২৫ অক্টোবর ২০২৫, শনিবার, ১০:৪৯:১৮ পূর্বাহ্ন


ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে আইস হেফাজতে মৃত্যুর হার অতীতের চেয়ে বেশি
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-১০-২০২৫
ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে আইস হেফাজতে মৃত্যুর হার অতীতের চেয়ে বেশি আইস ডিটেনশন সেন্টার


২০২৫ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইস) হেফাজতে আবারও একজন অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু ঘটেছে। হুয়াবিং শি নামের এই চীনা নাগরিকের মৃত্যুর কারণ প্রাথমিকভাবে সিজার বা খিঁচুনির মতো দেখা গেলেও এ ঘটনা আইস হেফাজতে মৃত্যুর চলমান ও গভীর সংকটকে আবারও সামনে এনেছে। ২০২৫ অর্থবছরে এ পর্যন্ত আইস হেফাজতে ২৩ জন অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে। ২০০৪ সালের পর এটি সবচেয়ে বেশি। আর এই সংখ্যা এখানেই থেমে নেই। অক্টোবর মাসের প্রথম ১৫ দিনের মধ্যেই আরো দুজনের মৃত্যু হয়েছে, যা ২০২৫ সালকে অভিবাসীদের জন্য অন্যতম ভয়াবহ বছর হিসেবে চিহ্নিত করছে।

২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডবেও আইস হেফাজতে এতো বেশি মৃত্যু ঘটেনি। ২০২৫ সালের এই মৃত্যুগুলোর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে: অতিরিক্ত ভিড়, অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, চিকিৎসা অবহেলা, মানসিক চাপ এবং এমনকি বন্দিশালার ভিতরে গুলি করে হত্যা। ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে এই মৃত্যুর হার দেখে মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রশাসন যখন অভিবাসীদের ব্যাপক হারে আটক ও ফেরত পাঠানোর নীতিকে আরো কঠোর করেছে, তখন আইস হেফাজতে বন্দির সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে এখন ৬০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

বিভিন্ন বন্দিশালায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি মানুষকে রাখা হচ্ছে, যা স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে। ম্যাসাচুসেটসের একটি আইস অফিসে এমন একটি জানালাবিহীন কক্ষে ৩৫-৪০ জনকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে যেখানে একটি মাত্র টয়লেট এবং কোনো গোপনীয়তা নেই। ফ্লোরিডার ক্রোম ডিটেনশন সেন্টারে বন্দিদের মেঝেতে ঘুমাতে হচ্ছে এবং প্রতিদিন মাত্র এক কাপ ভাত ও এক গ্লাস পানি দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো সেন্টারে পচা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও চরম অব্যবস্থাপনা লক্ষ করা গেছে। এক বন্দি চোখের সংক্রমণ ও জ্বর নিয়ে দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করার পরও কোনো চিকিৎসা পাননি। এক ২৩ বছর বয়সী ভেনেজুয়েলান যুবক, যিনি একসময় ছিলেন পুরোপুরি সুস্থ, তিনি কয়েক মাসের মধ্যেই পায়ে চলার ক্ষমতা হারান। তার চিকিৎসা চলাকালীন তাকে বারবার স্থানান্তর করা হয়েছে, কিন্তু ওষুধ কখনো সঠিকভাবে সরবরাহ করা হয়নি। অবশেষে সহবন্দিদের সাহায্যে তাকে হুইলচেয়ারে করে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিতে হয়েছে।

এমন অবহেলা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক ক্ষেত্রেও প্রকট। মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। অন্তত তিনটি মৃত্যুকে আত্মহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ব্রায়ান রায়ো-গারজোন নামের ২৭ বছর বয়সী একজন যুবক, যিনি দুবার মানসিক চিকিৎসার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলেও সেটি বাতিল করা হয়, তিনি তার সেলে গলায় চাদর পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। একইভাবে জুনে জেসুস মোলিনা-ভেয়া ও আগস্টে চাওফেং জেও আত্মহত্যা করেন। এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট, বন্দিশালার মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যর্থতার মধ্যে রয়েছে।

আইস হেফাজতে বন্দিদের এখন আরেকটি প্রাণঘাতী ঝুঁকি যুক্ত হয়েছে-গুলি করে হত্যা। সেপ্টেম্বরে ডালাসের আইস অফিসে বন্দিদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় দুজন নিহত হন। এটি টেক্সাসে আইস অফিসে তৃতীয় বন্দুক হামলার ঘটনা, যা রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধির দিকেই ইঙ্গিত করে। এ মৃত্যু ও নির্যাতনের পরেও আইস কীভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে? বিভিন্ন বন্দিশালায় বন্দিরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও অনশন করছেন। নিউইয়র্কের এক ফেডারেল বিচারক ম্যানহাটন আইস হোল্ডিং সেলে বন্দিদের সংখ্যা কমাতে এবং গোসলের সুযোগ বাড়াতে আদেশ দিলেও পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হয়নি। মূলত যতদিন পর্যন্ত আইস ব্যাপকভাবে মানুষ আটক করার নীতি থেকে সরে না আসে, ততদিন এ মৃত্যুর প্রবণতা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আইস সব মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করছে না। ২৩টি মৃত্যুর মধ্যে এখনো ৬টি মৃত্যুর তথ্য তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে নেই। অনেকে অভিযোগ করেছেন, মৃত্যুর আগে গুরুতর অসুস্থদের মুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি তার দায় এড়িয়ে চলছে। এছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন অভ্যন্তরীণ নজরদারি অফিস বন্ধ করে দেওয়ায়, এ সংস্থার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আরো কমে গেছে।

২০২৫ সালের মৃত্যুর তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন চীন, ভেনেজুয়েলা, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, ডোমিনিকান রিপাবলিক, ভারত, জর্ডান, ইউক্রেন এবং আফ্রিকা থেকে আগত অভিবাসীরা। তাদের অনেকেই ছিলেন আশ্রয়প্রার্থী, কেউ কেউ ছিলেন অসুস্থ, আবার কেউ এসেছিলেন ভালো জীবনের আশায়। কিন্তু আমেরিকান মাটিতে, বিশেষতআইস হেফাজতে, তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে একটি নিষ্ঠুর ব্যবস্থার বলি হওয়া।

এ বছরের মৃত্যুর পরিসংখ্যানই যথেষ্ট এই বাস্তবতাকে সামনে তুলে ধরতে : ২০২৫ সালের ১ অক্টোবর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যু ঘটেছে আইস হেফাজতে, আর পরবর্তী ১৫ দিনে আরো অন্তত দুইজনের মৃত্যু ঘটেছে। হেফাজতে বন্দিদের প্রতি এমন অমানবিক আচরণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের বিরুদ্ধে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির মানবিকতার প্রশ্ন তোলে। যতদিন না এই নীতির ভিত্তিতে মানবিকতা এবং স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে, ততদিন অভিবাসীদের জন্য আইস হেফাজত একটি মৃত্যুকূপই থেকে যাবে।

শেয়ার করুন