২০ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৬:৩২:৩১ পূর্বাহ্ন


এমএসএফ মনিটরিং প্রতিবেদন
এপ্রিলে ২৩ অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার
বিশেষ প্রতিবেদন
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৫-২০২৩
এপ্রিলে ২৩ অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার


বাংলাদেশে চলতি বছরের এপ্রিলে ২৩ জনের অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এর পক্ষ থেকে মানবাধিকার পরিস্থিতি মনিটরিং প্রতিবেদন এপ্রিল ২০২৩’এ এসব তথ্য উঠে আসে। এমএসএফ’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। এমএসএফ’র পক্ষ থেকে পুরো এপ্রিলে অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের পরিসংখ্যান দেয়ার পাশাপাশি ২০২৩ এই  মাসের আরো অনেক তথ্য তুলে ধরে। আর এসব রির্পোট তুলে ধরে এমএসএফ’র পক্ষ থেকে বলা হয় যে অত্যন্ত উদ্বেগ-আতঙ্কের বিষয় অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা। দুই-একটি ঘটনা ছাড়া সব কয়টি লাশের পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে। যা অত্যন্ত ভয়ংকর, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ। কাজেই এসব ঘটনার জড়িতদের চিহ্নিত করে শান্তি নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারকেই এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে দৃশ্যত সম্পূর্ণ নির্বিকার।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী এ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১ জন শিশু, ১ জন কিশোর, ৩ জন নারী, ২ জন বৃদ্ধ, ৫ জন মাঝ বয়সী ও ১১ জন যুবক, মোট ২৩ জনের অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। গত মাসে এর সংখ্যা ছিল ২৭ জন। এসব অজ্ঞাতনামা লাশ বেশিরভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, বস্তাবন্দী, মহাসড়কের পাশে, ব্রিজের নিচে, রেললাইনের পাশে, গলায় গামছা পেচানো, জঙ্গল, বিল বা ফসলী ক্ষেতে রশি দিয়ে হাত পা বাধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এমএসএফ মনে করে, শুধুমাত্র অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা যত ক্ষমতাবানই হোক, সব অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের জন্য জরুরি।

এদিকে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী  ২০২৩’এ এপ্রিলেয় মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ মাসেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু, তাদের পরিচয়ে অপহরণ, গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মৃত্যু ও নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রাপ্ত তথ্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায় ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের উপর সহিংসতার ঘটনা কিছুটা কমেছে তবে অবশ্যই উদ্বেগজনক ছিল। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ নাগরিকদের বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মত ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহতের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। অধিকন্তু সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাও বারংবার ঘটেই চলেছে। সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনাও বন্ধ হয়নি। এছাড়াও কারা হেফাজতে মৃত্যু ও গণপিটুনির মত আইন হাতে তুলে নেয়ার ঘটনাও প্রতিহত করা যায়নি। এ মাসে একাধিক বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিকান্ডের ঘটনা জনমনে উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা এভাবে বিরামহীনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। একই সাথে এসব ঘটনা রোধে সরকারের নিস্ক্রিয়তারও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে। পাশাপাশি মানবাধিকার লংঘনকারীদের বিচার ও ভূক্তভোগীদের জন্য সুবিচারের দাবি জানাচ্ছে। 

বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা  

এমএসএফ’এর পক্ষ থেকে বলা হয় যে, দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল, ২০২৩ মাসে বন্দুকযুদ্ধের ৪টি ঘটনা ঘটেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ৩ জন ও আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। নিহতদের মধ্যে ২ জন বাংলাদেশী নাগরিক ও অপর একজন রোহিঙ্গা সংগঠন আরসা কমান্ডার। অপর একটি ঘটনায় কোন হতাহতের ঘটনা না হলেও দুইজন রোহিঙ্গা নারীসহ চারজনকে আটক করা হয়। 

অপহরণ/নিখোঁজ

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের নামে যে অপতৎপরতা চলছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার ও মানবাধিকারের চরম লংঘন। যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং নাগরিক জীবনে চরম উৎকন্ঠার সৃষ্টি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত আস্থাহীনতা তৈরি করছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার ৬টি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ৬টি ঘটনায় ১৯ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। যার মধ্যে পরবর্তীতে মামলা দেখিয়ে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে ১০ জনকে, অস্বীকার করা হয়েছে ২টি ঘটনার, উদ্ধার দেখানো হয়েছে ১ জনকে ও ৬ জনের বিষয়ে ডিবি এখনও কোনো তথ্য দেয়নি।

পুলিশের ধাওয়া খেয়ে মৃত্যু..

এমএসএফ’এর পক্ষ থেকে বলা হয় যে, এপ্রিলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে এক জন ও গ্রেফতার এড়াতে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে একজনের মৃত্যু হয়। পুলিশী হেফাজতে আসামির মৃত্যুর বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত ও জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে।

নির্যাতন ও অপতৎপরতা

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল ২০২৩ মাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনসহ কয়েকটি অপরাধের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এমএসএফ মনে করে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে অপতৎপরতা চলছে তা অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকারের চরম লংঘন ও ন্যায়বিচারের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গলি প্রদর্শনেরই নামান্তর । যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং যা নাগরিক জীবনে চরম উৎকণ্ঠা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি ক্রমাগত অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার জন্ম দিচ্ছে। 

কারা হেফাজতে মৃত্যু

এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল ২০২৩ মাসে কারা হেফাজতে ১ জন নারী কারারক্ষীর আত্মহত্যাসহ ২ জন নারী, ১ জন পুরুষ হাজতির আত্মহত্যা ও ১ জন ভারতীয় নাগরিকসহ মোট ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। গত মাসে কারা হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬ জন। কারা হেফাজতে মৃতদের মধ্যে ৮ জন কয়েদি ও ৮ জন হাজতি রয়েছে। কারাগারে অপর্যাপ্ত চিকিৎসার কারণে অসুস্থ অধিকাংশ বন্দিকে কারাগারের বাইরে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত্যু ঘোষণা করেন। এমএসএফ মনে করে, কারাগারের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি, হেফাজতে মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে তদন্তকরা গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতা, মামলা এবং গ্রেফতার 

রাজনৈতিক অঙ্গনে সরকার ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহিংসতা, হানাহানি হতাহতের ঘটনাসহ নাগরিক জীবনে উৎকন্ঠা ও হতাহতের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এ সময়ে বিরোধী দল বিএনপি ও বিরোধীয় দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক অতিরিক্ত বল প্রয়োগ, শান্তিপূর্ণ সভা, মিছিলে বাধাদান অব্যাহত ছিল। সংবাদমাধ্যমে পাওয়া এবং এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহিত তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল, ২০২৩ মাসে বিভিন্ন জেলায় সভা সমাবেশে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহিংসতার ৪০টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪৬৯ জন। এ সময়ে নির্বাচনী, রাজনৈতিক সহিংসতা ও সভা সমাবেশে বাধার ঘটনায় মোট ৪৬১ জন আহত ও ৮ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩ জন ক্ষমতাসীন দলের, ১ জন মুদি দোকানদার, ১ জন টাইলস শ্রমিক, ১ জন বিএনপির কর্মী ও ২ জন সাধারণ নাগরিক মারা গিয়েছেন। আহতদের মধ্যে ৫ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। 

এ মাসে ১০টি রাজনৈতিক মামলা হয়েছে। যার মধ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে ৬টি, জামায়েত ইসলামী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৩টি এবং বিএনপি ও জামায়াতে উভয় দলের কর্মীর বিরুদ্ধে ১টি মামলা করা হয়েছে। মামলায় মোট ৩৩৮ জন রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ মাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চলমান অবস্থায় গ্রেফতার করা হয় ১৮৮ জন, বাড়ি ও বিভিন্ন স্থান থেকে অভিযান চালিয়ে ৮২ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। অপরদিকে আদালতে জামিন প্রার্থনাকালে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে ৬৮ নেতাকর্মীকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ২৫৯ জন বিএনপি, ৮ জন এলডিপির এবং ৭১ জন জামায়েতে ইসলামীর কর্মী।

শেয়ার করুন