিতা জানালার পাশে ধারা বর্ননা দিচ্ছিলো। বললো এই পথের ওপর ভিত্তি করে Lafcadio Hearn লিখেছিলেন তার বিখ্যাত গল্পগুলো। Hearn ছিলেন আইরিশ-জাপানি লেখক ও গল্পকার। তিনি জাপানের লোককাহিনি, ভূতপ্রেতের গল্প ও সাংস্কৃতিক প্রথা বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করেছেন। Matsue শহরকে তিনি নিজের আবাসস্থল বানিয়ে জাপানের সাহিত্য ও ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। প্রায় ৩০ মিনিটের যাত্রা শেষে আমরা পৌঁছলাম মাতসুয়ে। স্টেশন থেকে বের হয়েই মনে হলো, এই শহর যেন পানির ওপর ভাসছে- খাল, সেতু, হ্রদ আর শান্ত বাতাসে ভরে আছে পুরো পরিবেশ। প্রথম গন্তব্য ছিল Matsue Castle, জাপানের হাতে গোনা আসল কাঠের দুর্গগুলোর একটি। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই চোখে পড়ল চারপাশের শহর আর দূরের Lake Shinji-এর নীল জল। দুর্গের নিচে নেমে আমরা উঠলাম একটি ছোট নৌকায়- Horikawa Boat Tour। নৌকা ধীরে ধীরে শহরের খাল বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেতুর নিচ দিয়ে যেতে যেতে মাঝেমধ্যে মাথা নিচু করতে হচ্ছিল। পথে দেখা মিললো পুরোনো কাঠের ঘর, ফুলের টবে সাজানো বারান্দা আর ছোট বাচ্চাদের হাসির শব্দ।
বিকালে আমরা গেলাম Lake Shinji-এর ধারে
সূর্য তখন পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আকাশের রঙ ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে সোনালি থেকে কমলা, তারপর লালচে বেগুনি। নিকিতা বললো, এখানকার সূর্যাস্ত জাপানের সবচেয়ে সুন্দর তিনটির একটি। ইয়োনাগোর পথে ফেরার সময় ট্রেনের জানালায় হ্রদের আলো ঝলমল করছিল। নিকিতা পাশে চুপচাপ বসে ছিল। তার চোখেও যেন লেগে ছিল সেই সোনালি সূর্যাস্তের আলো।