০৩ অক্টোবর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:১৯:৩২ পূর্বাহ্ন


এক দশকে ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৮০ বাংলাদেশি গ্রিনকার্ড পেয়েছেন
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৯-২০২৫
এক দশকে ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৮০ বাংলাদেশি গ্রিনকার্ড পেয়েছেন গ্রিনকার্ড (প্রতীকী ছবি)


২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৮০ জন বাংলাদেশি গ্রিনকার্ড বা স্থায়ী বৈধ আবাসিক মর্যাদা অর্জন করেছেন। এ সংখ্যাটি শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং হাজারো পরিবারের স্বপ্ন, সংগ্রাম এবং নতুন জীবনের বাস্তবায়নের গল্প বহন করে। কেউ এসেছেন সন্তানদের জন্য উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করতে, কেউ নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায়, আবার কেউবা কর্মজীবনে নতুন সম্ভাবনার খুঁজে। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, মহামারি, রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অভিবাসন নীতির ওঠানামা সত্ত্বেও বাংলাদেশিদের আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসের আকাক্সক্ষা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে কোভিড-১৯-এ সৃষ্ট মন্দা কাটিয়ে ২০২৩ সালে এ সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানো অভিবাসী বাংলাদেশিদের দৃঢ়তা এবং স্থায়ী জীবনের প্রতি তাদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ১৪ হাজার ৩৪০ জন ল’ ফুল পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস লাভ করেন। এটি ছিল সে সময়ের তুলনায় স্থিতিশীল সূচনা। তবে ২০১৪ সালে কিছুটা হ্রাস পেয়ে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১৩ হাজার ২১০ জনে। যদিও এটি বড় ধরনের পতন নয়, তবুও অভিবাসন প্রবাহে সামান্য মন্দার ইঙ্গিত বহন করে।

২০১৫ সালটি বাংলাদেশিদের জন্য আশাব্যঞ্জক হয়ে ওঠে। ওই বছর রেকর্ডসংখ্যক ১৮ হাজার ২০০ জন বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ড লাভ করেন। অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি সম্ভব হয়েছিল পরিবারভিত্তিক অভিবাসন কর্মসূচির বিস্তৃতি এবং যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই বসবাসরত বাংলাদেশি অভিবাসীদের স্পনসরশিপ বৃদ্ধির কারণে। একই সঙ্গে ডাইভারসিটি ভিসা প্রোগ্রামের আওতায়ও সে সময় অনেক বাংলাদেশি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন।

কিন্তু ২০১৬ সালে আবারও পতন ঘটে। সে বছর গ্রিনকার্ড প্রাপ্তির সংখ্যা নেমে আসে ১৪ হাজার ২৫০ জনে। এর পেছনে মূলত যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নীতির পরিবর্তন, কঠোর স্ক্রিনিং প্রক্রিয়া এবং বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রভাব ফেলেছিল। ২০১৭ সালে বাংলাদেশি গ্রিনকার্ডধারীর সংখ্যা আবার কিছুটা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪১০ জনে। এ সময়ে ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসন নীতি কঠোর হলেও পরিবারভিত্তিক আবেদন এবং পূর্বে দাখিল করা কেসগুলো অনুমোদন পাওয়ায় এই সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

২০১৮ সালে প্রবণতা কিছুটা হ্রাস পেয়ে সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৮৯০ জনে। এটি তুলনামূলকভাবে মধ্যম পর্যায়ে ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে বাংলাদেশিদের গ্রিনকার্ড প্রাপ্তির সংখ্যা হঠাৎ কমে যায় এবং দাঁড়ায় মাত্র ৯ হাজার ১০ জনে। এটি ছিল গত এক দশকের অন্যতম বড় পতন। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তখনকার প্রশাসনিক জটিলতা, ভিসা ইস্যু প্রক্রিয়ার বিলম্ব এবং বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক উত্তেজনা এর মূল কারণ ছিল।

২০২০ সালে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রক্রিয়া প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলোতে সাক্ষাৎকার স্থগিত হয়, ভিসা প্রক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এর ফলে বাংলাদেশ থেকে গ্রিনকার্ড প্রাপ্তির সংখ্যা নেমে আসে ৬ হাজার ১৮০ জনে। এটি পুরো দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।

তবে ২০২১ সালে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ভিসা সাক্ষাৎকার এবং আবেদন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হলে বাংলাদেশ থেকে ১০ হাজার ১৪০ জন অভিবাসী গ্রিনকার্ড পান। এটি আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হলেও মহামারির পূর্ববর্তী পর্যায়ের তুলনায় এখনো কম ছিল।

২০২২ সালে বাংলাদেশিদের গ্রিনকার্ড প্রাপ্তির সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। সে বছর রেকর্ড ১৮ হাজার ২৪০ জন বাংলাদেশি ল’ ফুল পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস লাভ করেন। এটি পুরো এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যা। বিশ্লেষকদের মতে, পূর্বে জমে থাকা বিপুল পরিমাণ আবেদন সে বছর প্রক্রিয়াকরণ হওয়ায় হঠাৎ করে এ প্রবৃদ্ধি ঘটে।

২০২৩ সালের তথ্য এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পুরোপুরি প্রকাশিত না হলেও দেখা যাচ্ছে, সংখ্যা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে এবং প্রায় ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজারের মধ্যে রয়েছে। ফলে এক দশকের হিসাব করলে বোঝা যায়, বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসের প্রবণতা স্থিতিশীল থাকলেও তা বৈশ্বিক পরিস্থিতি, নীতি পরিবর্তন এবং প্রশাসনিক জটিলতার প্রভাবে বারবার ওঠানামা করেছে।

এ পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যা নয়, বরং বাংলাদেশি অভিবাসীদের জীবন-সংগ্রাম ও নতুন স্বপ্নের প্রতিফলন। যারা গ্রিনকার্ড পেয়েছেন, তাদের বেশির ভাগই পরিবারভিত্তিক ভিসার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন। অনেকে আবার কর্মসংস্থানের সুযোগ, শিক্ষা, কিংবা রাজনৈতিক আশ্রয়ের কারণে এ স্ট্যাটাস পেয়েছেন। বিশেষ করে আমেরিকায় ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশি প্রবাসী সম্প্রদায় নতুন অভিবাসীদের জন্য শক্তিশালী সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বাংলাদেশিদের অভিবাসন প্রবণতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গেও সাদৃশ্যপূর্ণ। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশ থেকেও বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ড পান। তবে বাংলাদেশিদের মধ্যে পরিবারভিত্তিক অভিবাসনের হার তুলনামূলক বেশি, যা একটি শক্তিশালী ডায়াস্পোরা কমিউনিটির পরিচায়ক।

২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশিদের যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ড প্রাপ্তির ইতিহাস এক কথায় নানা উত্থান-পতনের গল্প। কখনো রাজনৈতিক নীতি, কখনো বৈশ্বিক মহামারি, আবার কখনো প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার কারণে এই সংখ্যা কমেছে-বেড়েছে। তবে এক দশকের গড় চিত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার জন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ পাচ্ছেন। এটি প্রমাণ করে যে আমেরিকান সমাজে বাংলাদেশি অভিবাসীরা একটি দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন এবং ভবিষ্যতেও এ প্রবণতা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শেয়ার করুন