বিএনপিতেই ভরসা এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। এর পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও মূলত বিএনপি’র ওপরই ধীরে ধীরে আস্থা রাখতে শুরু করেছে। তারাও মনে করে দেশে বিদেশে বর্তমানে বিএনপি’র মতো দলের ব্যালান্স রাজনৈতিক ইমেজের শক্ত ভিত তৈরি হয়েছে। এটা পুঁজি করেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সামনে দিনে টিকে থাকার পাশাপাশি মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সাহায্য করবে। এমন সব খবর পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে।
বিএনপি’র ওপর ভরসার কিছু প্রমাণ
রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিনের থাকা না-থাকার প্রশ্নে অক্টোবরে দেশে মারাত্মক সংকট তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি বঙ্গভবনে থাকবেন নাকি পদত্যাগ করবেন, নাকি অপসারণ করা হবে তা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সেসময়ে চরম সিদ্ধান্তহীনতা ভোগে। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ফুসতে থাকেন, তাদের কণ্ঠে জোড়ালো হয় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ব্যাপারে। এরই মধ্যে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেই বসেন, ‘রাষ্ট্রপতি থাকবেন কি থাকবেন না, প্রশ্নটি এ মুহূর্তে বাংলাদেশে কোনো আইনি বা সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়। এটা একেবারেই একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’ তিনি জানান, সরকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে। তবে তিনি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানালেও রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ শুরু করে দেয়। এছাড়া দেখা যায় ওই সময়ে গভীর রাতে ইনকিলাব মঞ্চের ব্যানারে বঙ্গভবনের সামনেও বিক্ষোভ দেখানো হয়। একিইসাথে জাতীয় ঐক্যের জন্য শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের অংশ রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং এই রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার আহ্বানও জানিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি।
বেঁকে বসে বিএনপি চলে যায় বঙ্গভবনে
তবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবিতে মাঠ ফুসে উঠলেও অত্যন্ত ধীর স্থিরভাবে মাঠে অন্যতম প্রধান দল বিএনপি সাফ জানিয়ে দেয় যে, এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চায় না তারা। বিএনপি’র নেতারা মনে করেন, রাষ্ট্রপতি পদে শূন্যতা হলে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট তৈরি হবে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের বক্তব্যে পরিপ্রেক্ষিতে যখন দেশজুড়ে নানা আলোচনা ঝড় বইছে তখন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের সাথে বৈঠক করেন বিএনপির তিন নেতা। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহ্ উদ্দিন আহমেদ। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের নজরুল ইসলাম খান বলেছিলেন, ‘দেশে যাতে কোনো রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি না হয় সে বিষয়ে সবার খেয়াল রাখার কথা হয়েছে এবং যেটা যদি কেউ করতে চায় তাহলে আমরা সবাই মিলে সেটা মোকাবিলা করব। এব্যাপারে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায় বিএনপি’র হাইকমান্ড সেসময় মারাত্মক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি আচ করতে পেরে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলের মতো প্রধান উপদেষ্টার পাশে দা্ড়াঁন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুসও এটা চেয়েছিলেন। এজন্য রাষ্ট্রপতি অপসারণ প্রশ্নের ড. ইউনুসকে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক সহায়তার কথা জানিয়ে দেয় বিএনপি। আর সেদিন একমাত্র বিএনপি’র পক্ষ থেকে এমন অবস্থানের কারণে সেদিন দেশে একটি বড়ো ধরনের সাংবিধানিক সঙ্কট থেকে দেশ সর্বোপরি ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রক্ষা পায়।
আবারো পাশে দাঁড়ালো বিএনপি
এদিকে হঠাৎ করেই নভেম্বরের বেশ কয়েকটি দিন দেশজুড়ে নৈরাজ্যে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে দেশের সর্বস্তরের জনগণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন, কূটনৈতিক সম্পর্ক, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে নানান ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে মাঠ গরম হয়ে উঠে। এসময় ইসকন ইস্যুতেও মাঠ গরম হয়ে উঠলে পুরো সরকারের টালমাটাল পরিস্থিতিতে জনগণে হতাশা ফুটে উঠতে থাকে। কারো কারো আশঙ্কা দেখা দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশে আসলে শক্তিশালী কোনো দল নেই। নানামুখী চাপ মোকাবিলা ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মানুষের আকাঙ্খা বস্তবায়নে সরকার ব্যর্থ হতে চলেছে মনে করে জনগণ ধীরে ধীরে সমর্থন থেকে সরে আসছে। তাই সেসময়েও বিএনপি’র পক্ষ থেকে ড. ইউসুসের সাথে সাক্ষাৎ একটি শক্তিশালি রাজনৈতিক দলের অবস্থান বেশ কাজে দেয়। দেশের ঠিক এমন মুহূর্তেই আবারো অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে দা্ড়াঁয় বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টার কাছে ছুটে যান তারা। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘাত, হানাহানিসহ দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ২৭ নভেম্বর বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে উদ্বেগ জানিয়ে আসে বিএনপি। এর পাশাপাশি ড. ইউনুসের সাথে সে সাক্ষাৎ এ গিয়ে বিএনপি’র নেতাদের পক্ষ থেকে দাবি উঠে পরিস্থিতির উন্নতি করতে অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর হতে হবে। বলা হয় যখন-তখন রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন এবং বিশৃঙ্খলায় জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে করে সাধারণ মানুষ অনিরাপদ বোধ করছেন, যার প্রভাব ধর্মীয় ইস্যু এবং হুটহাট দাবিতে কূটনৈতিক সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ছে। আশঙ্কা কথা জাননো হয় যে, দেশে দ্রুত শৃঙ্খলা না ফিরলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। বলা হয় নৈরাজ্য দমনে শক্ত না হলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তির বিভেদে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থনে ‘তৃতীয় পক্ষ’ সুযোগ নিতে পারে। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হরো দলটির নেতারা বিভাজনের পথ এড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির কথা বলে আসেন। আর এরপরই জামায়াত নেতারা যমুনায় সরকার প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে জানান যে, বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের সঙ্গে তারাও একমত।
সেনাকুঞ্জে খালেদা..কি বার্তা ইউনুসের..
এদিকে সর্বশেষ আরেকটি ঘটনা রাজনীতিতে একটি বড়ো ধরনের বার্তা দিয়েছেন ড. ইউনুস। সেটি ছিল এক যুগ পর সেনাকুঞ্জে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা করেন তিনি। তারই একান্ত আন্তরিকতায় ছয় বছর পর প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা গেল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। আর এসময় দেখা গেলো সেনাকুঞ্জে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পাশের আসনে বসে তিনি উপভোগ করছেন সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। আর অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যোগদানের সুযোগ পাওয়ায় আনন্দ ও গর্ববোধ হওয়ার কথা জানিয়েও বক্তব্য দিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ড. ইউনূস বলেই ফেললেন, খালেদা জিয়া আজ এখানে আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন। এক যুগ ধরে তিনি এই মহাসম্মিলনীতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি। আজ সুযোগ পেয়েছেন। আমরা সবাই আনন্দিত এবং গর্বিত যে, আপনাকে (খালেদা জিয়াকে) এই সুযোগ দিতে পেরেছি। অন্যদিকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে যে সম্মান জানানো হয়েছে তাতে গোটা জাতি আনন্দিত বলে মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শীর্ষ নেতারা সেনাকুঞ্জে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকেই ঘিরে ছিলেন। জানা গেছে, ওইদিন সেনাকুঞ্জে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে এমন সন্মানের খবর মিডিয়ায় গুরুত্ব দিয়ে প্রচার পাওয়ায় জামায়াতের ইসলমী’র শীর্ষ নেতারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান ,তারা রাজনৈতিক ভাবেও একটি বড়ো ধরণের ধাক্কার আভাস পান।
বিএনপি’তেই আস্থা ও শেষ কথা
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন এসব ঘটনাই প্রমাণ করেন বিএনপিতেই ভরসা এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। দেশে বিদেশে বিএনপি’র বর্তমান ইমেজকে পুঁজি করেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সামনে দিনে টিকে থাকার পাশাপাশি মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়াতে সাহায্য করতে বিএনপি’ই এখন উপযুক্ত। ধারণা করা হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের খোদ প্রধান উপদেষ্ট ড. ইউসুসের ভরসা এখন মাঠের প্রধান শক্তিশালি দল বিএনপি। এর প্রধান কারণ বিএনপি’র বাংলাদেশের মাঠিতে কোনো সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী রাজনৈতিক দল হিসাবে চিহ্নিত হয়। যতটুকু হয়ে তা জামায়াতের মামে অতীতে গাঁটছাড়া বেঁধেই চলার কারণে। আর তাছাড়া এবার বিএনপি দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল, মতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যায়। বিএনপি’র এমন ইমেজে আস্থা রেখেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও মূলত এখন বিএনপি’র ওপরই ধীরে ধীরে আস্থা চলে আসছে বলে দৃশ্যমান হচ্ছে। বিএনপিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ’র পক্ষ থেকে দেয়া স্ট্যাটাসই বলে দেয় তারাও এখন ভরসা বিএনপি’র ইতিবাচক ভূমিকার কারণে। তারাও মনে করেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারকে বর্তমান দেশের মাটিতে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে বিএনপি’র সাংগঠনিক শক্তিশালী ভিতই ছাত্র-জনতার রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতে সহায়ক হবে। এমনসব খবর পাওয়া গেছে বেশ কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে।