২৮ মার্চ ২০১২, বৃহস্পতিবার, ০৫:২১:১৬ অপরাহ্ন


জ্বালানিতে ভুল পরিকল্পনায় ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট
খন্দকার সালেক
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-১০-২০২২
জ্বালানিতে ভুল পরিকল্পনায় ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকট


ভুল পরিকল্পনা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সঙ্গে যোগ করুন বাস্তবায়ন দুর্বলতা এবং সীমাহীন দুর্নীতি। জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টরের দুর্ভিক্ষের জন্য আর কি বাকি থাকে? সংশ্লিষ্টরা জানেন, বুঝেন- আজকের মহাসংকট হঠাৎ করে হয়নি। করোনা না হলে বা যুদ্ধ না বাঁধলেও বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট বিদ্যুৎ সংকট অনিবার্য ছিল। হয়তো তীব্রতা এতো গভীর হতো না। পিএসএমপি ২০১০, পিএসএমপি ২০১৬ কোনোটাই এমন হয়নি। খেয়াল খুশি মাফিক কিছু সুবিধাবাদী মহলকে লাভবান করার জন্য এলোমেলো করে ফেলা হয়েছে জ্বালানি বিদ্যুৎ খাত। দেশে ব্যবসা করেও কিছু কিছু মানুষ বিদেশে বিপুল সম্পদের অধিকারী এখন। তাদের তাবেদার হয়ে কাজ করছে আমলা, তথাকথিত কিছু জ্বালানি পরিকল্পনাবিদ। 

২০১০ সময়ে জরুরিভাবে ৩-৫ বছর মেয়াদি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের যৌক্তিকতা ছিল। কিন্তু সেগুলি এখন সম্প্রসারিত হয়ে ৫০০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এমনকি অধিকাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জার নাম বিদ্যুৎ খাতের বিষ ফোঁড়া হিসাবে রয়ে গেছে। সরকার সবার জন্য বিদ্যুৎ রাজনৈতিক স্লোগানের আওতায় সারা দেশে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সম্প্রসারণে কোটি কোটি টাকা ব্যায় করলেও সামান্যই বিনিয়োগ করেছে সঞ্চালন আর বিতরণ ব্যাবস্থায়। নিজের দেশের প্রাথমিক জ্বালানি উন্নয়ন উপেক্ষা করে ছুটেছে আমদানি করা জ্বালানির সোনার হরিনের পেছনে। ফলাফল বহুল কথিত ২৫০০০ মেগাওয়াটের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ১২০০০ মেগাওয়াট উৎপাদন আর বিতরণে হিমশিম খাচ্ছে। বিপুল দেনার দায়ে পঙ্গু বিপিডিবি, রুরাল ইলেক্ট্রিফিকেশন বোর্ড।

একেতো দেশের মূল জ্বালানি গ্যাস আহরণ, উত্তোলনে অবজ্ঞা আর অবহেলা, অন্যদিকে দীর্ঘ ১৪ বছরেও কারিগরি বিবেচনায় পরিবেশ সম্মত উপায়ে  খনন সম্ভব বিপুল পরিমাণ কয়লা সম্পদ মাটির নিচে ফেলে রাখা হয়েছে। সাগর সীমানা জয়ের কথা উচ্চ কন্ঠে বলা হলেও সাগরে গ্যাস সম্পদ আহরণের কোনো উদ্যোগ নেয় নি সরকার। তথাকথিত নীল অর্থনীতি ব্যার্থতার বিষে নীল হয়ে রয়েছে।

সবাই জানে সমতল বেঙ্গল ডেল্টার সাগর উপকূল অগভীর, এখানে অসংখ নদ নদী প্রতিনিয়ত হিমালয় পর্বতমালা ধুয়ে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি বহন করে বাংলাদেশকে উর্বর এবং উপকূলভাগকে অগভীর করছে। উপকূলে জ্বালানি আমদানির জন্য উপযুক্ত স্থান আছে শুধুমাত্র মাতারবাড়িতে। তাও আবার ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ২৫০ মিটার প্রস্থ ১৮ মিটার গভীর লিংক ক্যানাল খননের কারণে। জাপানি সংস্থা জাইকার পরামর্শ উপেক্ষা করে পায়রা সমুদ্র বন্দর গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় কোটি কোটি টাকা অপচয় করা হয়েছে। ওখানে রামনাবাদ চ্যানেলে গভীরতা ৬ মিটার। ওখান থেকে সাগর নিদেন পক্ষে ৭০ কিলোমিটার। ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে এবং ফি বছর মেইনটেনেন্স ড্রেজিং করে চ্যানেল সচল রাখা তাই অবাস্তব ধারণা। পায়েরা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২ x ১৩৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশে মাইল ফলক হিসাবে বিবেচিত হতে পারে নির্দ্বিধায়। কিন্তু এখানে কয়লা সরবরাহের সংকট রয়ে গাছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে সুপরামাক্স কয়লা জাহাজ (৫০,০০০ টন ক্ষমতার) জাহাজ অর্ধেক পূর্ণ করে আনার কারণে খরচ বাড়ছে। 

সঞ্চালন লাইন নির্মাণ শেষ না হওয়ার কারণে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি চার্জ গুণতে হচ্ছে। এমতাবস্থায় পাশেই গড়ে তোলা হচ্ছে আরপিসিএলের ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরো একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পরিকল্পনা আছে ৩৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এলএনজি ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের। শুনেছি গভীর সাগরে এলএনজি স্থাপনা করে সেখান থেকে ৭০ কিলোমিটার সাব সে পাইপ লাইন দিয়ে আর এলএনজি সরবরাহের। কবে ৯ মন ঘি পুড়বে,  আর রাধা নাচবে?

একমাত্র মাতারবাড়িতে সম্ভব জ্বালানি আমদানি করার। কয়লা স্থাপনা ২ x ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু শেষ বেলায় জাপানিজ সরকার দ্বিতীয় ইউনিট থেকে পুঁজি প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। সরকার ইতিমধ্যেই মাতারবাড়িতে অনেক গুলো প্রস্তাবিত কয়লা প্লান্ট পরিকল্পনা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। ৪০ মিলিয়ন মেট্রিক টন ক্ষমতার কল ট্রান্সফার টার্মিনাল নির্মাণ পরিকল্পনা এখন বোতল বন্দি। এখানে ল্যান্ড বেসড এলএনজি টার্মিনাল আর এলপিজি টার্মিনাল পরিকল্পনা অনেক পিছিয়ে আছে। সরকার সবকিছুতেই দ্বিধা দ্বন্দ্বে থাকে।

বাংলাদেশের উচিত নিজেদের কয়লা উত্তোলনের তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ, জলে স্থলে গ্যাস তেল উত্তোলনের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা। একই সঙ্গে নবায়ন যোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের সকল উৎস অনুসন্ধান করে বাস্তবমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এতো সব করার ক্ষুধা সরকারের আছে কি? আমলা নির্ভর জ্বালানি বিদ্যুৎ ব্যাবস্থাপনার কারণেই এখন জ্বালানি খাত পঙ্গু অক্ষম হয়ে পড়েছে। 

শেয়ার করুন