২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৪:৪৪:৪৯ পূর্বাহ্ন


হাদি হত্যার নেপথ্যে কি নির্বাচন ও তারেক ঠেকাও যড়যন্ত্র
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-১২-২০২৫
হাদি হত্যার নেপথ্যে কি নির্বাচন ও তারেক ঠেকাও যড়যন্ত্র শরিফ ওসমান হাদি


ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি আর নেই। গুলিবিদ্ধ হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার ১৮ ডিসেম্বর মারা গেছেন। তবে তার মারা যাওয়ার পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান জল্পনা-কল্পনা-আলোচনা-গুজব বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। কারো কারো মতে, এধরনের ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তাদের বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল। অপরদিকে আবেগে উত্তেজিত ছাত্র-জনতাকে হাদির মৃত্যুর পর যারা বিভিন্ন ধরনের তান্ডব চালিয়েছেন তাদের অন্য লক্ষ্য ছিলো। এর পাশাপাশি এইসবপক্ষকে কাজে লাগিয়ে সার্বিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর জন্য আরেকটি মহল ছিল তৎপর। 

কি কি ঘটে গেলো?

আগে দেখা যাক ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির মারা যাওয়ার পরপরই সারাদেশে কি কি ঘটে গেলো? জুলাই অভ্যুত্থানের পর ইনকিলাব মঞ্চ গঠন করে হাদি। প্রথমে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হলেও পরে আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন। দ্রুত তাঁর একটি সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে উঠে। ইনকিলাব মঞ্চ প্রতিষ্ঠার পর জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণ, শহীদ ও আহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণার দাবিতে তিনি ছিলেন সোচ্চারদের অন্যতম। এনিয়ে তিনিই শাহবাগে ধারাবাহিক সমাবেশ আয়োজন করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভে অংশ নেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের পক্ষেও প্রকাশ্যে মত দেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙার ঘটনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন তিনি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার দাবিতেও ছিলেন সরব। জুলাই অভ্যুত্থানের পর হাদি জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিলেও পরে নতুন দল এনসিপিতে যোগ দেননি। বরং ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়ে কয়েক মাস ধরে মাঠে সক্রিয় ছিলেন। ফজরের নামাজের পর মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে ভোট চাওয়া, বাতাসা-মুড়ি নিয়ে প্রচার, ভোটারদের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ ও ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ-সবই তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরতেন। শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন ছাত্র-জনতা। ওইদিন ১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে শ্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁরা ‘তুমি কে আমি কে, হাদি হাদি’, ‘জাহাঙ্গীরের গদিতে, আগুন জ্বালাও একসাথে’, ‘আমরা সবাই হাদি হবো, গুলির মুখে কথা কব’, ‘লীগ ধর, জেলে ভর’সহ নানা শ্লোগান দিতে থাকে। তবে তার মারা যাওয়ার পর সর্বশেষ রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয় ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়। 

নেপথ্যে যেসব কারণ

ধারণা করা হয় ওসমান হাদিকে হত্যার এই ঘটনার পেছেনে অনেক কারণ রয়েছে। তার মারা যাওয়ার পরপরই ব্যাপক ক্ষোভকে কেউ কেউ ভিন্নখাতে নিতে চেষ্টা করতে থাকে। এমনিতেই আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধী বক্তব্যের কারণে শরিফ ওসমান হাদি সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ছিলেন হাদি। তাই হাদিকে একারণে প্রতিবেশী দেশের সহায়তায় তাকে হত্যা করেছে এমন দাবিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে একটি মহল। 

বন্দর ইস্যু চাপা পড়ে গেলো?

আবার কারো কারো মতে, এটি করে ঘটনার মূল জায়গা থেকে দৃষ্টিও ফেরাতে সচেষ্ট ছিলো কেউ কেউ। কারো কারো মতে, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনায় বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে বন্দর কর্তৃপক্ষের চুক্তি নিয়ে সারা দেশে ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। এতোদিন বাম প্রগতিশীল দলমতের বিশিষ্টজনেরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ করেছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ পরিচালনা এবং ঢাকার পানগাঁও নৌ টার্মিনাল পরিচালনার ভার বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান-ও মুখ খুলেন। তিনি বলেন, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের বন্দর কিংবা এলডিসি থেকে উত্তরণের মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার নেই বলে মনে করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আর এরপরেই বিষয়টি বেশ দানা বেধে উঠতে থাকে, যা এখন হারিয়ে গেছেই বলে মনে করা হচ্ছে। 

রাজনৈতিক বিভেদ কাজে লাগাতে

ঘটনার একেবারে শুরুতে অর্থাৎ হাদিকে গুলি করার ঘটনাকে প্রথমে একটি মহল বিএনপিকে দায়ি করে মাঠ উত্তপ্ত করার চেষ্টা করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনার সাথে পুরোপুরি বিএনপি জড়িত বলে প্রচার করতে থাকে। আবার আরেক পক্ষ বিএনপি-জামায়াতকে মাঠে মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে যেতেও তৎপর ছিল। আবার আরেক পক্ষ বিএনপিকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, একটি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি বিএনপি’র বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবের ছাত্রনেতাদের কাজে লাগাচ্ছে এই বলে যে দলটির সাহায্য নিয়ে হাদিকে গুলি করার কাজে জড়িত। তবে দ্রুত মূল হত্যাকারী সনাক্ত হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি বদলে যায়। কারো কারো মতে, দ্রুত হত্যাকারী সনাক্ত হলে বিএনপি-জামায়াত-জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে বলা যায় দেশ মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়তো যা পতিত সরকারের যড়যন্ত্রকারী এলিট গ্রুপ ছক কষেছিল বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। 

ভারত বিরোধিতাকে কাজে লাগিয়েছে একটি পক্ষ

এদিকে হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়াতে একটি পক্ষ ভারত বিরোধিতাকেও দ্রুত কাজে লাগিয়েছে। এমনিতেই আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধী বক্তব্যের কারণে শরিফ ওসমান হাদি সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ছিলেন হাদি। তাই ধরেই নেওয়া হয় যে হাদি হত্যার পেছনে কোনো প্রতিবেশী দেশের সক্রিয় সমর্থন বা সহযোগিতা আছে। তা-ই যখন দেখা যায় কেউ কেউ হাদির খুনীরা নির্বিঘ্নে একটি প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রমাণাদি উপস্থাপন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরেন তখন পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠে। হাদির মৃত্যুকে ঘিরে বলা যায় ঢাকা-দিল্লি চলমান উত্তেজনায় আরও ইন্দন জোগায়। অথচ এখন শোনা যাচ্ছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকারী ফয়সাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই বলে জানান অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার রফিকুল ইসলাম। এমনকি কারো কারো ভাষ্যে এটা বলা হচ্ছে যে, ওসমান হাদির হত্যাকারী ভারতে পালিয়ে গেছে এটি নিশ্চিত না। এখানে অনেকে মধ্যে এমন প্রশ্ন জাগছে বা সন্দেহ তীব্র হচ্ছে যখন ফেসবুকে ইনকিলাব মঞ্চের ভেরিফাইড পেজে দেওয়া এক পোস্টে দাবি জানানো হয় যে তারা ‘বন্দুক যুদ্ধের কোনো নাটক দেখতে চায় না।’ তাহলে কি হাদির হত্যাকারীরা দেশেই আছে? এমন প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে সর্বত্র। অন্যদিকে অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার রফিকুল ইসলামের কাছে হাদির খুনীদের ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই- এমন দাবিকেও অনেকে মানতে নারাজ। তাদের মতে, কোনোভাবেই বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা এতো দুর্বল না যে হাদির হত্যাকারীদের অবস্থান সর্ম্পকে তাদের কাছে তথ্য থাকবে না। 

তারেক ও নির্বাচন ঠেকাও

আরেকটি সূত্র জানায়, ডিসেম্বরের শেষেই বিএনপি’র ভারপ্রপাপ্ত চেয়ারাপারসন তারেক রহমান দেশে ফিরছেন। যা মোটামুটি সব মহলে প্রচার হয়ে যায়। তারেক রহমান দেশের মাটিতে আসার অর্থই হচ্ছে কয়েকটি পক্ষের জন্য নেতিবাচক বার্তা। পতিতদের পক্ষের লোকেরা মনে করে তারেক রহমান দেশে না আসলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করেই সামনের দিকে নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি করা যেতো। তাই তারেক রহমান যেনো দ্রুত দেশে ঢুকতেই না পারেন সেজন্য ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি মতো নেতাদের টার্গেট করা হয়। আবার এমন কথাও শোনা গেছে নিজ দেশে ফিরে আসা নিয়ে বিএনপি’র পক্ষ গণসংবর্ধনা প্রশ্নবিদ্ধ করতেও বা তা ঠেকিয়ে দিতে এধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। জানা গেছে, ডিসেম্বরের ২৮ তারিখে তারেক তারেক রহমানের দেশে ফেরার নিদিষ্ট দিন ছিল। কিন্তু হাদির মারা যাওয়ার পর তিনি তার দেশে আসা ২৫ তারিখ নির্ধারণ করেন। আবার কারো কারো মতে, হাদি মারা যাওয়ার পরপর ভয়াবহ সহিংসতার পেছনে আরও কারণও ছিল। জুলাই বিপ্লবীদের বিতর্কিত সমালোচিত করতেও এটা ঘটানো হয়েছে বলে তাদের ধারণা। 

প্রতিবাদে ও রুখে দাঁড়ানোয় বিপাকে যড়যন্ত্রকারীরা

তবে ওসমান হাদির পর অস্বাভাবিক সহিংসতা ও এর বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদ পুরো পরিস্থিতিকে অন্য দিকে টার্ন নিয়ে নেয়। কারো কারো মতে, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি করে মারার পরের ঘটনাবলী আরেক দিক থেকে দেখলে বোঝা যায় যে এধরনের ঘটনা ঘটিয়ে এর বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির পেছনেও অনেক কিছু আছে। যেমন কারো কারো মতে, হাদির মারা যাওয়ার পরপর সহিংসতা করে জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনকে বিতর্কিত করতেও আবার একটি মহল তৎপর ছিলো। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে ব্যর্থ প্রমাণের জন্য আজও বিভিন্ন স্থানে হামলার এবং বিভিন্নস্থানে ভ্যান্ডিলিজম (সরকারি-বেসরকারি সম্পদ ধ্বংস) করার জন্য এক ধরনের পরিকল্পনাও সব কিছুর পাশাপাশি ছিলো। বিচ্ছিন্ন উগ্রগোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত সকল প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ়তার দলমত নির্বিশেষে সতর্ক থাকার কারণে সে পরিকল্পনা আপাতত ব্যর্থ হয়েঝে বলে কারো কারো ধারণা।

শেয়ার করুন