টেক্সাসে লাতিনো মানুষজনের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম স্প্যানিশ ভাষাভাষী মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছে। টেক্সাসের হিউস্টনে লাতিনো মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ইসলাম ইন স্প্যানিশ সেন্ট্রো ইসলামিকো সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম এবং একমাত্র স্প্যানিশ ভাষাভাষী মসজিদের দ্বার উন্মোচন করেছে। হিউস্টনের আলিফ এলাকায় অবস্থিত এই মসজিদটি ৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে এবং এটি লাতিনো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ১০ হাজার ২০০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে নির্মিত এই মসজিদটি শুধু নামাজের জায়গাই নয়, বরং একটি ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের প্রোডাকশন স্টুডিওসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। এই স্টুডিওতে লাতিনোদের জন্য ইসলামের ওপর শিক্ষামূলক অডিও এবং ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করা হবে। মসজিদের ডিজাইন করেছেন ইসলাম ইন স্প্যানিশের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং ফ্লেচারের স্ত্রী স্যান্ডি ‘সাকিনাহ’ গুইতিরেজ। এটি ইসলামের স্বর্ণযুগের স্মারক স্পেনের গ্রেট মসজিদ অব কর্ডোবার স্থাপত্যশৈলীর অনুপ্রেরণায় নির্মিত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ১০০ জনেরও বেশি মুসলিম উপস্থিত ছিলেন। হিউস্টন কাউন্সিলওম্যান টিফানি থমাস বলেন, আমার ডিস্ট্রিক্ট আলিফ এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র স্প্যানিশ ভাষাভাষী মসজিদ স্থাপন হওয়ার খবর শুনে আমি খুব আনন্দিত। এই মসজিদটি স্বাগত জানাতে পেরে আমি গর্বিত।
লাতিনো মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রসার
যুক্তরাষ্ট্রে লাতিনো মুসলিমদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ২০২০ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের মধ্যে ৯ শতাংশ লাতিনো, যা ২০১৭ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। এটি যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যকেও তুলে ধরে। লাতিনো লোকজন বিভিন্ন কারণে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। কেউ ক্যাথলিক ধর্মের কঠোর অনুশাসনের পরিবর্তে ইসলামের দৈনন্দিন প্রার্থনা, শৃঙ্খলা এবং মদ, জুয়া, শূকরের মাংস খাওয়ার নিষেধাজ্ঞার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আবার অনেকেই মনে করেন, ইসলাম শুধু মানসিক শান্তি দেয় না, বরং যুক্তির পুষ্টিও দেয়।
লাতিনো মুসলিমদের মধ্যে আরো একটি আকর্ষণীয় কারণ হলো তাদের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক সংযোগ। ইসলাম ইন স্প্যানিশের প্রতিষ্ঠাতা জেইমি ‘মুজাহিদ’ ফ্লেচার, যিনি একজন কলম্বিয়ান বংশোদ্ভূত এবং একসময় গ্যাং লিডার ছিলেন, বলেন আমরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর আমাদের জীবন বদলে গেছে। তিনি আরো বলেন, এই মসজিদ কেবল প্রার্থনার জন্য নয়, এটি লাতিনো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্র এবং পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের জায়গা।
ফ্লেচার ৯/১১ হামলার কয়েক মাস আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর থেকে তিনি দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে লাতিনো মুসলিমদের জন্য কাজ করে আসছেন। তার এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইসলাম ইন স্প্যানিশ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা হিউস্টনের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। প্রতিষ্ঠানটি তরুণ মুসলিমদের মধ্যেও ভালো গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার ক্রেইগ কনসিডাইন লাতিনো মুসলিম সম্প্রদায় নিয়ে গবেষণা করেছেন, তিনি বলেন ইসলাম ইন স্প্যানিশের কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি বিভিন্ন জাতিগত এবং সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়কে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করছে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, এই মসজিদ ও ইসলাম ইন স্প্যানিশের কাজ কেবল হিউস্টনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। টেক্সাস এবং শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলে এটি ছড়িয়ে পড়বে। কারণ লাতিনো এবং মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সংযোগ
অনেক লাতিনো মনে করেন, ইসলামের সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষদের ঐতিহাসিক সংযোগ রয়েছে। স্পেনের আন্দালুসিয়ায় ইসলামিক সভ্যতার প্রভাব এবং ইসলামের চর্চা তাদের নিজেদের ইতিহাসের অংশ বলে মনে করেন। নতুন প্রজন্ম সেই ঐতিহ্যের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করছে।
কলম্বিয়ার অভিবাসী জেইম ফ্লেচার গ্যাং লিডার থেকে মুসলিম ইমাম এবং ধর্মান্তরিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা জেইম ‘মুজাহিদ’ ফ্লেচার, কলম্বিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আসা একজন অভিবাসী, যিনি জীবনের এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছেন। একসময় তিনি টেক্সাসে একটি গ্যাংয়ের লিডার ছিলেন, কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। বর্তমানে তিনি শুধু একজন মুসলিম ধর্মীয় নেতা নন, বরং লাতিনো সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামের প্রচারে অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। ফ্লেচার ইসলাম গ্রহণ করেন ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার কয়েক মাস আগে। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। তবে যখন ইসলাম সম্পর্কে জানতে পারলাম, তখন বুঝলাম এটি শুধু একটি ধর্ম নয়, বরং এটি জীবনের একটি পূর্ণাঙ্গ পথ। তার এই রূপান্তর কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা লাতিনো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য নতুন সুযোগের দরজা খুলে দিয়েছে।
ইসলাম গ্রহণের পর ফ্লেচার তার জীবনকে একটি নতুন উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন। ২০০১ সালে তিনি ‘ইসলাম ইন স্প্যানিশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যার লক্ষ্য লাতিনোদের কাছে স্প্যানিশ ভাষায় ইসলামের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। তার প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করতে এবং লাতিনোদের ইসলাম ধর্মের সঙ্গে পরিচিত করাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম স্প্যানিশ ভাষাভাষী মসজিদ, ‘ইসলাম ইন স্প্যানিশ সেন্ট্রো ইসলামিকো’র প্রতিষ্ঠাতা। হিউস্টনের আলিফ এলাকায় অবস্থিত এই মসজিদটি লাতিনো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি ধর্মীয় ও শিক্ষামূলক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে। ফ্লেচার মনে করেন, ইসলাম তার জীবনের গতি পাল্টে দিয়েছে। একসময় তিনি সহিংসতা ও অপরাধের জগতে ডুবে ছিলেন। তবে ইসলাম গ্রহণের পর তার জীবনের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় শান্তি, শিক্ষা এবং ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করা। তার নিজের জীবনের পরিবর্তন লাতিনো সম্প্রদায়ের অনেক মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। ফ্লেচারের স্ত্রী স্যান্ডি ‘সাকিনাহ’ গুইতিরেজও তার এই কাজে সহায়তা করেছেন। তাদের একত্রে করা প্রচেষ্টা শুধু লাতিনো মুসলিমদের জন্য নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
টেক্সাসে লাতিনো মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে, যা যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামের সম্প্রসারণের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ইসলাম ইন স্প্যানিশ সেন্ট্রো ইসলামিকো শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক কেন্দ্র, যা মুসলিম এবং অমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করছে। নতুন এই মসজিদ লাতিনো মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য আশা এবং ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।