৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ৬:৩৬:০৬ অপরাহ্ন


দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে হার্ড লাইনে যাবে বিএনপি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-১২-২০২৪
দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে হার্ড লাইনে যাবে বিএনপি বিএনপির দলীয় পতাকা


অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। তার এমন বক্তব্যে বিএনপি মৃদু সন্তুষ্ট হয়েছে, পুরোপুরি না। কেননা দলটির হাইকমান্ড মনে করেন, ঠিক কবে নির্বাচন হবে, সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য নেই এতে। বরং দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের পথেই সরকার হাটছে বলেই তারা মনে করেন। এছাড়া নির্বাচনের অনুষ্ঠানের সাল নিয়ে প্রায় দেড়বছরের একটি আলটিমেটামেও সন্দেহ দেখছে বিএনপি’র নীতিনির্ধারকরা। আর এজন্য বিএনপি ও তার সাথে দেড়যুগ ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের ফ্যাসিবাদি শাাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের উদার গণতান্ত্রিক দলগুলিও অসন্তুষ্ট। তারাও চায় দীর্ঘ নয় খুব তাড়াতাড়ি ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ। এটা না হলে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে শেষমেষ বিএনপি হার্ড লাইনে চলে যেতে পারে। এমনটা তথ্য পাওয়া গেছে বিএনপিসহ সংশ্লিষ্ট দলগুলির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে।

কি বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস?

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়। এর পাশাপাশি তিনি জানান, তার সরকার ছয় কমিশনের চেয়ারম্যানদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন’ প্রতিষ্ঠা করার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। যার কাজ হবে রাজনৈতিক দলসহ সব পক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপন হবে সেগুলো চিহ্নিত করা এবং বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা। ভাষণে তিনি জানান, নিজেই জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশনের প্রধান হবেন উল্লেখ করেন। ড. ইউনূস বলেন, যেহেতু জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, তা বিবেচনা করে আমি এই কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করব। তিনি জানান প্রথম এই ছয়টি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন পাবার পর আগামী মাসেই জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন কাজ শুরু করতে পারবে বলে আমি আশা করেন। ওই ভাষণেই ড. ইউনুস জানান, এই নতুন কমিশনের প্রথম কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যেসব সিদ্ধান্ত জরুরি, সেসব বিষয়ে তাড়াতাড়ি ঐকমত্য সৃষ্টি করা এবং সবার সঙ্গে আলোচনা করে কোন সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ চূড়ান্ত করা।

বিএনপি’র প্রতিক্রিয়া

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের সম্ভাব্য দিনক্ষণ ঘোষণাকে কিছুটা স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। তবে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের ধারণা দিয়েছেন। কিন্তু বিএনপি ধারণা নয়, নির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায় বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশন আন্তরিক হলে আগামী ডিসেম্বর মাসের আগেই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেওয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচনের দিন-তারিখ ঠিক করে দিলে জনগণ নির্বাচনমুখী হয়ে যাবে। জনগণ নির্বাচনমুখী হলে ছোটখাটো ষড়যন্ত্র সহ্য করবে না। অতীতেও সহ্য করেনি, ভবিষতেও সহ্য করবে না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশন আন্তরিক হলে আগামী ডিসেম্বর মাসের আগেই একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। তা করা গেলে এই সরকার এবং সাধারণ মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হবে।’

কেন বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়

বিএনপি’র বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা দ্রুতই নির্বাচন চায়। তার তারা মনে করে, যত দিন যাবে ততই জনগণ অতিষ্ঠ্য হয়ে উঠবে। কারণ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগের পটপরিবর্তনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গঠন করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো ইমেজ নিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। এর পাশাপাশি বিএনপি নেতারা মনে করেন, দেশে যে সার্বিক সমস্যা রয়েছে বিশেষ করে তার দলেরই অনেক প্রভাবশালী নেতা কর্মীরাই দখলদারিতে দিনের পর দিন জড়িত হয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন তারা রাজনৈতিকভাবে নিপীড়ন নির্যাতনের স্বীকার হয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রতিশোধ নেয়া থেকে আপাতত বিএনপি’র হাই কমান্ডের নানান ধরনের হুমকি ধামকিতে চুপ আছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘ মেয়াদী সংস্কারের যাঁতাকলে পড়ে গেলে বিএনপি’র এই সব নেতাকর্মী আরও বেপোরোয়া হয়ে উঠতে পারে। বিএনপি’র রাজনৈতিক ইমেজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। যার ফায়দা হয় কোনো না রাজনৈতিক দল নিয়ে নেবে। আবার তা হলে অন্য কোনো অত পেতে থাকা যড়যন্ত্রকারাী অসংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে চিরতরে বাংলাদেশে জেকে বসতে পারে। 

ভাষণে দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের আভাস

বিএনপি’র একজন নেতা দেশ প্রতিনিধিকে বলেন, তারা ড. ইউনুসের সম্পতি দেয়া ভাষণে দ্রুত নির্বাচন না দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের ব্যাপাারেই তার অভিপ্রায়টি জানিয়েছেন। কেননা ড. ইউনূস তাঁর ভাষণের এক জায়গায় বলেছেন, “যদি”, অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচনপ্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার যোগ করি, তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। মোটাদাগে বলা যায়, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচনের সময় নির্ধারণ করা যায়।’ বিএনপি’র ওই নেতা দেশ প্রতিনিধিকে বলেন, ড. ইউনুস আসলে দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের পথেই যাচ্ছেন বা এটা তার একান্ত ইচ্ছা। তবে তার এই ইচ্ছা কারো যড়যন্ত্রের ফাঁদে মনের অজান্তে পা দেওয়া কি-না সে প্রশ্ন রাখেন দেশ প্রতিনিধিকে ওই বিএনপি’র নেতা। তিনি বলেন, অবশ্যই ড. ইউনুস তার ভাষণে আভাস দিয়েছেন একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ দেখতে। কিন্তু একের পর এক ষড়যন্ত্র যেভাবে দেশে বিদেশে চলছে তা সামাল দেয়া হয়তবা বর্তমান বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে ড.ইউনুসের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়াই উত্তম। 

আশঙ্কা কাদের সিদ্দিকীরও

এদিকে এমন আশঙ্কার কথা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মুখে শোনা গেলো। খুব দ্রুত নির্বাচন না হলে, নির্বাচনে না গেলে দেশের মানুষ বিক্ষুব্ধ হবে বলে মন্তব্য করেছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘দ্রুত নির্বাচন না হলে শেখ হাসিনার প্রতি যত বিক্ষুব্ধ হয়েছে মানুষ, তার চেয়েও হয়তো বেশি হবে।’

বিএনপি’র চোখে আরো সন্দেহ

এদিকে বিএনপি’র একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র মনে করে যে তারা বুঝে ড. ইউনুস অবশ্যই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন চান। কিন্তু তিনি যেহেতু রাজনীতি করেননি তাই তার চোখে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রগুলি আঁচ করা কঠিন। বিএনপি’র এই নেতা জানান, তারা এতদিন জানতেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দেলনে নেতারা কোনোভাবেই একটি রাজনৈতিক দল করবে না। বা তারা সরাসরি রাজনীতিতে অংশ নেবে না। কিন্তু মাঠের খবর হচ্ছে আগামী দু-এক মাসের মধ্যে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দল ঘোষণা হবে। এমনটাই জানিয়েছেন সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দীন পাটোয়ারী। নাসির উদ্দীন বলেছেন, যারা ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছিলেন এবং যারা বাংলাদেশকে নতুনভাবে সাজাতে চান; যারা চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি থেকে মুক্ত করে বাংলাদেশকে একটি নতুন জায়গায় নিয়ে যেতে চান; যারা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করতে চান তাদের নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আগামী এক দুই মাসের মধ্যে সুন্দর একটি নতুন দল উপহার দেবে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল-আমীন বলেছেন, হাসিনার পতনের সঙ্গে সঙ্গে যা চেয়েছিলাম, তা এখনো পাইনি। তবে আমাদের পেতেই হবে। না হলে জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে শহিদদের সঙ্গে বেঈমানী করা হবে-এমন সব আক্ষেপ করেছেন। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, রাজনীতিবিদরা আমাদের সঙ্গে যে প্রতারণা করছেন এটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমরা যেভাবে অতীতকে বর্তমানের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছি ঠিক একইভাবে আপনাদের বর্তমান ভবিষ্যতে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। সূত্র জানায়, বিএনপি’র হাই কমান্ড এসব বক্তব্য ও কার্যক্রমকে রহস্যজনক বলে মনে করে। তাদের মতে, দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের আড়ালে মাঠে সব রাজনৈতিক দলের বিকল্প একটি প্লাটফরম দাঁড়ানোই মুল লক্ষ্য কি-না তা তাদের ভাবিয়ে তুলছে এমন সব কার্যক্রম আর বক্তব্যে। সৃষ্টি করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিও তাদের গভীর সন্দেহ। আর এসব কারণে কালক্ষেপণ না করে দ্রুত নির্বাচনের তারিখ না দেয়া হলে বিএনপি একে গভীর ষড়যন্ত্রই বলে মনে করবে। তা ঠেকাতেই দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি হার্ড লাইনে চলে যাবে। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন যে, রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের আর কত মাস কিংবা কত সময় প্রয়োজন, তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। তার এমন বক্তব্যও যে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি হার্ড লাইনেও যেতে পারে তা-রই একটি প্রচ্ছন্ন আভাস। কারো কারো মতে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ১৬ ডিসেম্বর সোমবার জাতির উদ্দেশে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ভাষণ দিয়েছেন তাতে বিএনপি’র হাইকমান্ডকে শান্ত করার একটি প্রয়াসও হতে পারে । তবে ড. নোবেল বিজয়ী ড. ইউনুসের এমন বক্তব্যে বিএনপি’কে কতটা শান্ত থাকবে তা হয়তো সময় বলে দিবে।

শেয়ার করুন