০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুক্রবার, ০২:১৯:৫০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
স্ন্যাপ সুবিধা ফিরলেও কঠোর নিয়মে বিপাকে ৪০ মিলিয়ন মানুষ মসজিদে ধারাবাহিক হামলা, উদ্বেগে মুসলিম সম্প্রদায় ফেব্রুয়ারি ১ থেকে রিয়েল আইডি ছাড়া বিমানযাত্রায় লাগবে ৪৫ ডলারের ফি নিউইয়র্কে শীতকালে ঘর গরম রাখার জন্য এনার্জি সহায়তার আবেদন শুরু দারিদ্র্যপীড়িত দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান ট্রাম্পের ১৯ দেশের গ্রিনকার্ডধারীদের পুনর্মূল্যায়ন শুরু তারেকের ‘ফেরা ইস্যু’ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে চেষ্টা বিডিআর বিদ্রোহের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কমিশন রিপোর্টে তোলপাড় রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ মর্যাদায় খালেদা জিয়া ১১ মাসে ২৮ জন বাংলাদেশী ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কর্তৃক নিহত হয়েছে


রাখাইন স্টেটের ৯০ ভাগ বিদ্রোহীদের দখলে
স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় আরাকান আর্মি বাংলাদেশের মুখাপেক্ষী
মঈনুদ্দীন নাসের
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৬-২০২৫
স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় আরাকান আর্মি বাংলাদেশের মুখাপেক্ষী


বার্মার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যখন কার্যকর সুযোগ এসেছে, তখন বাংলাদেশের ‘ফ্যাকাশে’ রাজনৈতিক শক্তি সে সুযোগকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একদিকে ভারতবেষ্টিত ভৌগোলিক কাঁটাতার, অন্যদিকে বার্মার (মায়ানমার) আরাকানবিরোধী সমরাভিযান ও রোহিঙ্গা খেদাও আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশের কখনো দৃঢ় কোনো অবস্থান ছিল না। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানই একমাত্র শাসক, যিনি কূটনীতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করেছিল। তিনি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশে অনুমতি দেননি। তারপর এইচ এম এরশাদের শাসনকালে যখন জিয়াউর রহমানের নীতি অনুসরণ করা হয়, তখন বার্মা রোহিঙ্গাদের বহিষ্কার করতে তেমন সাহস দেখায়নি। এরপর ১৯৯৩ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতায়, তখন বার্মা আবার রোহিঙ্গা খেদাও আন্দোলন শুরু করে। আর তখন আমেরিকা, জাতিসংঘ ও পশ্চিমা অন্যান্য দেশের কথা শুনে বেগম জিয়ার সরকার রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারে প্রবেশের অনুমতি দেন। এই প্রতিবেদক সে সময় কক্সবাজার যায়, তাদের প্রবেশের দুই মাস পর। তখনো সেখানে কোনো চৌকি বসানো হয়নি। ডেপুটি কমিশনারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর তিনি ক্যাম্পে এসে বলেন, ‘দেখি এদের জন্য কি করা যায়।’ তখন বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জনবসতিতে মিশে গিয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশের পাসপোর্ট করে নেন। তাদের হদিস এখনো বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যাবে। এরপর একসময় সৌদি আরব বলেছিল বাংলাদেশি পাসপোর্ট যাদের আছে, তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সম্ভবত তা হয়ে ওঠেনি। বর্তমানে আওয়ামী লীগের শাসনে আসা রোহিঙ্গাদের প্রথমে শেখ হাসিনা সরকার তাদের ঢুকতে দেয়নি। কিন্তু পরে জাতিসংঘ, তুরস্ক ও আমেরিকার অর্থায়নের আশ্বাস পেয়ে যখন দেখতে পায় সেখানে অর্থ আত্মসাতের সুযোগ আছে এবং এর সঙ্গে কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ নেতা বদিউর রহমান বদি ওরফে বাংলাদেশি মাফিয়ার ড্রাগ আনার সুযোগ রয়েছে বলে লবি শুরু করে, তখন দেখা যায় তাদের বসতি গড়ে তুলতে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিধা করেনি। রোহিঙ্গা আসার পর থেকে বাংলাদেশে ‘ইয়ার’, ‘আইস’ জাতীয় মাদকদ্রব্যের বিরাট ব্যবসা গড়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের নিয়ে বদিউর রহমান বদির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ড্রাগ নেটওয়ার্ক। চলে মিথ্যা ও সত্যের লড়াই। বিভিন্ন বেশ্যালয়, বস্তি এলাকা, ঘরে ঘরে গড়ে ওঠা যৌন ব্যবসায় এই মাদকদ্রব্য হয়ে ওঠে অন্যতম আকর্ষণ।

কিন্তু এবার বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে দীর্ঘ সময়ের মধ্যে গড়ে উঠেছে আরাকান আর্মি। গত ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই এই আরাকান আর্মি প্রায় ৮০ শতাংশ বার্মার পশ্চিমাংশ আরাকান স্টেট (যা বর্তমানে রাখাইন স্টেট নামে পুনঃনামকরণ করা হয়েছে) থেকে দখল করে তার ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা হয়েছে। এখন তা ৯০ ভাগ ছাড়িয়েছে। সে সময় শুধু সিতউই, মানুরাং ও কাইউক পি নামে কয়েকটি শহরতলী বার্মার সামরিক বাহিনীর হাতে রাখা হয়। সম্ভবত তখনো বার্মার সামরিক বাহিনী তা দখল করে আছে। আর আরাকান আর্মি সমান্তরালভাবে আরাকানে সরকার ব্যবস্থাপনার কাঠামো নির্মাণ করে চলেছে। এখন তারা সেখানে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পথে। তারা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কাছাকাছি, কিন্তু তাদের প্রয়োজন শর্তহীন সমর্থন। এখন প্রশ্ন উঠেছে আরাকান আর্মির পরিচালনায় রাখাইন স্টেট প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কতটুকু? বিশেষ করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ক্ষেত্রে এর অগ্রসরতা কতখানি? বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে এহেন স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা কসভো, দক্ষিণ সুদান, সোমালি ল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়ার তিমুরে বিশ্ব মানবাধিকার সমর্থনকারী রাষ্ট্রসমূহের সমর্থন পেয়েছে। আরাকান আর্মিও সেরকম সমর্থনের আশা করে সামনে এগোচ্ছে। পেটে পাথর বেঁধে ঘুমুচ্ছে। নিজেদের ল্যান্ড রক্ষায় ব্যবস্থা নিচ্ছে। বার্মার সামরিক জান্তার দোর্দণ্ড অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েও পিছপা হচ্ছে না। অথচ এই স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্য অর্জনে অন্যতম ফ্যাক্টর হচ্ছে, এই রাখাইন রাজ্যে চীন, ভারত আশিয়ান রাষ্ট্রসমূহ ও পশ্চিমা সরকারদের স্বার্থরক্ষা। তারা সেখানকার স্টেকহোল্ডার। 

এদিকে আরাকান আর্মির অধিকাংশ রাখাইন স্টেটের জায়গায় তাদের নিয়ন্ত্রণ। রাখাইন স্টেটের ভূরাজনীতিকে পরিবর্তন করে দিয়েছে। আরাকান আর্মি গঠিত হয় ২০০৯ সালেই। যখন থেকে আরাকানিদের বিতাড়ন করা হয় তখন থেকেই। এই আরাকান আর্মি মায়ানমারের সবচেয়ে দৃঢ় গোত্রগত সামরিক সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে রয়েছেন বার্মার সামরিক জান্তার কবল থেকে বেরিয়ে আসা সামরিক বাহিনীর লোক ও আরাকানবাসী, যারা মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষার দৃঢ় পদক্ষেপ হিসেবে সশস্ত্র সংগ্রামকে বেছে নিয়েছে। তারা আধুনিক সামরিক সংস্থা ও সরকারি কাঠামোর সন্নিবেশ ঘটিয়েছে। বিদ্রোহী গ্রুপ যারা বৈধতার স্বীকৃতি চায়, তার রাষ্ট্রের মতো প্রাতিষ্ঠানিক শাসন কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। একইভাবে আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড লিগ অব আরাকান এই ধরনের মডেল অনুসরণ করার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে তারা নিজেদের বিচার, আইনি প্রথা, কর ও রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা নির্মাণ করতে চায়। তার সঙ্গে নিরাপত্তা ও প্রশাসন ও সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন চায়। ইউনাইটেড লিগ সব আরাকান (ইউএলও) তাদের নিজস্ব আদালত ও বৈধ কোড স্থাপন করতে চায়, যা বার্মার বর্তমান লিগের ফ্রেমওয়ার্কের সমান্তরাল। প্রথাগত রাখাইন আইন, বৌদ্ধধর্মের বৈধ প্রথা এবং মায়ানমারের বর্তমান বৈধ ব্যবস্থা থেকে গৃহীত ব্যবস্থাসমূহ এই বৈধ কোডের ভিত্তি রচনা করেছে। এর আদালতসমূহ আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নাগরিক বিরোধ, সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা ও ক্ষুদ্র অপরাধ নিষ্পত্তিতে স্বাধীনভাবে কাজ করছে। এই আদালতসমূহ গ্রামে টাউনশিপে এবং জেলা পর্যায়ে কাজ করে। আবার এদের রয়েছে উচ্চতর আপিল প্রক্রিয়ার সুযোগ। 

এই ইউএলএ বিচারব্যবস্থা নিয়ে কমিউনিটির লোকজনদের মতামত ভিন্ন। অধিকাংশ রাখাইন লোক এ ব্যবস্থাকে বার্মার দুর্নীতিগ্রস্ত লিগ্যাল সিস্টেমের চেয়ে আকর্ষণীয় মনে করে। তারা মনে করে এ ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য বিকল্প। কিন্তু কেউ কেউ মনে করে এই প্রক্রিয়ায় গ্রহণযোগ্য বৈধ প্রটেকশন এবং যথাযোগ্য প্রক্রিয়ার সুযোগ নেই। তথাপি ইউএলএ প্রশিক্ষিত প্যারালিনাল ব্যক্তিত্ব ও মামলার সময়সাপেক্ষ নিষ্পত্তির মাধ্যমে আরো বিশ্বাস অর্জনে সক্রিয়। এছাড়া কর, রাজস্ব, মিলিশিয়া নির্মাণের মাধ্যমে তারা স্বায়ত্তশাসন অর্জনে বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে আরো ব্যাপক আলোচনা করা যায়। কিন্তু জাতিসংঘ এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আরাকান আর্মি ও ইউএলওকে বিভিন্ন অর্থ সাহায্যের মাধ্যমেও রিলিফ সামগ্রী দেওয়ার মাধ্যমে আরাকানে বা রাখাইন স্টেটে আরো শক্তিবৃদ্ধির কাজ করতে চায়। সেজন্য বাংলাদেশের সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। জাতিসংঘ যে ব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে চায়, সেজন্য বর্তমান বাংলাদেশ সরকারকে কাজে লাগাতে চায়। অবশ্য তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার বিষয়কে বাদ দিয়ে নয়। অন্যান্য প্রতিবেশী দেশও এর সঙ্গে জড়িত। 

বার্মা সম্পর্কে বিশেষ করে আরাকান সম্পর্কে চীনের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নতা রয়েছে। তা নিয়ে না হয় আরেকদিন আলোচনা করা যাবে। তবে এটুকু বলে রাখি আরাকানের স্বায়ত্তশাসন চীনের জন্য বয়ে আনতে পারে নতুন কৌশল। সেজন্য চীন আরাকান আর্মির বিরোধিতা করবে কি না- তা দেখার বিষয়। চীনের কাছে আরাকান নিয়ন্ত্রণের চেয়ে ভারতীয় উত্তর পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি প্রয়োজন। কাজেই আরাকান আর্মিকে সে কাজে চীন অনেক বেশি ব্যবহার করতে পারবে। এখন ভারত এই রেঙ্গুন বন্দরকে ব্যবহার করে উত্তর পূর্বাঞ্চলে যেতে চায়। কিন্তু আরাকান আর্মির স্থাপনা সে বিষয়কে দূরে ঠেলে দিতে পারে। 

তাই বর্তমানে ভারতঘেঁষা বিএনপি মানবিক কারণে চলাচল ব্যবহার জাতিসংঘ প্রস্তাবকে নাকচ করছে বারবার। বিষয়টি নিয়ে অন্যবার আলোচনা হবে। 

শেয়ার করুন