যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সফর করতে গ্রিনকার্ডধারীদের অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলে ইমিগ্রেশন বিষয়ক পরামর্শদাতাদের কাছে অভিযোগ আসছে অহরহ। অনেকে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে গ্রিনকার্ড ব্যবহার করে স্বদেশে যেতে চাচ্ছেন না। তাদের জন্য এই নিবন্ধ। বৈধ স্থায়ী বাসিন্দারা ট্রাম্প প্রশাসনের যথেচ্ছাচার ইমিগ্রেশন রেজিস্ট্রেশনের জন্য তাদের স্ট্যাটাস নিয়ে উদ্বিগ্ন। অনেক ইমিগ্রেশন অ্যাটর্নি মনে করেন, তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। তবে বিষয়টি ভালোভাবে জানতে হলে সব বিষয় নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি।
ট্রাম্প প্রশাসনের ইমিগ্রেশনের বিষয়ে ঢালাও কঠোর পদক্ষেপের কারণে এয়ারপোর্টে, সীমান্ত ক্রসিংয়ে এবং অন্যান্য পোর্ট অব এন্ট্রিতে ভিসাধারী এবং ভ্রমণকারীদের গ্রেফতার কিংবা বহিষ্কারের বিষয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে কতিপয় গ্রিনকার্ডধারী ও বর্ধিতহারে যাচাই-বাছাইয়ের সম্মুখীন হয়েছে। গ্রিনকার্ড কিংবা স্থায়ী বাসিন্দার অনুমতি কার্ড যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাস ও কাজ করার অনুমতি। অতীতে গ্রিনকার্ডধারীরা অন্যান্য বিদেশিদের চাইতে অনেক কম উদ্বেগে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে সফর করতেন। কিন্তু প্রশাসনের সীমান্তে প্রতিবন্ধকতা এবং গ্রিনকার্ডধারীদের অধিকতর যাচাই-বাছাই, বিশেষ করে ইত্যাদির কারণে গ্রিনকার্ডের সেসব সুবিধায় পরিবর্তন এসেছে।
ইমিগ্রেশন আইনজ্ঞদের কাছে ইতিমধ্যে অনেকে- এমনকি সিটিজেন ও গ্রিনকার্ডধারীরা একইভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই ১০০ দিনের রাজত্বে যদি তারা সীমান্তে আটক হয়, তাদের জন্য ব্যবস্থা নিতে শরণাপণ্ন হয়েছে। এই সুযোগে অনেক আইনজ্ঞ সুযোগ পেয়ে বা ঝোঁক বুঝে কোপ মারার জন্য ওত পেতে আছেন। অনেকে অগ্রিম টাকা দাবি করে সীমান্তে আটকে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আবার অনেক সৎ আইনজ্ঞ উদ্বেগ না করে সৎ বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। তারা গ্রিনকার্ডধারীদের, যারা বাইরে সফরে যাচ্ছেন তাদের উপদেশ দিচ্ছেন।
এখানে আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করে গ্রিনকার্ডহোল্ডারদের কীভাবে বিদেশে সফর করবেন, সে বিষয়ে কী জানা দরকার তা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি।
গ্রিনকার্ডহোল্ডারদের কী অধিকার রয়েছে? গ্রিনকার্ডধারীরা আমেরিকায় কাজ করতে এবং বসবাস করতে অনুমতিপ্রাপ্ত। তারা সোশ্যাল সিকিউরিটির মেডিকেয়ার ও কলেজের জন্য আর্থিক সহায়তা কিংবা সামরিক বাহিনীতে চাকরি করতে অনুমিত বলে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ থেকে বলা হয়েছে। এই হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অনুমান করেছে, গত ১৯২৪ সালের জানুয়ারি মাসের আগে আমেরিকার ১ কোটি ২৮ লাখ গ্রিনকার্ডধারী আমেরিকায় আছেন। তখন থেকে ৭০ হাজার গ্রিনকার্ডধারী বেড়েছে। গ্রিনকার্ডধারীদের সব সময় তাদের কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে। গ্রিনকার্ডধারীরা যদি ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত আমেরিকার বাইরে থাকতে চান, তাহলে তারা পুনরায় ফিরে আসার জন্য পূর্বানুমতি নিতে পারেন।
যে কোনো গ্রিনকার্ডধারী যদি কোনো ক্রাইম বা অপরাধ করে থাকেন, তাহলে তাদর সরকারি প্রশাসন টার্গেট করতে পারে। এসব ক্রাইমের মধ্যে গাড়ির গতিসীমা লঙ্ঘন থেকে আরো গুরুতর অপরাধ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব অপরাধীকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধ অথবা ডিপোর্ট করতে পারে। কিন্তু সরকার সাধারণত গুরুতর অপরাধ করেনি- এমন কাউকে বহিষ্কারের টার্গেট না-ও করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। গ্রিনকার্ডধারীদের ট্রাভেল ফরমে সব সময় একই তথ্য অবশ্যই প্রদান করতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ- অধিকাংশ ইউরোপিয়ান, যারা যুক্তরাষ্ট্রে সফরে আসবেন, তারা ট্রাভেল অথরাইজেশনের মধ্যে ইলেকট্রনিক সিস্টেমে যে প্রশ্নোত্তর প্রদান করে থাকেন, একই প্রশ্নোত্তর গ্রিনকার্ডের প্রশ্নোত্তরেও দিতে হবে। একটির উত্তর অন্যটির সঙ্গে মিলতে হবে। ইমিগ্রেশন আইনজ্ঞরা বলেন, গ্রিনকার্র্ডধারীদের যে কেউ একই সঙ্গে ৩৬৫ দিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকতে পারে। কিন্তু কেউ যদি ৬ মাসের বেশি বাইরে থাকে, তাহলে ইমিগ্রেশন অফিসারের চক্ষু চড়কগাছ হতে পারে। ৬ মাসের বেশি আমেরিকার বাইরে থাকলে তা নাগরিকত্বের জন্য আবেদনের যোগ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পুনরায় নির্ধারণ করা হতে পারে। অনেক গ্রিনকার্ডধারী, যারা বর্ধিত সময়ের জন্য বা প্রশ্নযোগ্য সময় আমেরিকার বাইরে অবস্থান করে, অর্থাৎ ৬ মাসের অধিক যদি তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকেন, তাহলে কাস্টমস ও বর্ডার প্রোটেকশন এজেন্টরা তাদের গ্রিনকার্ড সারেন্ডার করার জন্য প্রেশার দিতে পারে। অনেক লোককে দেখা যায়, তাদের কাস্টমস ও বর্ডার প্রোটেকশন এজেন্ট গ্রিনকার্ড সারেন্ডার করার জন্য ফরম ধরিয়ে দিয়েছে। তার অর্থ এই যে, অতিরিক্ত সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে থাকলে তাদের গ্রিনকার্ড সারেন্ডার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর তাদের যে ফরম দেওয়া হয়েছে, তা তাদের রেকর্ডের সঙ্গে লিখে রাখা হয়। কাজেই কেউ যাতে প্রবেশাধিকার পেলে তারা যে পুনরায় তা পাবে, তা বলা যায় না।
কাস্টমস ও বর্ডার প্রোটেকশন বৈধ-স্থায়ী বাসিন্দাদের ভিজিটর ও যাত্রীদের যেভাবে আচরণ করে একইভাবে আচরণ করে থাকে। আর সেক্ষেত্রে তারা বিচারক এবং তারাই জুরি। কাস্টমস ও বর্ডার প্রোটেকশনের এক মুখপাত্র বলেন, এজেন্সি তাদেরই গ্রিনকার্ড সারেন্ডারের ফরম দেন। যারা গ্রিনকার্ড সারেন্ডার করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। একে আইনজ্ঞ বলেন, এক গ্রিনকার্ডহোল্ডার নিউইয়র্কে বসবাস করেন। তিনি তার স্বদেশে গিয়েছিলেন তার একটি প্রজেক্ট দেখার জন্য, যার জন্য তাকে তিন মাস সেখানে কাটাতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে এলে তাকে বলা হয়। কাস্টমস অফিসাররা বিশ্বাস করেন না, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তাকে গ্রিনকার্ড সারেন্ডারের ফরম ধরিয়ে দিয়ে বলা হয়, গ্রিনকার্ড পরিত্যাগ করতে এবং ওয়ার্ক পারমিটের আবেদন করতে। তিনি তা করেননি। অবশেষে তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি এখন নিউইয়র্কে। তিনি বলেন, এই অভিজ্ঞতা হৃদয়বিদারক। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এ ধরনের প্রশ্নের জবাব দেয় না। আরেক গ্রিনকার্ডধারী ১২ বছর বয়স থেকে এ দেশে আছেন। কিন্তু তিনি দুবার ড্রাগ রাখার মতো অপরাধে অভিযুক্ত হন। পরে রেকর্ড থেকে তা মুছে দেওয়া হলেও তাকে বিমানবন্দরে আটকে রেখে এক সপ্তাহ ধরে বন্দি করে রাখা হয়। তার কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। কাস্টমস তা জাজকে দেয়নি। তারপরও তাকে ধরে রাখা হয়েছে। তার মুছে ফেলা অপরাধগুলো ছিল ফেলোনি। এখনো তিনি কবে মুক্ত হবেন, তার ইয়ত্তা নেই।
আমেরিকার নতুন ভ্রমণ প্রতিবন্ধকতা কি? ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর ইমিগ্রেশন এজেন্ডা, বর্ডার চেকপয়েন্ট নিয়ে হোয়াইট হাউস যেসব বিধিবিধান দিয়েছে তাকে বলা হচ্ছে, ‘অ্যাডভান্সড ভেটিং’ বা আগাম অনুমতি বা ভেটিং। এই ব্যবস্থা আমেরিকার মিত্র দেশ জার্মানকেও তাদের নাগরিক, যারা আমেরিকা সফর করতে চান, তাদের জন্য ভ্রমণ উপদেশ দিতে বাধ্য করেছে। গত এপ্রিল মাসে ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ঘোষণা করেছে, তারা ইমিগ্র্যান্টদের সোশ্যাল মিডিয়া চেক করে দেখবে, যাতে তাদের মিডিয়ায় কোনো অ্যান্টি সেমিটিক বিষয় পাওয়া যায় কি না, আর তা পাওয়া গেলে সে সময় ইমিগ্রেশন বেনিফিট পাবে না। এই যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে অ্যান্টি সেমিটিক সন্ত্রাসী কার্যকলাপে কেউ সমর্থন করে কি না বা কেউ উত্থাপিত করে কি না, প্রমোট করে কি না অথবা অ্যান্টি সেমিটিক সন্ত্রাসকে মদত দেয় কি না, তা দেখবে বলে বিবৃতিতে বলা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা যারা গ্রিনকার্ডের জন্য আবেদন করে কিংবা বিদেশি ছাত্র এবং অ্যান্টি সেমিটিক বা অ্যান্টি ভিকটিমের সঙ্গে কোনো ইমিগ্র্যান্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যুক্ত কি না, তা যাচাই করা হবে। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প প্রশাসন প্যালেস্টাইনপন্থী প্রতিবাদকারীদের মধ্যে গ্রিনকার্ডধারী ও স্টুডেন্ট ভিসাধারীদের গ্রেফতার ও আটক করে রেখেছে তাদের ক্যাম্পাসে তৎপরতার জন্য।
গ্রিনকার্ডধারীদের কী ধরনের প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন? গ্রিনকার্ড বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি কোনো গ্রিনকার্ডধারী যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যেতে চান এবং ৬ মাস বা তার চেয়ে বেশি দিন বাইরে থাকতে চান, তাদের রি-এন্ট্রি পারমিটের আবেদন করা উচিত। আর তাতে আইনসিদ্ধ গ্রিনকার্ডধারীরা দুই বছর পরও বিনা বাধায় আমেরিকায় ঢুকতে পারবে। এই পারমিট নিলে এটাই প্রতীয়মান হবে যে, গ্রিনকার্ডধারীরা তাদের বৈধ স্ট্যাটাস পরিত্যাগ করতে চায় না। যদি বিদেশে যাওয়ার আগে পারমিট না আসে, তাহলে অন্তত আবেদনের রিসিপ্ট নিয়ে ভ্রমণ করা উচিত। তাছাড়া গ্রিনকার্ডধারীরা, যারা প্রায়শ বিদেশে সফর করেন, তারা সিবিপি কর্মসূচির অধীনে গ্লোবাল এন্ট্রির জন্য আবেদন করতে পারেন। তাতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সময় ক্লিয়ারেন্স প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে।
ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব ও ইমিগ্রেশন সার্ভিস ইউএসসিআইএস, ৭১২০টি বেনিফিট ফ্রড রেকর্ড সমাপ্ত করেছে। এর ওপর ৪ হাজার ৬৬৪টি ফ্রড শনাক্ত করেছে। তাছাড়া ৪৬২টি বেনিফিট ফ্রড রেকর্ড ও ৪ হাজার ৬৭২টি কঠোর পাবলিক সেফটি রেকর্ড আইসের কাছে ক্রিমিনাল তদন্ত করার জন্য প্রেরণ করেছে। তাছাড়া ২ হাজার ২৭১টি কাজের জায়গা ভিজিট করেছে এবং ৩ হাজার ৫৬৮টি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকটিভিটি বাছাই করেছে।
[লেখক : একজন সাংবাদিক ও ইমিগ্রেশনবিষয়ক সমাজসেবক]