১৩ মে ২০২৫, মঙ্গলবার, ০৮:৬:১১ পূর্বাহ্ন


‘এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট’ ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা
দেশ রিপোর্ট
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০৫-২০২৫
‘এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট’ ব্যবহার অবৈধ ঘোষণা ইউএস কোর্ট অব সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব টেক্সাস


ইউএস কোর্ট অব সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব টেক্সাস গত ১ মে এক ঐতিহাসিক রায়ে ট্রাম্প প্রশাসনের এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট ব্যবহার করে দক্ষিণ টেক্সাসে আটক ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের প্রত্যাবাসন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এই রায়ে বিচারক ট্রাম্প প্রশাসনকে এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট ব্যবহার করে ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের আটক বা প্রত্যাবাসন থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। মামলাটি ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকান সিভিল লিবারটিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) এবং আমেরিকান সিভিল লিবারটিজ ইউনিয়ন টেক্সাস দ্বারা দায়ের করা হয়েছিল। ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের বিচারক ফার্নান্দো রদ্রিগেজ, যিনি ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে নিয়োগপ্রাপ্ত, তার ৩৬ পৃষ্ঠার রায়ে বলেছেন যে, ট্রাম্পের প্রশাসন এই আইনের আওতায় ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের আটক বা প্রত্যাবাসন করতে পারে না। বিচারকের মতে, এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট কেবল বিশ্বযুদ্ধ বা সশস্ত্র আক্রমণ ঘটলে প্রযোজ্য, যা এই ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এর ফলে ট্রাম্প প্রশাসনকে দক্ষিণ টেক্সাসে আটক থাকা ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। এই রায়ে বিচারক একটি স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, যা ট্রাম্প প্রশাসনকে এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট ব্যবহার করে ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের আটক বা প্রত্যাবাসন থেকে বিরত রাখবে। এর মানে হলো, এই আইনের আওতায় ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের সরিয়ে নেওয়া যাবে না এবং এটি প্রশাসনের জন্য একটি বড় আইনগত বাধা সৃষ্টি করেছে।

বিচারক রদ্রিগেজ তার রায়ে বলেন, রাষ্ট্রপতির একতরফা ঘোষণা যে আক্রমণ বা লুটতরাজমূলক অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তা এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্টের আওতায় প্রযোজ্য নয়। এটি শুধু সশস্ত্র আক্রমণের জন্য প্রযোজ্য, যা সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট, ১৭৯৮ সালে প্রবর্তিত একটি আইন যা মূলত যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এই আইনের অধীনে, রাষ্ট্রপতির কাছে শত্রু বিদেশি নাগরিকদের আটক এবং তাদের দেশ থেকে বহিষ্কারের ক্ষমতা ছিল। আদালত উল্লেখ করেছে, এই আইন শুধু যুদ্ধকালীন অবস্থায় ব্যবহৃত হয়েছিল এবং শান্তির সময়ে এ ধরনের আইন প্রয়োগের উদ্দেশ্য ছিল না। তাই ট্রাম্প প্রশাসনের প্রয়োগে আইনগত ভিত্তি এবং প্রেক্ষাপট ছিল অস্বচ্ছ, যা আদালত ভেঙে দিয়েছে।

‘ইনভেশন’ এবং ‘প্রিডেটরি ইনকার্শন’-এর ব্যাখ্যা 

আদালত এই রায়ে স্পষ্টভাবে বলেন যে, ‘ইনভেশন’ এবং ‘প্রিডেটরি ইনকার্শন’ শব্দগুলো এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্টের আওতায় সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা একটি সংঘটিত আক্রমণ বা অনুপ্রবেশ বোঝায়, যা বিধ্বংসী কার্যক্রম চালাতে আসে। বিচারক রায় দেন যে, ঞৎবহ ফব অৎধমঁধ গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড এই ধরনের সশস্ত্র আক্রমণ বা অনুপ্রবেশ হিসেবে বিবেচিত হয় না। তাদের কর্মকাণ্ড অপরাধমূলক হলেও এটি আইনের শর্ত পূরণ করে না এবং তাই এটি এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্টের আওতায় আনা যায় না।

বিচারক আরো বলেন, রাষ্ট্রপতি একতরফাভাবে ‘ইনভেশন’ এবং ‘প্রিডেটরি ইনকার্শন’ ঘোষণা করতে পারেন না এবং শান্তির সময়ে এই প্রাচীন যুদ্ধকালীন আইনের প্রয়োগ করা যাবে না। আদালত এর মাধ্যমে বলে যে, এই ধরনের ক্ষমতা এককভাবে রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়া যায় না এবং আদালতের ভূমিকা সীমাবদ্ধ করার জন্য সংবিধান অনুযায়ী আইনের ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। বিচারক স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, এই আইন ব্যবহারের ক্ষেত্রে আদালতের সংশ্লিষ্টতা এবং সীমাবদ্ধতা অপরিহার্য।

বিচারক রায়ে বলেন, রাষ্ট্রপতির ঘোষণায় এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট ব্যবহার করার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ বা তথ্য থাকা আবশ্যক, যা আইনের শর্ত পূরণ করে। ট্রাম্প প্রশাসনের ঘোষণায় এই ধরনের প্রমাণের অভাব ছিল, বিশেষ করে ট্রেন দে আরাগুয়া গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রমাণের অভাব ছিল। রাষ্ট্রপতি একতরফাভাবে এই আইন প্রয়োগ করতে পারেন না, যদি না বাস্তব ও যথাযথ তথ্য উপস্থাপন করা হয়।

বিচারক আরো বলেছেন, এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট ব্যবহার করে যে কার্যক্রমটি বন্ধ করা হয়েছে, তা অভিবাসন এবং জাতীয়তা আইনের (আইএনএ) আওতায় চালানো হতে পারে। তবে এই আইনের প্রয়োগ ছিল অবৈধ এবং আদালত এই পদক্ষেপের বৈধতা প্রত্যাখ্যান করেছেন। সুতরাং সরকারকে অভিবাসন আইন অনুসারে অন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এই রায় ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য একটি বড় আইনি বাধা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে অভিবাসন নীতি এবং নির্বাহী ক্ষমতার সীমা নিয়ে। আদালত স্পষ্টভাবে বলেছে, এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট শান্তির সময়ে ব্যবহৃত হতে পারে না। এই রায়ের ফলে ভবিষ্যতে আরো আইনি লড়াই হতে পারে এবং এটি অভিবাসন আইন এবং নির্বাহী ক্ষমতার ব্যবহার নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি উদাহরণ হিসেবে দাঁড়াবে। তিনি আরো উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট এই ধরনের যুদ্ধকালীন আইনকে একতরফাভাবে প্রয়োগ করতে পারেন না এবং এমনটি করলে তা সাংবিধানিক সিস্টেমের বিরুদ্ধে যাবে। এই রায়ের মাধ্যমে, আদালত রাষ্ট্রপতির নির্বাহী ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করেছেন এবং এই আইনের প্রয়োগে আদালতের ভূমিকা স্পষ্ট করেছেন। বিচারক তার পর্যবেক্ষণে আরো বলেছেন, প্রেসিডেন্ট যদি একতরফাভাবে এই শর্তগুলো ঘোষণা করেন, তবে তা আইনিভাবে অবৈধ হবে এবং আদালতকে এর বিচার করতে হবে।

এটি ছিল ট্রাম্প প্রশাসনের মার্চ মাসের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ রায়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ঘোষণায় দাবি করেছিলেন যে, ভেনেজুয়েলান গ্যাং ‘ট্রেন দে আরাগুয়া’ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ চালাচ্ছে এবং সেক্ষেত্রে তাদেরকে ‘শত্রু বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এই ঘোষণার পর, তিনজন ভেনেজুয়েলান অভিবাসী যারা দক্ষিণ টেক্সাসের এল বললে ডিটেনশন সেন্টারে আটক ছিলেন, তারা আদালতে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ করেন। তাদের অভিযোগ ছিল, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগে অগ্রসর হয়েছে, যেটি আইনের শর্তগুলোর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

এসিএলইউর লিড কাউন্সেল লি গেলার্ট এই রায়ের পর বলেন, বিচারক সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির একতরফা ঘোষণায় ‘ইনভেশন’ প্রমাণ করা যায়নি এবং এটি ১৮০০ শতকের যুদ্ধকালীন আইন প্রয়োগ করার সঠিক সময় নয়। এসিএলইউ টেক্সাসের আইনি পরিচালক আদ্রিয়ানা পিনিওন বলেন, এই সিদ্ধান্ত নির্বিচারে নির্বাহী ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা দেশের অভিবাসী সম্প্রদায়কে আরো সুরক্ষা দেবে।

ট্রাম্প প্রশাসনের ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট প্রয়োগের সিদ্ধান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি গুরুতর উদাহরণ। কারণ এটি যথাযথ প্রমাণ ছাড়াই এসব ব্যক্তিকে ‘শত্রু বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে, ফলে তাদের মৌলিক আইনগত সুরক্ষা এবং মর্যাদা কেড়ে নেয়। এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি পুরোনো, যুদ্ধকালীন আইনকে শান্তির সময়ে অবৈধভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা নয়, বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক ন্যায়, সহানুভূতি এবং মানবজীবনের প্রতি শ্রদ্ধার মূল্যগুলোকে ক্ষুণ্ন করে। এই রায়ের ফলে ট্রাম্প প্রশাসন এখন এই আইনের আওতায় ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের আটক বা প্রত্যাবাসন করতে পারবে না, তবে তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিবাসন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সম্ভাবনা রয়েছে এবং এটি যে একটি দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে পরিণত হতে পারে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। এই মামলাটি দক্ষিণ টেক্সাসে ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের বিরুদ্ধে এলিয়েন এনেমিজ অ্যাক্ট প্রয়োগের বিরুদ্ধে একটি বড় আইনি বাধা সৃষ্টি করেছে, যা প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা এবং আইনের সংজ্ঞা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।

শেয়ার করুন