২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ৬:০৭:৩৮ অপরাহ্ন


সংসদ ভবন থেকে গণভবনে পদযাত্রা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান বির্তক
সোহেল তাজের পদযাত্রায় অস্বস্তি
সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৪-২০২২
সোহেল তাজের পদযাত্রায় অস্বস্তি তিন দাবিতে সংসদ ভবন থেকে গণভবনে সোহেল তাজের পদযাত্রা : ফেসবুক থেকে সংগৃহীত


তিন দাবিতে সংসদ ভবন থেকে গণভবনে সোহেল তাজের পদযাত্রা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানান বির্তকের পাশাপাশি প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। উঠেছে আলোচনার ঝড়। এ ঘটনায় সরকার বিব্রতই শুধু নয় সাথে আছে অস্বস্তিও। 

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর তাজউদ্দীন আহমদকে তার অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে জেল হত্যার শিকার হয়ে তাজউদ্দীন আহমদের জীবনাবসান ঘটে। হত্যার শিকার হয়ে অন্যান্যরা হলেন, ১৯৭৫ সালের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান। তাজউদ্দীন আহমদের সন্তান সোহেল তাজ গত ১০ এপ্রিল রোববার রাজধানীর সংসদ ভবনের সামনে থেকে গণভবন পর্যন্ত এই পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করা হয়। তার সঙ্গে ছিলেন এক ঝাক তার সাপোর্টারও। 

তার তিনদফা হচ্ছে ১০ এপ্রিলকে (১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদ গঠিত হয়) প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণা করতে হবে। ৩ নভেম্বর জেল হত্যা দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করতে হবে। এবং তিন হচ্ছে জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তির অবদান ও জীবনীসহ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তকে ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পদযাত্রার সামনে ছিলেন সোহেল তাজ ও তাঁর বোন মাহজাবীন। সোহেল তাজের হাতে একটি প্ল্যাকার্ড ছিল। তাতে তিনটি দাবি লেখা ছিল। পদযাত্রা নিয়ে গণভবনে পৌঁছে দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি তুলে দেন সোহেল তাজ । 

তার পদযাত্রার সামনে পুলিশি পাহারা ছিল। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাত হয়ে আড়ংয়ের উল্টো দিক দিয়ে আসাদ গেট পেরিয়ে গণভবনের মূল ফটক পর্যন্ত ছিল এ  পদযাত্রা। পদযাত্রা গণভবনের গেটে এসে পৌঁছায়। গণভবনের গেটে পদযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের বসার জন্য ৫০টির মতো প্লাস্টিকের চেয়ার রাখা হলেও অংশগ্রহণকারী কেউ চেয়ারে বসেননি। সোহেল তাজকে স্বাগত জানাতে অবশ্য গেটের বাইরে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া। সোহেল তাজ ও মাহজাবীন আহমেদকে গণভবনের মূল ফটকের অভ্যর্থনাকক্ষে নিয়ে যান বিপ্লব বড়ুয়া। 

অভ্যর্থনাকক্ষ থেকে কিছুক্ষণপর বেরিয়ে এসে গণমাধ্যমকে সোহেল তাজ বলেনে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি নিয়ে এসেছেন তিনটি দাবি নিয়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যদি কোনো ফাঁক থাকে, তাহলে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি সেই ফাঁক পূরণ করার সুযোগ পাবে। বাংলাদেশকে যদি সোনার বাংলা হিসেবে বিনির্মাণ করতে হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ  প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। তিনি বলেন, ‘আশা করছি  প্রধানমন্ত্রী একমাত্র ব্যক্তি, যিনি এই তিনটি দাবি বাস্তবায়ন করতে পারবেন। তাঁর ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। এই ইতিহাস গৌরবের ইতিহাস। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, সামরিক, বেসামরিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিকভাবভাবে যারা সহযোগিতা করেছেন, মুক্তিযুদ্ধে যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এবং অমর শহীদসহ তাদের ইতিহাস থেকে আমরা আমাদের প্রাণশক্তি খুঁজে পাবো। এ সময় সোহেল তাজের সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজ এবং সোহেল তাজের ছোট বোন মাহজাবিন আহমদ মিমিসহ কর্মী-সমর্থকরা।

একিই দাবি রবের

এদিকে ১০ এপ্রিলকে প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলক ও জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনি বলেছেন,স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে’ রাষ্ট্র বিনির্মাণের আইনগত ও দর্শনগত নির্দেশনা রয়েছে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জারিকৃত এই ঘোষণাপত্র জনগণের জন্য ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক সুবিচার’ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ঘোষণার মাধ্যমে জাতি-রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের সকল আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণতা এবং আইনগত ও নৈতিক বৈধতা দিয়েছে। ঘোষণাপত্রটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত রাজনৈতিক দলিল। সুতরাং, রাষ্ট্র বিনির্মাণের স্মারক হিসেবে ১০ এপ্রিলকে 'প্রজাতন্ত্র দিবস' ঘোষণা করতে হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে 'প্রজাতন্ত্র দিবস' ঘোষণাই হবে স্বাধীনতার চেতনা ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের অন্যতম পদক্ষেপ। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এই ত্রয়ী আদর্শকে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে কার্যকর করতে হবে। গত শনিবার নোয়াখালী জেলা জেএসডি'র প্রতিনিধি সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রব এদাবি তোলেন। 

সরকার যে কারণে বিব্রত অস্বস্তিতে

সরকার বিভিন্ন ধরনের সমস্যার এখন রয়েছে। একেতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে সরকার আছে মহা বেকায়দায়। সামনে জাতীয় নির্বাচন। এতে বিএনপি অংশ গ্রহণ করানোর জন্য সরকারের বিভিন্ন মহল কাজ করে যাচ্ছেন নিচ্ছেন কৌশল। সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি এমন অভিযোগ এবার এলে সরকারের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনবে। দেশে বিদেশে নানান ধরণের সঙ্কটে তারা পড়বে। এধরণের পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজের পদযাত্রা     রাজনৈতিক অঙ্গনে অবশ্যই অন্য কিছুর ইঙ্গিত করে। 

অন্যদিকে নীতিনিষ্ঠতা, ন্যায়পরায়ণতা, নিয়মানুবর্তিতা, ন্যায্যতা, সময়ের সদ্ব্যবহার, আর্থিক ও মানসিক সততা, সাধারণ মানুষের প্রতি সম্মান, আমানতের জিম্মাদারি, বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়ানো,  নিজের কাজ নিজে করা, সরল সাদাসিধে জীবনযাপন, কথার বরখেলাপ না করা, তাজউদ্দীন আহমদের জীবনের সত্যনিষ্ঠ অনুষঙ্গ ছিল আমৃত্য। কানো পরিস্থিতিতেই জীবনের এসব উচ্চায়ত মূল্যবোধ থেকে পিছু হটেননি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। অভিযোগ রয়েছে এমন ব্যক্তি দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তেমন উজ্জ্বলভাবে নেই। এমন অভিযোগ এ সরকারের আমলেই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে খোদ তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারবর্গের পাশাপাশি বিএনপিসহ বির্ভিন্ন বিরোধী দলের পক্ষ থেকে। 

অন্যদিকে অনেক শরিকদলও অভিযোগ করেছে যে বর্তমান সরকার স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করছে। আলোচনা সমালোচনার ঝড় বইছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানের মতো ব্যক্তিদের মুল্যায়িত হচ্ছে স্বাধীনতার ইতিহাসে। বলা হচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্য সম্পর্কিত দিবস অনেক বেশি আয়োজন করে পালনেই ঝোক।

সেদিক থেকে সোহেল তাজের পক্ষ থেকে জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যক্তির অবদান ও জীবনীসহ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তকে ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি মাঠের বিরোধী দলের মতের সাথেই মিল খুজে পাওয়া যায়। যা সরকারের জন্য বিব্রতকর ও অস্বস্তিও বটে। কেননা বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বেশ কয়েকবারই ভভিযোগ করেছিলেন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম উচ্চারণ করা হয়নি, তাজউদ্দীন আহমদের কথা উচ্চারণ করা হয়নি, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীকে আড়ালে রাখা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়ন নেতা বলেন, তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে তাকে বেশ কয়েকবারই বলা হয়েছে যে এসব নিয়ে যেনো দলে কথা বলা হয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজের মনের মধ্যে অনেক চাপা ক্ষোভ দিনে পর পর জমে আছে। যা মাঝে মাঝে ফুসে উঠছে। তকে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজের এমন কর্মসূচি অবশ্যই সরকারের জন্য মাইনাস পয়েন্ট বলে তিনি মনে করেন।  


শেয়ার করুন