২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০৮:১৭:৩১ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী অনুমোদনে প্রজ্ঞা-আত্মা’র অভিনন্দন, দ্রুত গেজেট প্রকাশের দাবি বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করলেন তারেক রহমান ফুজি ফিফথ স্টেশন ইতিহাস গড়ে বিচারপতি হলেন বাংলাদেশি আমেরিকান সোমা হাদির খুনিদের শাস্তির দাবিতে স্মারকলিপি ও গায়েবানা জানাজা মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘স্যাংচুয়ারি ক্যাম্পাস’ ঘোষণার দাবি শিক্ষার্থীদের কিউনি ও সুইনি ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক্সেলসিয়র স্কলারশিপ ২০২৬-এর আবেদন প্রক্রিয়া শুরু তৃতীয় দেশে ফেরত পাঠানোর যুক্তিতে আশ্রয় আবেদন বাতিলের উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাচারালাইজড নাগরিকত্ব বাতিলের নতুন নির্দেশনা ট্রাম্পের নতুন ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় ৩৯ দেশ


তৈরি পোশাকে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ
ইইউ পার্লামেন্টের প্রস্তাবনা অশনিসংকেত
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৯-২০২৩
ইইউ পার্লামেন্টের প্রস্তাবনা অশনিসংকেত


মানবাধিকার ইস্যুতে উদ্বেগ নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন পার্লামেন্টে। সেখানে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সুবিধায় রফতানি নিয়েও। বলা হয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের অবাধ বাজার সুবিধা অব্যাহত রাখা যৌক্তিক কি না। এটা বাংলাদেশের রফতানির জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন এখন পোশাক রফতানিকারকরা। 

গত সপ্তাহে ইউরোপিয়ান জোটের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রঁর বাংলাদেশ সফর নিয়ে এক ধরনের স্বস্তি, সন্তুষ্টি এলেও এর কিছুদিনের মধ্যেই ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ওঠা সাম্প্রতিক ইস্যু বাংলাদেশের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব কণ্ঠভোটে গৃহীত হয়েছে। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চর্চার বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উত্থাপন করা প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবটি গ্রহণের পাশাপাশি বাংলাদেশে এনজিও, মানবাধিকারকর্মী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ ও যথাযথ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। 

প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ইইউয়ের অবাধ বাজার সুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মসের’ (ইবিএ) পরিসর আরো বাড়ানোর প্রক্রিয়া যখন চলমান। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সনদের লঙ্ঘনের মাধ্যমে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের মামলাটি একটি পশ্চাৎগামী পদক্ষেপ, যা উদ্বেগের। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা। প্রসঙ্গত, ইবিএ কর্মসূচির মাধ্যমে জিএসপি সুবিধা দেওয়া হয়।

ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বলা হয়, বাংলাদেশের সঙ্গে ইইউর ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) বাণিজ্য সুবিধা আরো বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন, অধিকারের বিরুদ্ধে মামলা এ সুবিধা থেকে পিছিয়ে যাওয়ার একটি কারণ হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা উচিত কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্যরা।

যদিও ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গৃহীত প্রস্তাবে চরম হতাশা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই প্রস্তাবকে ‘পক্ষপাতমূলক’ এবং ‘একটি সার্বভৌম দেশের স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ’ বলেও উল্লেখ করেছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পক্ষপাতিত্বে বাংলাদেশ হতবাক। কারণ সংস্থাটি একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের অন্ধ সমর্থক এবং এর বিরুদ্ধে অতীতে ভুল তথ্য ছড়ানোর মাধ্যমে দেশজুড়ে সন্ত্রাসবাদ ও ভয়াবহ উগ্রপন্থা ছড়ানোর প্রমাণ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার ইউরোপীয়দের এমন উদ্যোগ মোটেও আমলে নিচ্ছে না। বরং সমালোচনা করেছেন। এতে করে পার্লামেন্টের প্রস্তাবনা ধরে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে ফেলে যেটা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বাংলাদেশের পোশাক খাত, যার ইঙ্গিত এমন প্রতিক্রিয়ায় অনুমান করা যাচ্ছে। 

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে, বিশেষ করে ‘অধিকার’-এর বিষয়ে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গ শহরে ‘মোশন ফর আ রেজুলেশন’ শিরোনামের ওই প্রস্তাবের ওপর ভোট হয়। প্রস্তাবে বাংলাদেশে বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেফতার এবং বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি সরকারকে ২০২৪ সালের অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিতের আহ্বান জানানো হয়েছে। 

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র থেকে তথ্যে জানা গেছে, ইউরোপে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি ডলারের রফতানি করে আসছে বাংলাদেশ। যার ৯৩ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত। বাংলাদেশ সারা বছরে যে পরিমাণ রফতানি করে সারা বিশ্বে এ অংশ তার ৪৮ শতাংশ, যা মূলত জিএসপি সুবিধার মাধ্যমেই। ফলে যে জিএসপি সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ ইবিএর মাধ্যমে সেটা যখন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলমান সেখানে সে সুবিধা কমে যাওয়া বা স্থগিত যদি হয়ে যায়, তাহলে সেটা হবে বাংলাদেশের জন্য চরম হতাশার। এতে ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত পড়ে যাবে বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কতটুকু টিকে থাকতে পারবে অর্ডার ধরে রাখতে পারবে সে দুশ্চিন্তা জেঁকে বসতে পারে গার্মেন্টস খাতে। 

এ ব্যাপারে বিএকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি তার এক বক্তব্যে বলেছেন, এটাতে তো কিছুটা শঙ্কা কাজ করছে। বিশেষ করে ইউ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন ) ও ইউএস এ দেশের পলিটিক্যাল ইস্যুতে চাপাচাপি করছে, সেটা কোনদিকে, না কোনদিকে গড়ায় সেটা আমাদের দেখতে হবে।  

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তার এক আর্টিকেলে লিখেছেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পার্লামেন্টের প্রস্তাব শুধু মানবাধিকারের নিরিখে দেখলেই হবে না, এর সঙ্গে রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয়ই জড়িত। এ প্রস্তাবে মানবাধিকার ছাড়াও বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনি বাংলাদেশের জন্য ইইউর অবাধ বাজার সুবিধা ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) অব্যাহত রাখা যৌক্তিক কি না, সেই প্রশ্নও স্পষ্টভাবে তোলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, ইবিএর অধীনে বাংলাদেশকে বাণিজ্যের যে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়, তা শর্তহীন সুবিধা নয়। মূলত যেসব দেশ মানবাধিকার, সুশাসন, দুর্নীতি দমন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ইত্যাদির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং মেনে চলে তাদেরই কেবল এ সুবিধা দেওয়া হয়। এর আগে শ্রীলঙ্কা, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানের এমন সুবিধা ওই শর্তাবলির ব্যত্যয় ঘটার কারণে বাতিল করা হয়।

বাংলাদেশের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টের প্রস্তাব খুবই জোরালো সতর্কসংকেত। রাজনীতি একদিকে, অর্থনীতি একদিকে এই দৃষ্টিভঙ্গিতে একে দেখার সুযোগ নেই। শুধু রাজনীতি কিংবা শুধু অর্থনীতি বলতে কিছু নেই; সবই রাজনৈতিক অর্থনীতি। রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয় এমন যে, একটি দেশের আন্তর্জাতিক বা দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে যেমন নানা অঙ্গীকার থাকবে, তেমনি তার নিজের দেশের নাগরিকের প্রতি সুদৃষ্টি দেওয়া বা সুবিচার করতে হবে। তা না হলে তার আন্তর্জাতিক প্রভাব পড়তে বাধ্য। সেজন্যই ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক যে সুবিধা আমরা পাচ্ছি, তা বাতিলের প্রশ্ন আসছে। এ সুবিধা তারা যে কোনো সময় প্রত্যাহার করতে পারে।

বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। আগেও আমরা বিদেশি নানা উদ্বেগ দেখেছি। এবারের প্রস্তাবে একেবারে ‘অ্যাকশন’-এর কথা বলা হচ্ছে। আমাদের মনে আছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। সে উদ্বেগগুলো আমলে নেওয়া হয়নি বলেই দেখা গেল একসময় তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দেয়। সেজন্যই এসব ঘটনায় উদ্যোগটা জরুরি। তা না হলে এমন পদক্ষেপ আসতে পারে, যা হঠাৎ আমাদের ওপর বজ্রপাতের মতো পড়তে পারে। এটাও বলেছি, শুধু একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে এমন প্রস্তাব আসেনি। এটা আমাদের ধারাবাহিক কর্মতৎপরতার ফল। তারা বিষয়গুলো সংসদে আলোচনা করেছে এবং এরপর নির্বাহী বিভাগ তাদের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।’

শেয়ার করুন