যুক্তরাষ্ট্রে ১ অক্টোবরে শুরু হওয়া ফেডারেল সরকার শাটডাউন অভিবাসন ব্যবস্থার ওপর একাধিক মাত্রায় প্রভাব ফেলেছে। কংগ্রেস ২০২৬ অর্থবছরের বাজেট পাসে ব্যর্থ হওয়ায় ১ অক্টোবর থেকে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম আংশিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে শত শত ফেডারেল কর্মচারী ছুটিতে যেতে বাধ্য হন, আবার অনেককে বেতন ছাড়াই কাজ চালিয়ে যেতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে যখন ফেডারেল সরকার শাটডাউন পরিস্থিতির মুখে পড়ে, তখন তার প্রভাব অভিবাসন-ব্যবস্থার ওপর জোরালোভাবে পড়ে। বাজেট না পাস হওয়ার কারণে অনেক সরকারি সংস্থা তাদের কাজ সীমিত বা স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়। এর ফলে ইমিগ্রেশন আদালত থেকে শুরু করে ভিসা প্রক্রিয়াকরণ, আশ্রয় আবেদন এবং সীমান্ত নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিলম্ব ও অসুবিধা দেখা দেয়। শাটডাউনের সময় অভিবাসন সংস্থাগুলোর কার্যক্রম কীভাবে প্রভাবিত হবে এবং এর ফলে অভিবাসী, আশ্রয়প্রার্থী ও সংশ্লিষ্টদের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, তা বিশেষ গুরুত্ব পায়।
তবে শাটডাউনের প্রভাব প্রতিটি সংস্থার অর্থায়ন কাঠামো এবং কার্যক্রমের ধরন অনুযায়ী ভিন্ন। বিশেষ করে ইমিগ্রেশন-সংক্রান্ত সংস্থাগুলোর মধ্যে আইস, ইউএসসিআইএস, ইমিগ্রেশন কোর্ট, কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন, পররাষ্ট্র দফতর এবং শ্রম দফতর-এসব সংস্থার কার্যক্রম কতটা সচল থাকবে বা বিলম্বিত হবে, তা নির্ভর করছে তাদের নিজস্ব তহবিল উৎস এবং ‘অপরিহার্য’ হিসেবে বিবেচিত কাজের ওপর। ফলে শাটডাউন পরিস্থিতি অভিবাসী, আশ্রয়প্রার্থী, বিদেশি কর্মী ও নিয়োগকর্তাদের জন্য অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগের পরিবেশ তৈরি করেছে।
এ শাটডাউনের ফলে প্রায় ৮ লাখ ৩ হাজার ফেডারেল কর্মচারী ছুটিতে চলে যান এবং আরো ৭ লাখ কর্মচারী বেতন ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য হন। তবে অভিবাসন সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে প্রভাবের মাত্রা সংস্থার তহবিলের উৎস এবং কার্যক্রমের ধরেেনর ওপর নির্ভর করে ভিন্নতা দেখা দেয়। বিশেষভাবে এ শাটডাউনে আইস, ইউএসসিআইএস, ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন, ই-এক্সিকিউটিভ অফিস ফর ইমিগ্রেশন রিভিউ, ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট এবং ডিপার্টমেন্ট অব লেবার-এর কার্যক্রমের ওপর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস)
আইসি প্রধানত অপরিহার্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে বিবেচিত। শাটডাউনের সময়ও আইসের গ্রেফতার, রেইড, ডিটেনশন এবং ডিপোর্টেশন কার্যক্রম প্রায় অব্যাহত থাকে। ২০২৫ সালে আইসির প্রায় ২১ হাজার কর্মচারীর মধ্যে ১৯ হাজার ৬০০ জন অপরিহার্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তারা কাজ চালিয়ে যাবেন, যদিও বেতন প্রায়শই বিলম্বিত হতে পারে। আইসের কার্যক্রমে শাটডাউনের প্রভাব সীমিত হবে, কারণ সংস্থার জন্য ২০২৯ সাল পর্যন্ত ২৯ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। এটি তাদের কর্মসূচি, গ্রেফতার অভিযান, ডিটেনশন কেন্দ্র সম্প্রসারণ এবং ডিপোর্টেশন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সক্ষম করবে। তবে মানবাধিকার সংস্থা এবং অভিবাসন আইনজীবীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, শাটডাউনের সময় আইস আরো কঠোর হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ পরিবার বিচ্ছিন্নকরণ, আশ্রয়প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ে আক্রমণমূলক অভিযান চালানোর সম্ভাবনা রয়েছে। শাটডাউনের সময় আদালতের কার্যক্রম সীমিত হওয়ায় আইস তাদের অফিসারদের আরো বেশি সম্প্রদায়ভিত্তিক অভিযানে নিয়োজিত করতে পারে।
ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস
ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেস মূলত আবেদন ফি দ্বারা অর্থায়িত হওয়ায়, শাটডাউনের সময় সংস্থার অধিকাংশ কার্যক্রম অব্যাহত থাকে। ২০২৫ সালে ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেসের প্রায় ২২ হাজার ৪০০ কর্মচারীর মধ্যে ২১ হাজার ৫০০ জন কাজ চালিয়ে যাবেন। তবে কিছু প্রোগ্রাম, যেমন ই-ভেরিফাই এবং কনরাড ৩০ (একটি ফেডারেল প্রোগ্রাম, যার মাধ্যমে জে-১ ভিসাধারী বিদেশি চিকিৎসকরা গ্রামীণ বা চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত এলাকায় কাজ করার শর্তে ২ বছরের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পেতে পারেন) স্থগিত থাকবে। এছাড়া ডিপার্টমেন্ট অব লেবার সম্পর্কিত প্রক্রিয়া যেমন এইচ-১বি ভিসার জন্য লেবার কন্ডিশন অ্যাপ্লিকেশন প্রক্রিয়া শাটডাউনের কারণে বিলম্বিত হতে পারে। এই বিলম্ব নিয়োগকর্তাদের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করবে এবং কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি কর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের সময়সীমায় প্রভাব ফেলবে।
শাটডাউনের সময় ইউএস সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন সার্ভিসেসের কিছু ছোট খাত, যেমন-স্পেশাল ভিসা, নির্দিষ্ট আবেদন প্রক্রিয়া বা নাগরিকত্ব অনুষ্ঠান সাময়িকভাবে বিলম্বিত হতে পারে। তবে সংস্থার প্রধান কার্যক্রম, যেমন আবেদন গ্রহণ, বায়োমেট্রিক প্রক্রিয়াকরণ এবং সাক্ষাৎকার পরিচালনা প্রায় স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকবে।
ইমিগ্রেশন কোর্ট
ইমিগ্রেশন কোর্ট শাটডাউনের সময় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়, কারণ এটি কংগ্রেসনাল তহবিল দ্বারা পরিচালিত। ‘নন-ডিটেইনড’ কেস স্থগিত করা হয়, যা বিচার প্রক্রিয়ার বিলম্বের কারণ হতে পারে। ২০১৯ সালের শাটডাউনের সময় প্রায় ৮০ হাজার থেকে ৯৪ হাজার মামলা স্থগিত হয়েছিল। বর্তমানে ৩ দশমিক ৪ মিলিয়নেরও বেশি মামলা পেন্ডিং রয়েছে। তাই বর্তমান শাটডাউনের সময় বিলম্ব আরো বৃহৎ হতে পারে। ‘ডিটেইনড’ কেসের শুনানি অব্যাহত থাকবে, যাতে আটকপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া বন্ধ না হয়।
শাটডাউনের সময় আদালতের কার্যক্রম সীমিত হলে আইসের কার্যক্রমের ধরন পরিবর্তিত হতে পারে। আদালতে গ্রেফতার কমে গেলে আইস অফিসারদের সম্প্রদায়ে বা নির্দিষ্ট কোর্ট চেক-ইন স্থলে গ্রেফতার অভিযান চালাতে হতে পারে। এটি সংস্থার কার্যক্রমে নতুন ধরনের চাপ এবং সামাজিক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।
ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন
ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের আইন প্রয়োগ কার্যক্রম শাটডাউনের সময় অপরিহার্য হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় অব্যাহত থাকবে। তবে কিছু সহায়ক কর্মচারী কাজ থেকে অস্থায়ী বিরতিতে যেতে পারেন, যা সীমান্তে কিছু বিলম্ব সৃষ্টি করতে পারে। ২০২৫ সালে ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের প্রায় ৮ শতাংশ কর্মচারী ছুটিতে যেতে পারেন। শাটডাউনের সময়ও সীমান্তে নিরাপত্তা, নিয়মিত চেকপয়েন্ট কার্যক্রম এবং অভিবাসী প্রবেশ প্রক্রিয়ায় মূল কার্যক্রম চালু থাকবে। তবে নতুন ভিসা বা সীমান্ত সম্পর্কিত আবেদন প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হতে পারে।
ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট
ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের কার্যক্রম কিছুটা প্রভাবিত হতে পারে। কারণ এটি কংগ্রেসনাল তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। শাটডাউনের সময় কিছু দূতাবাস শুধু জরুরি বা কূটনৈতিক ভিসা প্রদান করতে পারে। অন্যান্য ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে এবং এটি অভিবাসী ও নিয়োগকর্তাদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে। তবে প্রধান কনস্যুলার সেবা, যেমন জরুরি পাসপোর্ট প্রদান, সাধারণভাবে চালু থাকবে।
সামগ্রিক প্রভাব ও সামাজিক প্রভাব
২০২৫ সালের শাটডাউনের সময় অভিবাসন সংস্থাগুলোর কার্যক্রম অন্যান্য ফেডারেল সংস্থার তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম প্রভাবিত হয়েছে। তবে আইসের ক্রমবর্ধমান গ্রেফতার এবং ডিপোর্টেশন কার্যক্রম, ইমিগ্রেশন কোর্টের স্থগিতাদেশ এবং ইউএসসিআইসের কিছু প্রক্রিয়ার বিলম্ব সামাজিক ও মানবিক প্রভাব ফেলতে পারে। অভিবাসীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি পায়, পরিবার বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকি বাড়ে এবং নিয়োগকর্তাদের জন্য কর্মী নিয়োগে জটিলতা তৈরি হয়।
ভবিষ্যতে, কংগ্রেস যদি একটি ক্রমাগত তহবিল চুক্তিতে পৌঁছে, তবে ২০২৬ অর্থবছরের জন্য অভিবাসন সংস্থাগুলোর তহবিল বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রম আরো সুসংহতভাবে চালাতে পারবে এবং প্রক্রিয়ার ব্যাকলগ কমাতে সক্ষম হবে। তবে বর্তমান শাটডাউনের অভিজ্ঞতা দেখাচ্ছে যে, ফি-ভিত্তিক সংস্থা যেমন-ইউএসসিআইস কিছুটা স্বচ্ছল থাকলেও কংগ্রেসনাল ফান্ডিং-নির্ভর সংস্থা যেমন ই-এক্সিকিউটিভ অফিস ফর ইমিগ্রেশন রিভিউ, ডিপার্টমেন্ট অব লেবার এবং কিছু ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।
শাটডাউনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন ব্যবস্থা একটি পরীক্ষার মুখে পড়েছে, যা দেখিয়েছে প্রশাসনিক প্রস্তুতি, অর্থায়ন এবং কার্যক্রমের প্রকারভেদ কীভাবে শাটডাউনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি সংস্থা, কর্মী এবং আবেদনকারীর জন্য প্রভাবের মাত্রা ভিন্ন, যা সামাজিক, মানবিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।