২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৩:৩৩:৫৩ পূর্বাহ্ন


বিজয়ের আনন্দ, পতাকার আলোরেখা
ফকির ইলিয়াস
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৪-১২-২০২২
বিজয়ের আনন্দ, পতাকার আলোরেখা


প্রায় প্রতিটি শহর থেকেই বিজয়ের খবর আসতে শুরু করেছে। ভারতীয় যুদ্ধ বিমান উড়ছে বাংলার আকাশে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, ভেবে কূল পাচ্ছে না, এখন তাদের উপায় কি! এদিকে ১৪ ডিসেম্বর বাংলার মাটিতে শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। পাক-হানাদার বাহিনী বুঝতে পারে, তাদের সময় শেষ! তাই তারা জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনা নেয়। শুরু হয় বুদ্ধিজীবী হত্যা। বাংলার মেধাবী শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, পেশাজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে ধরে নিয়ে তারা হত্যা করে। বিষয়টি গোটা বাঙালি জাতির কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। সেই সময়ে ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেটে থাকা প্রিন্সিপাল অফিসার মি. হার্বার্ট স্পিভাক ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১, এক তার বার্তায় ওয়াশিংটনকে জানান, হানাদার বাহিনী খুব নির্লজ্জভাবে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের খুন করেছে। এদিকে ১৬ ডিসেম্বর যতোই ঘনিয়ে আসছিল, গোটা বাংলাদেশজুড়ে ছিল টান টান উত্তেজনা। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত গোয়ান্দা সংস্থাগুলো জানাচ্ছিল, ইস্ট কমান্ডের পাক-কমান্ডার জেনারেল নিয়াজী যে কোনো সময় পদত্যাগ করতে পারেন।

১৫ ডিসেম্বর দুপুর থেকেই ভারতীয় সেনাপ্রধান  জেনারেল মানেক শ’র ঘোষণা আকাশবাণীসহ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হতে থাকে। তিনি বলছিলেন, ‘হাতিয়ার ঢাল দো’। অর্থাৎ অস্ত্র সমর্পণ করো। সেই উত্তেজনার মধ্য দিয়েই মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং অরোরা হেলিকপ্টারে এসে নামেন ঢাকায়। ১৬ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটার দিকে স্বাক্ষরিত হয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ চুক্তি। মনে পড়ছে, আমাদের ফিলিপস রেডিওটি নিয়ে সেদিন ধীর আগ্রহে বসেছিলাম বিবিসি শুনতে। অবশেষে আসে সেই নিউজ- পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। মাগরিবের নামাজ পড়ে মোনাজাত শেষে আমার মা জানতে চেয়েছিলেন, ‘যুদ্ধ কি শেষ বাবা!’ আমি বলেছিলাম, জয় বাংলা! আব্বা তখনো ইংল্যান্ডে। একটি ব্রিটিশ শিপিং কোম্পানির ঊর্ধ্বতন চাকরিজীবী হিসেবে, তিনি তখন দেশে ফেরার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।

২০ ডিসেম্বর থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা এলাকায় ফিরতে শুরু করেন। আমাদের এলাকায় মুক্তিসেনার সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ শতেরও বেশি। তারা আকাশে ফাঁকা গুলি করতে করতে গ্রামে গ্রামে আসতে থাকেন। সে এক অভিনব আনন্দ। সে এক উজ্জ্বল জয়োল্লাস। ডিসেম্বরের শীত মৌসুম উৎসবে পরিণত হয়েছিল বাংলার গ্রামাঞ্চল। গরু-খাসি জবাই করে বড় কয়েকটি উৎসব আপ্যায়নের আয়োজন করা হয় আমাদের এলাকায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানে ছিল সেসব ভূঁড়িভোজ। 

মনে পড়ছে, বাজারে বাজারে, নদীর ঘাটে, স্কুল-কলেজগুলোর ছাদে ছাদে মাইক লাগিয়ে তখন বাজানো হচ্ছিল মুক্তিযুদ্ধের গান। ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠধ্বনি...’ এমন গানে গানে মুখরিত ছিল বাংলার জনপদ।

বিজয় এসেছে, কিন্তু সবাই কি ফিরে এসেছেন? এমন একটা উৎকণ্ঠায় ছিল পুরো দেশ!  সুখ, আনন্দ আর বেদনার সুর ছিল চারিদিকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুরো দেশটাকেই তছনছ করে গেছে! এমন ধ্বংসস্তূপ থেকে বেদনায় কুঁকড়ে উঠছিলো কোটি কোটি বাঙালি।

শেয়ার করুন