১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, বুধবার, ০৯:২০:২৭ অপরাহ্ন


ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় বার্তা অনেক
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-১২-২০২৫
ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় বার্তা অনেক গুলিবিদ্ধ ওসমান হাদী


ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় দেশজুড়ে চলছে নানান হিসাব নিকাশ। আলোচনার ঝড় বইছে কারা এর নেপথ্যে কিংবা সামনে কি দিন অপেক্ষা করছে? তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের ঘটনা কেবল একটি সাদামাটা হামলাই না। এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক বার্তা-ই দিচ্ছে। 

নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা

বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন। আগামী বছরের ১২ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু ঠিক পরের দিনই ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ খবর হলো ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল শনাক্ত করার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মোটর সাইকেলটির মালিক সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে র‌্যাব। পুলিশ সূত্র জানায়, ওসমান হাদিকে যে মোটরসাইকেল থেকে গুলি করা হয়, সেটির মালিক সন্দেহে আবদুল হান্নান নামের এক ব্যক্তিকে রাজধানীর পল্টন থানায় সোপর্দ করা হয়েছে। অন্যদিকে ওসমান হাদির হত্যাচেষ্টায় জড়িত ব্যক্তিদের ধরিয়ে দিতে পারলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। অন্যদিকে তিনজনকে ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র সম্পাদক ফাতিমা তাসনিম জুমা। তবে এই ধরনের ঘটনায় একটি বড়ো সন্দেহ সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে যে, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আদৌ হবে কি-না সে বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ আরও গভীর হলো। যদিও হাদির ওপর হামলার ঘটনা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আব্দুর রহমানেল মাছউদ শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) টেলিফোনে একটি গণমাধ্যমে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু তারপরেও সন্দেহ থেমে নেই। সন্দেহ গভীরতর হচ্ছে আসলেই কি নির্বাচন হবে? 

আইনশৃংখলা সুষ্ঠু নির্বাচনে পক্ষে?

ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনা প্রমাণ করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইন শৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিতরা তেমনভাবে সর্তক ছিল না। তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য পর্যাপ্ত নয়। তারা তৎপর হলে ওসমান হাদির ওপর এভাবে হামলা হতো না। কেননা ওসমান হাদি বহুবার জানিয়েছে যে তার ওপর হামলা হবে বা হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য হলে জুলাই বিপ্লবের এই ছাত্রনেতাদের কথায় ফলে রাজনীতিতে সুবিধাভোগিরা তেমন গুরুত্ব দেয়নি বা দিচ্ছে না। অন্যদিকে মাস না যেতেই জুলাই বিপ্লবের এই সাহসী নেতারা অবহেলিত হয়ে পড়েছে। সতের মাস না যেতেই অনেক বড়ো দল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে এদের প্রতি এখন ন্যূনতম সহানুভুতিটুকুও দেখাচ্ছে না। ফলে ওসমান হাদির মতো ত্যাগ স্বীকারকারীরা মুকুলেই ঝড়ে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে বলে কারো কারো অভিমত। তাই ওসমান হাদির ওপর এই ধরনের হামলার ঘটনা জুলাই বিপ্লবীতে অংশ নেওয়া সক্রিয় ছাত্র নেতাদের প্রতিও একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে কারো কারো ধারণা। বার্তা পরিস্কার যে জুলাই বিপ্লবীদের নিরাপত্তায় রাজনীতিতে সুবিধাভোগি দেশ ও জাতি এখন-ই খামখেয়ালীনা দেখাচ্ছে। অন্যদিকে এই বার্তাও পরিস্কার যে,নির্বাচনের আগে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আসলেই কতটা নড়বড়ে।

যদি-ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী জানিয়েছেন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে । অন্যদিকে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে, জুলাইযোদ্ধাদের নিরাপত্তায় কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য বিশেষ একটি সেল গঠন করা হতে পারে বলে ১৩ ডিসেম্বর শনিবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত্র কোর কমিটির জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। 

আরও হামলার বার্তা ও প্রশিক্ষণের খবরও সত্য?

ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে আগামীতে আরও বার্তা দিচ্ছে যে ত্রয়োদশ নির্বাচন বানচাল বা প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেশব্যাপী আরও নাশকতামূলক ঘটনা ঘটবে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে বলা হচ্ছিল যে হলো দেশের ভেতরে বাইরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বড়ো ধরনের হামলা বা অস্থিতিশীলতার চেষ্টা করছে।  এতে করে নির্বাচন বানচাল কিংবা সশস্ত্র হামলায় পুরো দেশকে বিপর্যস্ত করে ফেলা সক্ষম হবে। কিংবা শোনা যাচ্ছিল যে সীমান্তের ওপারে ওপারে একটি গ্রুপ অপেক্ষা করছে যে বাংলাদেশে কিছু একটা ঘটে গেলে ওরা চট করে ঢুকে পড়বে। ইতোমধ্যে বলা-ও হচ্ছে যে, ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় জড়িতরা ওপারে পালিয়ে গেছে। তথ্য প্রমাণ দিয়ে সোস্যাল মিডিয়া দাবি করা হচ্ছে শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার ঘটনার সঙ্গে জড়িত শ্যুটার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান ও তার সহযোগী বাইকচালক আলমগীর হোসেন বর্তমানে আসামের গুয়াহাটিতে অবস্থান করছেন। আর সেখানে তাকে পুরোপুরি সেল্টার দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক। 

বিএনপি’কে ফাঁসানো ও অনৈক্য সৃষ্টি চেষ্টা

একটি সূত্র জানায়, ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনার পেছনে আরও বড়ো ধরনের পরিকল্পনা ছিলো। কারো কারো মতে, ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনার পরপরই ঢাকা-৮ আসনের প্রার্থী বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে ঘায়েল করা চেষ্টা করা হবে। সেক্ষেত্রে বিএনপি’র পক্ষ থেকে একটি প্রতিরোধও আসবে। আর তা-তে সহজেই রাজনীতিতে বিরাট অস্থিরতা তৈরি হবে। আবার কারো কারো মতে, এই ঘটনা মাধ্যমে বিএনপি’র সাথে একদিকে জুলাই বিপ্লবীদের নেতাদের সাথে দূরত্ব তৈরি করার জন্যই ঘটানো হয়েছে। এর পাশাপাশি জামায়াতের সাথেও বিএনপি’র সংঘর্ষ বাধিয়ে দেওয়া পরিকল্পনাও ছিলো। মোদ্দা কথা চারিদিকে বড়ো ধরনের গোলযোগ বাধিয়ে দেওয়ার গোপন পরিকল্পনারই অংশ হাদির ওপর হামলা। এ কারণে ঘটনা সাথে ন্যূনতম সম্পৃক্ত না থাকা সত্ত্বেও কিংবা কোনো ধরনের যাচাই বাচাই ছাড়াই একটি মহল বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছিল। সৌভাগ্য ক্রমে মূল আসামীদের ব্যাপারে দ্রুত খবর চলে আসায় পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। কারো কারো মতে, ঢাকা-৮ আসনকে কেন্দ্র করেই হয়তবা সারাদেশব্যাপী নেতিবাচক প্রচারণায় বিএনপি’কে ঘায়েল করে ফেলা হতো হাদির ওপর হামলা ওই ঘটনার উসিলায়। 

রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘুরে গেলো

তবে শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনার পর প্রথম অবস্থায় যেমন নেতিবাচক ছিল, কিন্তু এরপরই মূহূর্তে দেশে একটা অন্যরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়ে চায়। এধরনের ঘটনায় সরকারের পাশে দাঁড়াতে প্রথম আহবান জানিয়েছিলেন তারেক রহমান। এরপর দেখা গেছে ১৩ ডিসেম্বর শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দল তিনটির নেতাদের বৈঠক। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ঐক্যের মাঠের ঐক্যের। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে। বৈঠকে জানানো হয়, ওসমান হাদির ওপর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে সর্বদলীয় প্রতিবাদ সভার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

সামনে কি আছে? কি হবে? এমন শঙ্কা থেকেই গেলো

শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনার মাধ্যমে একটি বার্তা পরিষ্কার তা হলো সামনের দিনগুলি মোটেই ভালো না। এর পাশাপাশি বার্তা আরও পরিস্কার যে প্রতিপক্ষ অনেক সুসংগঠিত ও ছক বেঁধেই সামনের দিকে হাঁটছে। সামনে যে আরও খারাপ পরিস্থিতি আছে তা এখন বড়ো দলের নেতারাই আশঙ্কা করছেন। এজন্যই এধরনের ঘটনার পর খোদ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, এই ষড়যন্ত্রগুলো এখনই থামবে না। আরও খারাপও হতে পারে। অন্যদিকে হাদির মতো এ রকম ঘটনা আরও ঘটতে পারে, আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। এদিকে শরিফ ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করার ঘটনার সঙ্গে জড়িত শ্যুটার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান ও তার সহযোগী বাইকচালক আলমগীর হোসেন বর্তমানে আসামের গুয়াহাটিতে অবস্থান করছেন বলে দাবি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে ফয়সাল হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাড়ি জমায়, এখন তার অবস্থান ভারতের গুয়াহাটিতে। আরও বলা হচ্ছে সেখানে যাওয়ার পর তাকে ভারতে পালাতে সাহায্য করা জাহাঙ্গীর কবির নানকের পিএস মাসুদুর রহমান বিপ্লব তাকে একটি সিম কিনে দেয়। আর খবর দেওয়া হচ্ছে যে, ‘ইনকিলাব মঞ্চের সংগঠক ওসমান হাদিকে হত্যার উদ্দেশ্য গুলি করার ঘটনার সাথে জড়িত শ্যুটার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান এবং তার সহযোগী মোটরবাইক চালক আলমগীর হোসেন ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে প্রবেশ করার পর জাহাঙ্গীর কবির নানকের পিএস মো. মাসুদুর রহমান বিপ্লব, ফয়সাল করিম মাসুদকে ভারতীয় একটি কন্ট্রাক্ট নম্বরটি জোগাড় করে দেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সবকিছু যদি এতো সহজেই পরিকল্পনা মাফিক ঘটে যায়? কিংবা পূর্বপরিকল্পনার অংশ হয়ে থাকে তাহলে এর শেষ বা সমাধান কি? কেনো এখন বলা হচ্ছে শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করার ঘটনায় সংগঠিত নেটওয়ার্কের ইঙ্গিত পাচ্ছে পুলিশ। আগে কেনো পাওয়া হলো না তাদের? কেনোইবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলাকারীকে ধরিয়ে দিলে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার দেয়ার ঘোষণা দিতে হলো? কতো বড়ো প্রভাবশালী পরিকল্পনাকারী হলেই না এতো বিশাল অংকের পুরস্কার ঘোষণা করা হয়? প্রশ্ন তারপরেও ভালো খবর নেই কেনো? কোনো এতো দিন কেটে গেলেও প্রধান দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তাহলে সার্বিক পরিস্থিতি কি দাঁড়ায়? সামনের দিনে কি আছে? কি হবে সে শঙ্কা কি থেকেই যাচ্ছে না? এমন অভিমত পর্যবেক্ষকমহলের।

শেয়ার করুন