০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৩:৫৭:৪৫ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


ঠুনকো জ্বালানি নিরাপত্তা
খন্দকার সালেক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৫-২০২৩
ঠুনকো জ্বালানি নিরাপত্তা


তথাকথিত মখা মহা ঘূর্ণিঝড় মহাআতঙ্ক ছড়িয়ে সীমিত প্রভাব বিস্তার করে বিদায় নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের মূলকেন্দ্র শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ থেকে মায়ানমারের দিকে সরে যাওয়ায় বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে রক্ষা পেয়েছে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ এবং কক্সবাজার উপকূল। তবে সবচেয়ে দুর্ভোগে পড়েছে দেশবাসী মহেশখালী উপকূলে থাকা দুটি এলএনজি সরবরাহকারী ভাসমান টার্মিনাল থেকে সরবরাহ স্থগিত করায়। সারা দেশে তীব্র বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকাসহ গ্যাস ফ্রাঞ্চাইজ এলাকায় গ্যাস দুর্ভিক্ষে কষ্ট পেয়েছে ব্যাবহারকারীরা। জানা গেছে স্থানীয় কোম্পানি সামিট পরিচালিত ভাসমান টার্মিনাল যথাস্থানে থাকলেও, মার্কিন কোম্পানি এক্সেলেরেট পরিচালিত টার্মিনালটি গভীর সাগরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। 

৬০০-৭০০ এমএমসিএফডি এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ধস নামে। চট্টগ্রাম এলাকায় গ্যাস সরবরাহ শূন্যের কোঠায় চলে যায়। ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকা মহাসংকটে পরে। জানি না ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভাসমান টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ স্থগিত করা অপরিহার্য ছিল কিনা। জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলছেন, একটি টার্মিনাল থেকে এলএনজি সরবরাহ শুরু করতে ১৫ দিন লাগতে পারে। কিন্তু কেন? টার্মিনালটি যথাস্থানে ফিরে আসলে সরবরাহ ব্যবস্থায় সংযুক্ত হতে এতো সময় কেন লাগবে? বিষয়টি জনগণকে জানানো উচিত। 

যাক সেই প্রসঙ্গ। ক্রমাগত আমদানিকৃত জ্বালানিনির্ভর হতে থাকা বাংলাদেশে জ্বালানি নিরাপত্তা কতটা ঠুনকো সেটি আবারো প্রমাণ হয়ে গেলো। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল হওয়ার পথের দেশের অর্থনীতি কখনো আমদানিকৃত জ্বালানিনির্ভর হতে পারবে না। সেটি দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন থেকেই বলে আসছেন। কিন্তু তোলেনি সরকারের মহাজ্ঞানী উপদেষ্টা এবং পরিকল্পনাবিদরা, যার ফলশ্রুতিতে কখনো বিশ্ব জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা, কখনো বৈষয়িক ভূরাজনীতির অশুভ প্রভাব আবার কখনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জ্বালানি নিরাপত্তা নাজুক হয়ে পড়ছে। ২৫ হাজারের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও মূলত জ্বালানি সরবরাহ ক্ষমতার অপ্রতুলতার কারণে চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে জ্বালানি, বিদ্যুৎসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো।


ভুল সিদ্ধান্তে নিজেদের কয়লাসম্পদ মাটির নিচে, দুর্বল ব্যাবস্থাপনার কারণে পর্যাপ্ত গ্যাস তেল অনুসদ্ধান হয়নি জলে-স্থলে। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর পরিকল্পনা সবই ফাঁকা বুলি। জ্বালানি বিদ্যুৎ নিরাপত্তা না থাকলে কোনো ভরসায় দেশে বিনিয়োগ করবে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী? কীভাবে বাংলাদেশ অর্জন করবে ২০২৬, ২০৩০, ২৯৪১ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভিশন? এখন কি সরকারের উপদেষ্টারা অনুভব করেন নিজেদের জ্বালানির অনুসন্ধান না করা মহাভুল হয়েছে? প্রযুক্তি বিপ্লবের যুগে কেউকি মহামূল্যবান কয়লা সম্পদ মাটির নিচে ফেলে রাখে? কেন বাংলাদেশ ২০০৯-২০২৩ জলে-স্থলে গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর ভূমিকা নিলো না? কেন বঙ্গবন্ধুর স্বনির্ভর জ্বালানি সেক্টরের মূলমন্ত্র ভুলে গেল? 

সবচেয়ে বড় সংকট এখন কয়লা, তরল জ্বালানি, এলএনজি কেনার বৈদেশিক মুদ্রা জোগান দেওয়া, দেশে কর্মরত আইপিপি, আইওসিদের বৈদেশিক মুদ্রায় দেনা পরিশোধ। ২০২৩ শেষ অথবা ২০২৪ শুরুতে আসছে নির্বাচন। জনগণকে জ্বালানি অনিরাপদ অবস্থানে রেখে নির্বাচনে গেলে জনগণ কি করবে? পরবর্তী সরকার সেটা যেই আসুক না কেন, রানিং আওয়ামী লীগ সরকার বা অন্য কেউ। তাকে সূচনা থেকেই বিপুল জ্বালানি সংকট নিয়ে হিমশিম খেতে হবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।



বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি বিদ্যুতের সম্ভাবনা  

কার্বন নিঃসরণজনিত উষ্ণায়নের কারণে বিশ্ব জ্বালানি ব্যবহার এখন জীবাষ্ম জ্বালানি থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। বাংলাদেশের কার্বন ফুটপ্রিন্ট সামান্য তথাপি  মূলত জীবাষ্ম জ্বালানিনির্ভর বাংলাদেশকেও দ্রুত একটি পরিকল্পনার অধীনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পথে ধাবিত হতে হবে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ আবহাওয়া পরিবর্তনের নির্মম শিকার।  যখন লিখছি তখন মখা নামের একটি সুপার সাইক্লোন ধেয়ে আসছে বাংলাদেশে মহাতঙ্কের বার্তা নিয়ে। অন্যদিকে নিজেদের জ্বালানি-কয়লা, গ্যাস উত্তোলনে দ্বিধাগ্রস্ত বাংলাদেশ আমদানিকৃত জ্বালানিনির্ভর হয়ে জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত করে ফেলেছে। বাংলাদেশের সুযোগ আছে সৌর, বায়ু বিদ্যুৎসহ সব ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে বাড়ানোর। প্রধানমন্ত্রী নিজে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি। উনি অঙ্গীকার করেছেন ২০৫০ নেট জিরো অর্জনের। বলেছেন বাংলাদেশ ২০৪১ নাগাদ ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সংস্থান করা হবে।


প্যারিস সামিটের স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে বাংলাদেশ এনডিসি জমা দিয়েছে। এনডিসি অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৩০ নাগাদ ৫ শতাংশ নিঃসরণ নিজেদের অর্থায়নের এবং ২৫ শতাংশ নিঃসরণ বিদেশি অর্থায়নে কমানোর অঙ্গীকার করেছে। বাংলাদেশের নিজস্ব নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি আছে যেটি পরিবর্তন করা হচ্ছে। ২০১০, ২০১৬ পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান পরিবর্তনের পর এখন সমন্বিত জ্বালানি বিদ্যুৎ মাস্টার প্ল্যান আইএইপিএমপি হচ্ছে। বাংলাদেশ জ্বালানির টেকসই নিরাপত্তার জন্য অবশ্যই সকল পরিস্থিতির মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। ২০৩০ উন্নয়নশীল দেশ এবং ২০৪১ উন্নত অর্থনীতির দেশ হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা পরিকল্পনা এবং সঠিক বাস্তবায়ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। বিশেষত সব ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্ভাবনা বাস্তবায়ন জরুরি।  


আমরা দেখছি, নিজেদের জ্বালানি জোগান কমে যাওয়া এবং আমদানিকৃত জ্বালানি ব্যবহারের নানাবিধ চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা এখন হুমকির মুখে। অদূর ভবিষ্যতে ফসিল ফুয়েল নির্ভর জ্বালানি সরবরাহ পরিস্থিতি উন্নত হবার সম্ভাবনা সীমিত। সরকারের পক্ষে বিপুল পরিমাণ সাবসিডি দেয়া অথবা জ্বালানি মূল্য বাজারনির্ভর করা কোনোটাই সহজ না। তবে সঠিক পরিকল্পনা করে ৩-৫ বছরের বদ্ধে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য খাত থেকে সংস্থান সম্ভব। 

বাংলাদেশের বাস্তবতায় সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সৌর বিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎ, ক্ষেত্রবিশেষে উভয়ের হাইব্রিড। একসময়ের অপেক্ষাকৃত উঁচু খরচের সৌরবিদ্যুৎ টেকনোলজি এখন প্রতিযোগিতা মূল্যে পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের বায়ু বিদ্যুৎ সম্ভাবনা নিয়ে উইন্ড ম্যাপিং সোহো কিছু সমীক্ষা করা হলেও আরো বিস্তারিত সমীক্ষা প্রয়োজন। চরাঞ্চল, দ্বীপ এবং উপকূল এলাকায় বায়ুবিদ্যুৎ সম্ভাবনার কথা ডেল্টা প্ল্যান এবং মুজিব ক্লাইমেট সম্ভাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

বলা হয় গ্রিড সোলার প্লান্টের জন্য প্রয়োজনীয় জমির অভাব বাংলাদেশে।  বাংলাদেশ অন্তত ১০টি আমদানিকৃত কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ প্লান্ট পরিকল্পনা বাতিল করেছে। মাতারবাড়ি, মহেশখালী, পায়েরা, রামপাল এলাকায় বেশ কিছু জমি গ্রিড সোলার বিদ্যুতের জন্য বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। বিশাল সম্ভাবনা আছে ছাদের ওপর সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে নেট মিটারিং সুবিধা নেয়ার। শিল্প-কারখানাসমূহের ছাদ, উঁচু অট্টলিকা, সরকারি হাসপাতাল, অফিস আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে একটি বিশেষ পরিকল্পনার অধীনে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির মাইক্রো টারবাইন ব্যবহার করে শহর অঞ্চলের উঁচু ছাদে বায়ু বিদ্যুৎ এবং সৌরবিদ্যুৎ হাইব্রিড হতে পারে। 

বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য গ্রিড বিদ্যুৎ এবং ডিজেল ব্যবহার হয় সেচ কাজে। সোলার সেচ কাজ শুরু হলেও গতি পায়নি বাণিজ্যিক মডেল তৈরি না থাকায়। এখন নেট মেটারিঙের সুযোগ নিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে সোলার সেচ ব্যাবস্থাকে গ্রিড সংযুক্ত করা যেতে পারে। সঠিক বাণিজ্যিক মডেল করা হলে  সোলার সেচ এবং রুফ টপ সোলার ক্ষেত্রে দেশি বিদেশী ব্যাক্তি খাত এবং উন্নয়ন সহযোগীদের বিনিয়োগ পাওয়া যাবে।  নবায়ন যোগ্য জ্বালানি খাত থেকে দ্রুত সুবিধা পেতে হলে নিম্ন বর্ণিত বিষয় গুলো জরুরি নজর দেয়া প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য জ্বালানি পলিসি, সমন্বিত জ্বালানি বিদ্যুৎ মাস্টার প্ল্যান অবশ্যই এনডিসি, সরকারের উন্নয়ন ভিশনের সঙ্গে সংগতি পূর্ণ হতে হবে। স্রেডাকে শক্তিশালী করে ওয়ান পয়েন্ট কন্টাক্ট করতে হবে। এই খাতের কাজগুলোর গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের দক্ষ করে তুলতে হবে। নবায়ন যোগ্য জ্বালানি খাতকে উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রে বিশেষ রেয়াত দিতে হবে। নবায়ন যোগ্য জ্বালানির ট্যারিফ পর্যালোচনা করে তুলনামূলক ফসিল ফুয়েলের কাছাকাছি রাখতে হবে  সর্বোপরি নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।

শেয়ার করুন