বিএনপি এখনো বেগম খালেদা জিয়ারই দল। বিষয়টি ভারতকে যতটুকু নাড়া দেয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে অন্য কোনো বিষয় তেমন নাড়া দেয় না। সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিন্তু আরেকটি কথা ধ্বনিত হচ্ছে, যেমন বিএনপি বিরোধী দলে থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের যথেচ্ছাচার যেমন প্রহসনের নির্বাচন থেকে শুরু করে বেগম জিয়ার কারান্তরীণ রাখা কোনো কিছুতেই সরকার পতনের আন্দোলনে বিএনপিকে নামানো যায়নি। নামানো গেলেও চুল ভেজায়নি তারা। এমনকি লাখ লাখ বিএনপির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলাও তা করতে পারেনি। বিএনপি যে শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলন করা যায় তা-ও বিশ্বাস করতো না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আন্দোলনের পরিবর্তে চোখের পানি ফেলে নিরস্ত হয়েছেন। এখন কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে অকাতরে প্রাণ বলিদানের মাধ্যমে দেশি-বিদেশি শক্তির মদতে যখন হাসিনা সরকারের পতন হয়, তখন বিএনপি আবার জেগে উঠেছে। ড. ইউনূস সরকারের প্রতি হুমকি দিচ্ছে সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দিবে। বিএনপির আলামতটা সুখের ঠেকছে না। ১৭ বছর যে দল আন্দোলনের নামে নিজেদের অস্তিত্ব পর্যন্ত রক্ষার অবস্থায় ছিল না, আজ তার এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা বলে। অনেক নতুন নেতানেত্রী মহাসুখে আওয়ামী লীগের জয়গান করছে। যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণকে হাস্যকর করে তুলেছিল, তাদের আবার ‘ইনক্লুসিভ’ নামে নতুন এক শব্দ দিয়ে জায়েজ করার পাঁয়তারা চলছে। বাদ সেধেছে তরুণ প্রজন্মরা। রাজনীতি থেকে তারা আওয়ামী লীগের নির্বাসন চায়। যেভাবে হিটলারের নাৎসি বাহিনী নির্বাসিত হয়েছে। কিন্তু বিএনপি আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন চায়। কারণ তারা আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কারো উত্থান দেখতে চায় না। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে নাগরিক পার্টি গড়ে উঠেছে তারও উত্থান তাদের কাছে অসহনীয়। অথচ সেই দলের এখনো চলার জন্য হাঁটু পর্যন্ত গজায়নি।
এদিকে এতদিন ভারতের দাদারা নতুন করে প্রমাদ গুনতে শুরু করেছে। কারণ ভারত নির্বাচন চায়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ চায়। কিন্তু সম্প্রতি লন্ডনে বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃবৃন্দের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যে বৈঠক হয়েছে বেগম জিয়ার উপস্থিতিতে, তা নিয়ে ভারত প্রমাদ গুনছে। কারণ ভারত মনে করেছিল বাংলাদেশে পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে না। কারণ জামায়াতই প্রথম বলেছিল তারা বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধবে না। তার তাৎক্ষণিক কারণও ছিল। কারণ সরকার পতনের জন্য যখন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা সরকার পতনের ডাক দিয়ে গুলির সামনে বুক চিতিয়ে দিয়েছিল, তখন জামায়াত কারণে হোক, বাধ্য হয়ে হোক আন্দোলনে ছিল। কিন্তু মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, ‘এ মুহূর্তে সরকার পতন তাদের লক্ষ্য নয়।’ সরকার পতনের পর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূসের অধিষ্ঠানের পিছনেও বিএনপির ছিল নীরব সমর্থন। সরব সমর্থন ছিল না। কারণ সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও ভারত ড. ইউনূসকে সরকারপ্রধান হিসেবে নিতে চায়নি। ভারত যখন অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল, তখন ড. ইউনূস শান্ত, অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘ভারত বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চাইলে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ভারতও অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে।’ অথচ সেদিন বিএনপির কাউকেই এ কথার সমর্থন দিতে পাওয়া যায়নি। এখন ভারতের শাসক মহলে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে যে, লন্ডনে জামায়াত ও বিএনপির মধ্যে আলোচনার মধ্যে দিয়ে দুই দলে নতুন করে সমঝোতার পালা শুরু হয়েছে। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দখল যখন ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর পোক্ত হয়ে যায়, তখন ভারত বাংলাদেশের দুটি বিষয়ের ওপর টার্গেট করেছিল। এক ছিল বিএনপি নেতা তারেক জিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের দাউদ ইব্রাহিমের বৈঠক। এ বৈঠক নিয়ে প্রায় সব ভারতীয় পত্রিকায় ঝড় উঠেছিল। আর দ্বিতীয় ভারতীয় আক্রমণ ছিল বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকের ওপর। ভারতের মতে, জামায়াতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক। আওয়ামী লীগ দুটি কাজ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ থেকে তারেক জিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা ও ইসলামী ব্যাংককে লুটপাটের মাধ্যমে ধ্বংস করা। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংকটি থেকে লুটপাট করা হয়েছে। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য এই ব্যাংকটিকে স্থিতিশীল করতে যখন এর বিশাল কর্মিবাহিনী কাজ করেছে, তখন মতিঝিলে প্রধান কার্যালয়ে চালানো হয় মধ্যযুগীয় আক্রমণ গত মাসে। কারা এই আক্রমণ করেছে তা বলা বাহুল্য। লন্ডনের সভায় জামায়াতের সব নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু বিএনপির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বেগম জিয়া ও তারেক জিয়া। বাংলাদেশ থেকে কোনো বিএনপি নেতাকে ডাকা হয়নি। বৈঠক হয় লন্ডনের কিংসটনে তারেক জিয়ার বাসায়। জামায়াতের নায়েবে আমির আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের উপস্থিত থাকলেও বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বা প্রেসিডিয়াম মেম্বার কেউ ছিলেন না।
জামায়াত নেতারা এই বৈঠককে বলেছেন সৌজন্য সাক্ষাৎ। কিন্তু বৈঠকের পর আগামী রোজার আগে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর দাবি মো.টেই বিষয়টাকে সৌজন্য মনে হচ্ছে না। কিন্তু ভারতে এ বৈঠক নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক জল্পনা। তাদের কাছে বিএনপি-জামায়াত এই হাই প্রোফাইল সভা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। তাছাড়া ভারতে ধুয়েমুছে তুলসি পাতা হওয়া নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদও ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য। সেখানে তারেক জিয়ার অবস্থান নেহায়েত অপ্রতুল।
ভারত এখন মনে করছে, মির্জা ফখরুল কিংবা সালাহউদ্দিনকে বাদ দিয়ে লন্ডনে যে দহরম সম্পন্ন হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে তা আগামী দিনে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতিকে সফল করে তুলবে।
এখন মির্জা ফখরুল কিংবা সালাহ উদ্দিন বা তারেক জিয়ার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে সম্মত কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। বেগম জিয়া সম্ভবত তারেক জিয়াকে নিয়ে দেশে ফিরতে চান। কিন্তু সে ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো ঘোষণা নেই।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো শনিরদশা। জেনারেল ওয়াকারের ওপর রয়েছে পুরোদমে ভারতীয় শুভেচ্ছা। জেনারেল ওয়াকার নাকি বর্তমান বাংলাদেশের ত্রাণকর্তা। কিন্তু তাকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন আছে। যা খোলা চোখে কিংবা বন্ধ চোখে উভয় প্রকারে দেখা যায়।