২৯ মার্চ ২০১২, শুক্রবার, ০১:০২:৪০ পূর্বাহ্ন


নারী উন্নয়ন সংস্থা খাদিজা-সালেয়ারের রোজগারের পথ দেখিয়ে দিল
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-১২-২০২২
নারী উন্নয়ন সংস্থা খাদিজা-সালেয়ারের রোজগারের পথ দেখিয়ে দিল প্রতিবন্ধী খাদিজা এখন সুখে আছে


খাদিজা বেগম (বাক প্রতিবন্ধী)। পিতার নাম হোসেন মিয়া। মাতা  হোসনে আরা। চাদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার মোরগার পাড় শুয়ারোল গ্রামের বাসিন্দা সে। অন্যদিকে  সালেয়ার বয়স ২০। ৪ ভাই-বোনের মধ্যে সে তৃতীয়। বাবার আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যে এসএসসি পাশ করেন ভাল রেজাল্ট নিয়ে। মেয়েটির বিয়ে নিয়ে হোসেন মিয়ার অনেক দুচিন্তা। মেয়েটি বাক প্রতিবন্ধী অর্থাৎ কথা বলতে পারে না। হোসেন মিয়া দারিদ্রের দুষ্টুচক্রের মধ্যে বসবাস করেন। আর্থিক সংগতি নেই যে মেয়েকে বিয়ে দিবেন। ২০১৭ সাল এসএসসি পাশ করার পর মেয়েটিকে নিয়ে নারী উন্নয়ন সংসার অফিসে আসেন তার বাবা এবং সেলাই প্রশিক্ষণ ক্লাশে ভর্তি করানোর অনুরোধ করেন। প্রতিবন্ধী হিসাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভর্তি করিয়ে নেওয়া হয়। অন্যদিকে বাক প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে খাদিজকে আকার-ঈগীতে বুজিয়ে দিলে সে সব সেলাই করতে ও কাপড় কাটতে পারে। অনেক ডিজাইনের কাজ করতে পারে। প্রশিক্ষক খাদিজাকে নিয়ে প্রথমে বুঝাইতে কষ্ট হলেও পরে সে খুব ভালভাবে কাজ করতে পারে এবং সবার আগে ক্লাশে উপস্থিত হয়। বাক প্রতিবন্ধী হিসাবে তার কাজের আগ্রহ অত্যন্ত ভাল ছিল। ৬ মাস পড়ে সকলের সাথে সে সেলাই মেশিন পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। বাড়িতে সে সেলাই কাজ করতো এবং ভালো আয় করতো। পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক চাকুরীজীবী ছেলের সাথে খাদিজার বিয়ে হয়। ছেলের বাবার দাবি ছিল মেয়েকে যেন সেলাই মেশিনটি দেওয়া হয়। খাদিজার জীবন সঙ্গী হলো তার কাঙ্খিত সেলাই মেশিন। সেলইকাজ শিখার গুনে খাদজিার বিয়ে হলো। শশুর-শাশুড়ি খাদিজাকে খুব আদর করে। খাদিজা এখন এক সন্তানের জননী। খাদিজা এখন সুখে আছে। 

২০১৭ সালের এপ্রিল মাস। শারমিন আকতার, পিতার নাম আবু তাহের মোল্লা। গ্রাম : শুয়রোল মোল্লা বাড়ি, সাচার, কচুয়া, চাঁদপুর। বয়স ২৫। ৫ ভাই-বোনের মধ্যে সে বড়। দরিদ্র পিতার একমাত্র বরসা শারমিন। লেখাপড়া ৫ম শ্রেণী পযর্ন্ত। ২০১৪ সালে তার বাবা নারী উন্নয়ন সংস্থার অফিসে শারমিনকে নিয়ে এসে কান্ন-কাটি শুরু করেন। হত দরিদ্র তালিকায় শারমিনের নামও ছিল। সংস্থার সভানেত্রী মীরা রানী দাস তার অসায়ত্বের ও আর্থিক অসচ্ছলতার কথা শুনে মেয়েটির সাথে আলোচনা করে শারমিনকে সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করিয়ে নেন নিয়ম অনুযায়ী। ০৬ মাস প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে ২০টি সেলাই মেশিন বিনা মুল্যে বিতরণ করা হয় । শারমিন সেলাই মেশিন পেয়ে আনন্দে সে কেঁদে ফেলে। উপস্থিত অংশীজনের সামনে তার ভাবাবেগ ধরে রাখতে পারেনি। তার বাবা সেলাই মেশিন তার মেয়েকে দেওয়াতে সে আল্লারহর নিকট দু’হাত তুলে নারী উন্নয়ন সংস্থার জন্য দোয়া করেন। শারমিন সেলাই প্রশিক্ষণের সময় একদিনের জন্যও অনউপস্থিত থাকেনি। কাজের প্রতি তার ছিল একাগ্রতা, শ্রম ও অধ্যবাসয় । প্রশিক্ষণের ০৪ মাসের সময় সে একাকী সেলাই কাজের অর্ডার নিয়ে আসতো। দেখা গেছে প্রশিক্ষণকালীন সময়ে সেলাই করে দৈনিক ১৫০/২০০ টাকা আয় করতো। 

বর্তমানে সে বাড়িতে পারদর্শিতার সাথে সেলাই কাজ করে। এতে তার মাসিক ৬০০০/৭০০০ টাকা মাসিক আয় হয়। দুই ঈদে বেশি অর্ডার পান । সংসারের কাজকর্মও করেন।  গ্রামের সকল মহিলারা তার কাছে আসে সেলাই কাজের অর্ডার নিয়ে। সে বিভিন্ন ডিজাইনের সেলাই কাজ করে থাকেন। তার চোখে-মুখে এখন হাসি।  ২০১৯ সালে একই গ্রামের বিদেশ কর্মরত এক ছেলের সাথে তার বিয়ে হয় এবং এক কন্যা সন্তানের জননী। শারমিন এখন সুখে আছেন। নারী উন্নয়ন সংস্থার যে কোন কর্মসূচিতে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রতি বছর চাঁদপুর নারী উন্নয়ন মেলায় নারী উদ্যোগতা হিসাবে অংশগ্রহণ করেন তার তৈরিকৃত পোষাক নিয়ে নারী উন্নয়ন সংস্থার সাথে। 

নারী উন্নয়ন সংস্থা’  নারী নেত্রীত্বাধীন একটি বে-সরকারি অরাজনৈতিক, অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী নারী সমাজ কল্যাণমূলক সংগঠন। চাদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার সাচার ইউনিয়নের শুয়ারোল গ্রাম ও তৎসংলগ্ন এলাকার কতিপয় শিক্ষিত উদ্যোমী সমাজসেবায় ব্রতী মহিলা উদ্যোগ নিয়ে ২০০৪ ইং সালের শুরুতে এলাকার পিছিয়ে পড়া অবহেলিত হতদরিদ্র মহিলাদের উন্নতির চিন্তা-চেতনায় এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সমাজের পিছিয়ে পড়া অবহেলিত দরিদ্র মহিলা, বিধবা, তালাকপ্রাত মহিলা, যুবনারী ও প্রতিবন্ধীদের জীবন মানের উন্নয়নে নিজেদের শ্রমের মাধ্যমে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নমুলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৫ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর চাদপুর জেলা অফিস থেকে রেজিষ্ট্রেশন নেওয়া হয়।  

চাদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার সাচার ইউনিয়ন একটি দারিদ্র্যপীড়িত অনুন্নত এলাকা । ২০০৪ ইং সালে এলাকার দরিদ্র মেয়েদের জন্য একটি ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেদ্র উদ্বোধন করেন। বিনামূল্যে ২০ জন মহিলাকে ৬ মাস ব্যপি সেলাই প্রশিক্ষণের কাজ শিখিয়ে থাকেন। এর মধ্যে ৩টি প্রতিবন্ধী মেয়ে ছিল। পরবর্তীতে সেলাই কাজ শিক্ষার পরে তাদের বিয়ে হয়। ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি এখনও চলমান। সেলাই প্রশিক্ষণের পাশাপশি বেসিক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বেকার যুবনারী ও যুবদের।

সংস্থাটি ২০১৪ ইং সাল থেকে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আর্থিক সহযোগীতায় কচুয়া ও শাহ্রাস্থি উপজেলায় “মাতৃত্ব কাল ভাতা প্রদান প্রশিক্ষণ কর্মসূচি” বাস্তবায়নও করে আসছে। এ কর্মসূচির আওতায়  ২১০০ দরিদ্র মা’দের বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুর উপর যেমন : বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, তালাক, নারী নির্যাতন, বহুবিবাহ, যৌন হয়রানী, যৌতক প্রথা নিরোধ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, নারী অধিকার, প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। ২০১৯ ইং সাল থেকে সংস্থাটি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আর্থিক সহযোগীতায় কচুয়া পৌর সভায় “লেকটেটিন মাদার ভাতা প্রদান প্রশিক্ষণ কর্মসূচি” বাস্তবায়ন করে আসছে। এই কর্মসূচির আওতায়  ৬৫০ দরিদ্র মা’দের বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুর উপর যেমন : বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, তালাক, নারী নির্যাতন, বহুবিবাহ, যৌন হয়রানী, যৌতক প্রথা নিরোধ, জন্ম নিয়ন্ত্রণ, নারী অধিকার, প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।

২০১৪ ইং সাল খেকে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগীতায়  হত দরিদ্র মহিলা ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষমতায়নে সেলাই প্রশিক্ষণ  ও হস্তশিল্প কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের সহযোগীতায় ৬ মাস বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। স্থানীয় সরকার ও উপজেলা প্রশাসনের  উপস্থিতিতে প্রশিক্ষণ শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের সেলাই মেশিন বিনামূল্যে বিতরন করা হয়। 

২০১৮ সালে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধিভুক্ত হওয়ার পর অধিদপ্তরের সহযোগিতায় সাচার ইউনিয়নের ৯ ওয়ার্ডে কমিউনিটি বেইজড ডিষ্ট্রিবিউশান (সিবিডি) কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এখানে ৫০০ সক্ষম দম্পতি রয়েছেন যাদের প্রতি মাসে বিনামূল্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণের উপাদান সংস্থার কর্মীর মাধ্যমে সরবরাহ হয়।

২০২০ সালে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোগীতায় ২০ জন হত দরিদ্র জেলেদের মাছ ধরার বিক্রয় করার উপকরন বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় স্থানীয় সরকার ও উপজেলা প্রশাসনের উপস্থিতিতে। এছাড়া এবছর বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের সিএসআর (Corporate Social Responsibility) ডিপার্টমেন্টের সহযোগিতায় এলাকার গরীব বয়স্ক, শিশু ও গর্ভবতীদের মাঝে ৩০০টি শীতবস্ত্র কম্বল বিতরন করা হয়।

এছাড়া বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহযোতায় ২০২২ ইং সালে করোনা মহামারিতে ক্ষতিগ্রস্ত ১৩ জন হতদরিদ্র ভ্যানচালককে বিনামূল্যে নতুন ভ্যান গাড়ি বিতরণ করা হয়। তারা এখন ভ্যান চালিয়ে দৈনিক ৫০০-৬০০ টাকা আয় করেন। নারী উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি মীরা রানী দাস দেশ প্রতিনিধিকে বলেন, দেশে এধরনের কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ধন্য হয়েছেন। তিনি সুদূর প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশীদের কাছে দোয়া চেয়ে নারী উন্নয়ন সংস্থা মাধ্যমে কচুয়ার দরিদ্রপীড়িত এলাকার নারী , শিশু ও প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে এগিয়ে আসার জন্য বিনীত অনুরোধ জানান। এর পাশাপশি তাদের কার্যক্রম পরিদর্শন করার আমন্ত্রণ জানান।

শেয়ার করুন