২০ মে ২০১২, সোমবার, ০৫:৩১:১৭ পূর্বাহ্ন


আন্তর্জাতিক চাপে বিএনপির মহাসমাবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হলো সরকার
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-১২-২০২২
আন্তর্জাতিক চাপে বিএনপির মহাসমাবেশ ঠেকাতে ব্যর্থ হলো সরকার ঢাকায় বিএনপির গণসমাবেশ


আর্ন্তজাতিক চাপে রাজধানীতে বিএনপি’র ঢাকা মহাসমাবেশ ঠেকাতে শেষমেষ ব্যর্থ হয়ে যায় সরকার। দেশী-বিদেশী চাপে পরে সরকারকে একেবারে শেষ পর্যায়ে তাদের কঠোর অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করেছে।  আর একারণে বিএনপিকে রাজধানীর গোলাবাগ মাঠে তাদের মহাসমাবেশ করতে অনুমতি দেয় সরকার। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। 

সরকারের যে টার্গেট ছিল..

রাজধানীতে বিএনপি’র মহাসমাবেশ ছিল গত ১০ ডিসেম্বর। দলটি এ কর্মসূচি পালনে নয়া পল্টনস্থ তাদেরই দলের কার্যালয়ের সামনের স্থানটি বেছে নেয় প্রথমে। কিন্তু সরকার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা তুরাগ নদীর পাড়েসহ বেশ কয়েকটি স্থান দলটিকে বেছে নিতে পরামর্শ দেয়। কিন্তু বিএনপি একপর্যায়ে তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে সমাবেশের স্থান না চেয়ে একটু সরে এসে মতিঝিল বা আরামবাগ চায়। কিন্তু সরকার কোনোভাবেই এতে রাজি হয়নি। ফলে বিএনপি সমাবেশের আগেই নয়া পল্টনে সমাবেশ করতে উদ্যোগী হয়, অনড় থাকে বলা চলে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকার আসলে বিএনপি’কে তাদের মহাসমাবেশ রাজধানীতে করতেই দিতে চায়নি নানান কারণে। তাদের আশঙ্কা বিএনপি তাদের দলীয় কার্যালয়ের সামনে এমন মহাসমাবেশ অন্য কোনো গোপন উদ্দেশেই করতে চাইছে? সরকারের মধ্যে সন্দেহের ডালপালা মেলে এই বলে যে বিএনপি ১০ ডিসেম্বরের সরকারের বিরুদ্ধে পতনের আন্দোলন করতে চায় এক্ষুনি। তাছাড়া সরকারের কাছে খবর চলে আসে এই বলে যে বিএনপি’র ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের আগেই রাজধানীতে প্রায় লাখ খানেক লোক বাইর থেকে নিয়ে চলে এসেছে। অর্থ্যাৎ রাজধানীতে মহাসমাবেশের আগেই কয়েক লাখ বিএনপি’র নেতাকর্মী রাজধানীতে ঢুকে গেছে। এমন খবরে সরকারের মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়, বিএনপি হয়তবা বড়ো ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে ১০ ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে। আবার সরকারের মধ্যে এমন ধারণাও আসে যে এই মহাসমাবেশে বিএনপি হয়তবা কিছুই করবে না ঠিক। কিন্তু তাদেরকে সুকৌশলে ব্যবহার করে অন্য কোনো পক্ষ হয়তবা সরকারের পতনের একটি গ্রাউন্ড তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে সাবোটাস করতে পারে বিএনপি’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে তৃতীয় কোনো পক্ষ। আর এজন্য সরকার কোনোভাবেই ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশটি রাজধানীতে হতে দিতে চায়নি। তারা এটি ঠেকাতে যা যা করার তাই করতে চেয়েছিল। 

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন এ্যাকশন..

বিএনপি’র সমাবেশ ঠেকাতে আওয়ামী গর্জে উঠে তখন থেকে যখন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে একটি বক্তব্য দেয়া হয়। ১০ ডিসেম্বরের তিনদিন আগে বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫ সাল থেকে আমরা মার খাচ্ছি। আর মার খাওয়ার সময় নেই। যে হাত দিয়ে মারতে আসবে, সে হাত ভেঙে দিতে হবে।’ তিনি সারা দেশে দলের প্রত্যেক নেতা-কর্মীকে মাঠে সতর্ক অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। জানা গেছে, তার এমন বক্তব্যের পর থেকে মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী বিএনপি’র সব ধরনের কর্মসূচি ঠেকাতে মাঠে নেমে পড়ে। মূল টার্গেটই ছিল বিএনপি’র সমাবেশ না করতে দেয়া। তবে প্রধানমন্ত্রী হুংকারে এটি আরো তেজ পায়। এসব তথ্য জানা গেছে, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের শীর্ষ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে।

সে হিসাবে ১০ ডিসেম্বরের আগেই সরকারি দল আওয়ামী লীগ নানান ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এর মধ্যে একদিকে যেমন ছিল রাজনৈতিক পদক্ষেপ অন্যদিকে কঠোর ছিল প্রশাসনিকভাবে। রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ রাজধানীতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে সভা সমাবেশ করে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রস্তুত রাখে। অন্যদিকে প্রশাসনিকভাবে আইন শৃংখলা বাহিনীকে দিয়ে পুরো রাজধানী ধরপাকড়ে ব্যস্ত রাখে অভিযান পরিচালনার নামে। বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালানো হলে বিএনপি’র নেতাকমীরা বলা চলে এধরনের আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। রাজধানীর গোলাপবাগে বিএনপির গণসমাবেশে সরকার অনুমতি দেয়ার পর একে কেন্দ্র করেও মহানগরীর অলিগলি দখলে রেখেছিল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খন্ড খন্ড মিছিল, সমাবেশ, অস্থায়ী মঞ্চ বানিয়ে বক্তৃতা, শান্তির সংহতির ব্যানারে নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠেই ছিল ক্ষমতাসীন দলটির নেতা-কর্মীরা। সরকারের একের পর এক পদক্ষেপের মুল টার্গেটই ছিল যে কোনো ইস্যুতে ১০ ডিসেম্বর সমাবেশ থেকে বিএনপি দূরে সুরিয়ে রাখা। 

ঘটনার নাটকীয় মোড়...

কিন্তু সরকারের কঠোর মনোভাব ও পদক্ষেপে ছেদ পড়ে রাজধানীতে মহাসমাবেশের আগে ৭ ডিসেম্বরের য়াপল্টনে বিএনপির নেতা–কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ও নিহতের ঘটনা। ওই দিনে সকাল থেকেই নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে দলটির নেতা-কর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। একপর্যায়ে জমায়েত বড় হয়ে রাস্তার এক পাশ বন্ধ হয়ে যায়। আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের সরিয়ে দিতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশ শটগানের গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় অনেকে আহত হন। মারা যায় একজন। এর পাশাপাশি ওইদিন বিকেল সোয়া চারটার দিকে পুলিশ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযানও মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া..

পল্টনের এমন ঘটনায় দেশে বিদেশে তোলপাড় শুরু হযে যায়। দেখা গেছে, ঘটনার পরপরই রাতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত থেকে নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে জাতিসংঘের মতো জায়গা থেকে বিবৃতি চলে আসে।  এসময় বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দপ্তর হোয়াইট হাউস বলেছে, তারা বিষয়টি ‘খুব, খুবই গভীরভাবে’ পর্যবেক্ষণ করছে। চলমান উত্তেজনার মধ্যে এ বিষয়ে প্রথম কথা বলে হোয়াইট হাউস। এর আগে অবশ্য দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ঢাকায় তাদের রাষ্ট্রদূত এ বিষয়ে তাদের অবস্থান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর নৃশংস হামলা চালানো হয়েছে। এদিকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এর আগে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হয়রানি ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস ওয়াশিংটনে ব্রিফিংয়ে বলেন, বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের ওপর কড়াকড়ি আরোপের ঘটনা নিয়ে তাঁর দেশ উদ্বিগ্ন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, ‘আইনের শাসনের প্রতি সম্মান দেখাতে এবং সহিংসতা, হয়রানি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে আমরা সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানাই।’ অন্যদিকে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর নিপীড়ন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

শেষ কথা

একের পর এক প্রতিক্রিয়া এতো দ্রুত আসতে থাকে সরকার থমকে যায়। সরকারের বিভিন্ন সংস্থাও বেশ সর্তকতার সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। এবং তড়িৎ ব্যবস্থা নিতে অর্থ্যাৎ সরকারকে নমনীয় হতে পরামর্শ দেন। সে হিসাবে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে আর হার্ড লাইনে না গিয়ে নমনীয় হতে দেখা যায়। এতে করে  সরকার বুঝতে পার বিএনপি’র ১০ ডিসেম্বরকে কঠোরভাবে রুখে দিতে গিয়ে দেশে বিদেশে মারাত্মক ইমেজ সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে সরকার। তাই বিএনপি’কে গোলাপবাগ মাঠে বিএনপি’কে সমাবেশ করতে দিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে চলমান উত্তপ্ত রাজনীতির অঙ্গনকে শান্ত করা হয়।

শেয়ার করুন