২৫ এপ্রিল ২০১২, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৩:২৯ অপরাহ্ন


জ্বালানি অস্থিরতায় কঠিন চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ
সালেক সুফী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০৭-২০২২
জ্বালানি অস্থিরতায় কঠিন চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ


বিশ্বজ্বালানি বাজারের স্মরণকালের সবচেয়ে টালমাটাল বাংলাদেশ। জ্বালানি নিয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে বাংলাদেশ। এই পরিস্থিতি সহজে উপশম হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে  আসছে। ইতিমধ্যেই বিশ্ব জ্বালানি বাজারের জ্বলন্ত আগুনের আঁচ লেগেছে বাংলাদেশে। অপরিণামদর্শী জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা জরুরি বিদ্যুৎ আইন নামের যে বিশেষ ইনডেমনিটি আইন করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে সেখানে মূল উপকরণ জ্বালানি জোগাড়ের বিষয়টি বাস্তব সম্মত ছিল না। দেশে প্রাথমিক জ্বালানি (কয়লা, গ্যাস) আহরণ এবং উত্তোলন উপেক্ষা করে বিপুল চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও জ্বালানি আমদানির দিকে ধাবিত হয় বাংলাদেশ। 

২০১০-২০২২ পর্যন্ত নানা অজুহাতে কয়লা উত্তোলনকে বিবেচনার বাইরে রাখা হয় নানা কারণে।আমলা নিয়ন্ত্রিত পেট্রোবাংলা জলে-স্থলে ন্যূনতম গ্যাস অনুসন্ধানে আছে বড় ব্যার্থতা। বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাস মূল্য ক্ষণে ক্ষণে ওঠা নামার বিষয়ে বিশেজ্ঞদের সুপারিশ অবজ্ঞা করে প্রায় ৭ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। কয়লা আমদানি এবং পরিবহন বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে মুড়ি-মুড়কির মতো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করা হয়। পায়রা,রামপাল,মাতারবাড়ি সকল স্থানেই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প নির্ধারিত সময় থেকে পিছিয়ে যায়। ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সচেতনতার কারণে অতি দ্রুত বাংলাদেশ বেশ কিছু কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন পরিকল্পনা থেকে সরে আসে। একই ধরনের সমস্যা এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য থাকলেও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চিন্তাভাবনা চলতে থাকে।

এই যখন অবস্থা তখন করোনা পরবর্তীতে বিশ্ব অর্থনীতি পুরোনো রূপে ফায়ার আসতে শুরু করে বিশ্ব জ্বালানি বাজারে আগুন লাগে। কয়লা, তেল, গ্যাস সবকিছুর মূল্য আকাশ ছুঁয়ে যায়। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই নিজেদের জ্বালানির অভাবে ক্রমাগত আমদানিকৃত জ্বালানি-নির্ভর হতে থাকে। এরই মাঝে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে জ্বালানি মূল্য ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়। স্পট মার্কেটে এলএনজি মূল্য ৪ ডলার থেকে বেড়ে ৪০ ডলারে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের নিজস্ব উৎপাদন দ্রুত কমে ২৭৫০ এমএমসিএফডি থেকে ২৩০০ এমএমসিএফডি দাঁড়ায়।এলএনজি আমদানি হতে থাকে ৬৫০-৮৫০ এমএমসিএফডি। তারপরও অন্তত৫০০ এমএমসিএফডি গ্যাস ঘাটতি সকল গ্যাস গ্রাহকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের উৎপাদনের ৪০ শতাংশ শেভ্রন নিয়ন্ত্রিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে আশায় সাময়িক উৎপাদন সংকটে কয়েকদিনের জন্য তীব্র গ্যাস দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।  এমনি পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী একান্ত অপারগ না হলে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কেনার উপদেশ দেন। একইসঙ্গে তিনি বিদ্যুৎ এবং গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবার তাগাদা দিলে টনক নড়ে সবার।

নিজেদের গ্যাস উৎপাদন আতঙ্ক জনকভাবে কমছে, যতোই তৎপর হোক পেট্রোবাংলা ২০২৫-২০২৬ নাগাদ গ্যাস উৎপাদন ২০০০ এমএমসিএফডি বা তার নিজে কমে যেতে পারে। এই সময়ে অতিরিক্ত এলএনজি আমদানির একমাত্র সুযোগ মহেশখালীতে তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল। কিন্তু বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে এখন কোথায়ও ছোট  টার্মিনাল নেই বা কেউ ফেব্রিকেশনের উদ্যোগ নিচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় টার্মিনাল কবে নাগাদ আসবে নিশ্চয়তা নেই।  মাতারবাড়ি ল্যান্ড বেজড টার্মিনাল  নির্মাণ কার্যক্রম ২০২৪-এর আগে শুরু হবার নিশ্চয়তা নেই। সেক্ষেত্রে ২০২৭-২০২৮ আগে ল্যান্ড টার্মিনাল চালু হবার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। ভারত থেকে পাইপ লাইনে আরএলেঙ্গি আমদানি বা ৯০ কিলোমিটার সাগর তলদেশের পাইপ লাইন দিয়ে গভীর সমুদ্রে প্রস্তাবিত এলএলজি স্থাপনা থেকে আমদানি এখন আকাশ-কুসুম কল্পনা মনে হয়। তরল জ্বালানির অগ্নিমূল্য এবং ডলার টাকা মূল্যমান পতনের কারণে তরল জ্বালানি-নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পুরো ক্ষমতা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বলা হচ্ছে, কয়েকটি আমদানিকৃত বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হলে সংকট মিটবে। কিন্তু বিশ্ববাজারে কয়লার অগ্নিমূল্য এবং বাংলাদেশ উপকূলে মাতারবাড়ি ছাড়া কোথায় আমদানির সুযোগ সীমিত। 

বিদ্যমান অবস্থায় সুপারিশ নিম্নরূপ 

জ্বালানি বিদ্যুৎখাতকে অপরিহার্য খাত ঘোষণা করে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ। অবিলম্বে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে বড়পুকুরিয়া,ফুলবাড়ী খনি থেকে কয়লা উত্তোলন এবং আহরণ করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নিয়ন্ত্রণে বিশেষ সেল গঠন। খনিমুখে বা সুবিধাজনক এলাকায় ১০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার উল্যাসুপের ক্রিটিক্যাল টপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন। রেল-যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করে কয়লা রামপাল এমনকি পায়রায় পরিবহন করা যাবে।

স্থলভাগে গ্যাস-তেল উত্তোলনের জন্য বাপেক্সের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে পিএসসি সম্পাদন। ২০২৪ থেকে ১০টি অনুসদ্ধান কূপ কাজ শুরু করলে ৩-৫ বছরের মধ্যে ৩-৫ টিসিএফ গ্যাসপ্রাপ্তিরসমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।জলে বিশেষত গভীর সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ২০২৩ জানুয়ারি নাগাদ পিএসসি বিডিডিঙ রাউন্ড আহ্বান করা সম্ভব হলে ২০৩০ নাগাদ সুফল মিলতে পারে।

গ্যাস সঞ্চালনব্যবস্থা সুনিয়ন্ত্রিতকরার জন্য অবিলম্বে স্কাডা পুরোপুরি সক্রিয় করা অত্যাবশ্যক। সকল ডেসপাস কেন্দ্রে কাস্টোডি ট্রান্সফার মিটারিং-ব্যবস্থা নিশ্চিত করে সর্বক্ষণিক মনিটরিং প্রয়োজন গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক কৃচ্ছ্রতার প্রয়োজন আছে। গৃহস্থালি গ্যাস ব্যবহার ২০২৫ মধ্যে সম্পূর্ণভাবে এলপিজি দিয়ে প্রতিস্থাপন করা উচিত। বাণিজ্যিক ব্যবহার ওই সময়ের মধ্যে বাতিল করতে হবে। একইভাবে সিএনজিতে গ্যাস ব্যবহার অটোগ্যাসে রূপান্তর করা উচিত।বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসে ব্যবহার বিশেষত ক্যাপটিভ জেনারেশনে গ্যাস ব্যবহার সীমিত করতে হবে।

সার উৎপাদনেও গ্যাস ব্যবহার শুধুমাত্র আধুনিক প্রযুক্তির কারখানাসমূহে সীমিত করতে হবে। শিল্পক্ষেত্রেও গ্যাসের বিকল্প জ্বালানি যথাসম্ভব ব্যবহার করার বিষয় বিবেচনা করতে হবে। সূর্যকিরণ, বায়ুবিদ্যুৎ ব্যবহারে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারকে প্রণোদনা দিতে হবে।সর্বোপরি গ্যাস চুরি, অপব্যবহার সম্পূর্ণভাবে রোধ করতে হবে , জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। 

স্মরণে রাখতে হবে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা নাহলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থবির হয়ে পর্বে। সেক্ষেত্রে সকল মেগা প্রকল্পসমূহ গলার কাঁটা হয়ে যাবে। 

শেয়ার করুন