২৯ এপ্রিল ২০১২, সোমবার, ০৮:১৬:১৩ পূর্বাহ্ন


মৃত্যুর পরও প্রশ্ন- তুমি কার?
নিজস্ব প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৩-২০২৪
মৃত্যুর পরও প্রশ্ন- তুমি কার? বৃষ্টি খাতুন


অভিশ্রুতি শাস্ত্রী, না বৃষ্টি খাতুন এ নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। চলছে বিভিন্ন প্রান্তরে আলোচনা। একজন প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলা অভিশ্রুতি শাস্ত্রী বা বৃষ্টি খাতুন। কিন্তু তার অভিভাবক কে, সেটা নিয়েই এখন তোলপাড়। মাথা ঘামাতে হচ্ছে প্রশাসনকে। তবে এমনটা হওয়ার কারণ ওই মহিলার বাবা-মা পরিবারের দাবি উপেক্ষিত হওয়ার সূত্র থেকে। তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে তিনি একজন মুসলিম পরিবারের সন্তান। কিন্তু এতে বাগড়া দিয়েছে একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ও রমনা কালী মন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা। ঘটনার সূত্রপাত এখান থেকেই। তার দাবি সে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত ও সে মূলত হিন্দু ধর্মেরই এবং ছোটবেলায় তাকে দত্তক নেয় বর্তমান বাবা-মা দাবিকারীরা। ফলে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর সৎকার হবে হিন্দু রীতিতে। কিন্তু বাবা-মা কঠোরভাবে দাবি করছেন যে, বৃষ্টি খাতুন তাদের মেয়ে। এজন্য সব ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা (ডিএনএ টেস্ট) করাতেও তারা রাজি। বাবা-মার এমন সৎ সাহসে পাল্টে যাচ্ছে পরিস্থিতি। 

তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী মূলত বৃষ্টি খাতুন। অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, একাডেমিক সার্টিফিকেট, চাকরির স্থলে বায়োডাটা, ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, বাবা-মা ও এলাকাবাসীর বক্তব্য, মিডিয়ার সরেজমিন প্রতিবেদন, এমনকি ফিঙ্গারপ্রিন্ট পরীক্ষা করেও তিনি মুসলিম পরিবারের সন্তান এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এতগুলো ডকুমেন্ট দ্বারা নিশ্চিত হওয়ার পরেও একজন উৎপল সাহার অভিযোগের ভিত্তিতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য তার লাশ রাখা হয়েছে মর্গে। বৃষ্টি খাতুনের বাবা-মা ডিএনএ পরীক্ষা দিতেও প্রস্তুত এবং ইতিমধ্যেই তাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ডিএনএ টেস্টের রেজাল্ট কী আসবে তা পূর্বানুমান করা কঠিন। ফলে জনমনে প্রশ্ন মৃত্যুর পরও এ মহিলার পরিচয়টা আসলে কী, কে সে? আসলেই তুমি কার? উপল সাহাদের নাকি বিউটি শাবলুরদের। 

মূর্ছা যাচ্ছেন মা বিউটি 

বেইলি রোডে আগুনের ঘটনায় নিহত সাংবাদিক বৃষ্টি খাতুন অথবা অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর মা বিউটি খাতুন চিৎকার করে বলছেন, ‘আমার সোনাকে আমার বুকে দেন না কেন? প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানালাম, আমার মেয়েকে ভিক্ষা চাই। ও আমার বড় সন্তান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করি, আমার সোনাকে আমার কাছে এনে দেন।’ অভিশ্রুতি শাস্ত্রী বা বৃষ্টি খাতুনের মা বিউটি বেগম বলেন, ‘আমার বুক যে হাহাকার করছে। আমার সোনাকে আমাকে দেন। একটা মা আপনার কাছে আবদার করছে। আমার মেয়েরে আমার কাছে দেন। আমার বুকের মানিক আমার কাছে দেন একটু। আমি আমার বুকটা ঠান্ডা করি। আমার সোনারে আমার কাছে দেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি আবেদন করছি, আমার সোনাকে আমার কাছে দিক।’ 

জানা গেছে, অভিশ্রুতির বা বৃষ্টির নিকটাত্মীয় ও শিক্ষাগুরু কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, ২০১৫ সালে বৃষ্টি খাতুন বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক মানবিকে ভর্তি হন। ২০১৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজে দর্শন সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। 

তার শিক্ষক সফিকুল ইসলাম বলেন, ছাত্রজীবনের বৃষ্টি খাতুন পড়ালেখায় বেশ মেধাবী ছিল। ওর উচ্চ স্বপ্ন ছিল। বিসিএস দিয়ে সরকারি চাকরি করবে বলে একাডেমিক পড়ালেখার পাশাপশি প্রস্তুতিও নিচ্ছিল।’ 

উল্লেখ্য, রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডে অগ্নিকা-ে নিহত দ্য রিপোর্টের নির্বাচন কমিশন বিটের সাবেক সাংবাদিক অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর (বৃষ্টি খাতুন) গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার বনগ্রাম পশ্চিমপাড়ায় মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর থেকে শুরু হয় শোকের মাতম। এলাকাবাসীসহ আত্মীয়স্বজন সবাই বাড়িতে ভিড় করছে। নিহত বৃষ্টির মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন প্রতিবেশীরা। নিহতের মা বিউটি বেগম ও ছোট দুই বোন একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া-ঝর্ণা ও দশম শ্রেণির ছাত্রী বর্ষা খাতুনকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। 

এলাকাবাসী ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নিহত সাংবাদিক বৃষ্টি খাতুনের (অভিশ্রুতি শাস্ত্রী) বাবা সাবলুল আলম সবুজ রাজধানী ঢাকায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। তার তিনটিই কন্যাসন্তান। বড় মেয়ে নিহত বৃষ্টি খাতুন, মেজো মেয়ে ঝর্ণা খাতুন, রাজবাড়ী সরকারি কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী আর ছোট মেয়ে বর্ষা খাতুন স্থানীয় বনগ্রাম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। 

কেন উৎপল সাহা ফ্রন্ট লাইনে 

ঢাকার রমনা কালীমন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা সাংবাদিকদের বলেন, মন্দিরের পক্ষ থেকে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং জেলা প্রশাসক বরাবর অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর পরিচয় নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে, তার সমাধানে ডিএনএ পরীক্ষার আবেদন করা হয়েছে। 

উৎপল সাহা বলেন, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী ৮ থেকে ৯ মাস ধরে মন্দিরে যাতায়াত করতেন, পূজা করতেন। সে সূত্রেই তার সঙ্গে পরিচয়। অভিশ্রুতি শাস্ত্রী জানিয়েছিলেন, তার মা বাবা বেনারসে থাকতেন। তারা মারা যাওয়ায় দাদুর হাত ধরে ঘটনাচক্রে তিনি কুষ্টিয়ায় এসেছিলেন ছোটবেলায়। অভিশ্রুতির দাদু মারা গেলে একটি পরিবার তাকে দত্তক নিয়েছিল। তবে এ পরিবার মুসলিম না হিন্দু ছিল, তা তিনি বলেননি। অভিশ্রুতি মারা যাওয়ার পর তার মুসলিম বাবা লাশ নিতে ঢাকায় এসেছেন। তাই অধিকতর তদন্ত করে অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর আসল পরিচয় সামনে আনা জরুরি। তিনি আরো বলেন, পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর অভিশ্রুতি শাস্ত্রী যদি মুসলমান হন, তাহলে সেই ধর্মীয় রীতিতে, আর যদি হিন্দু হন, তাহলে সেই ধর্মীয় রীতিতে সৎকার করতে হবে। বর্তমানে তার লাশ মর্গে পরে আছে। 

কেন এমন অবস্থার তৈরি 

অভিশ্রুতি শাস্ত্রী কেন বৃষ্টি খাতুন নামের পাশাপাশি অভিশ্রুতি শাস্ত্রী হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে চেয়েছিলেন এটা বেশ নিয়ে আলোচিত হচ্ছে। একজন মুসলিম ধর্মের মানুষ কেনই বা মন্দিরে যাতায়াত করতেন এ নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। জানা গেছে, বৃষ্টি খাতুনের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ছিল প্রবল বাসনা। দরিদ্র ঘরের সন্তান হওয়ায় মুসলিম পরিচয়ে তিনি বেশিদূর এগোতে পারবেন না এজন্য হয়তো নাম পরিবর্তন করে সেটা আড়াল করতে চেয়েছিলেন। কারণ হিন্দু ধর্মের লোকসংখ্যা কম বিধায় সুবিধাটা তিনি নিতে পারতেন এমনটাও হতে পারে। কারণ সে নিয়মিত মন্দিরে যেতেন এবং পূজা আর্চনাও করতেন এর প্রমাণ পাওয়া গেছে তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের টাইমলাইনে। তাছাড়া রমনা কালী মন্দিরের সভাপতি একেবারে বানোয়াট কথা বলবেন এটাও না। হঠাৎ করেই একজন পুড়ে মারা যাওয়া মানুষের নামে উদ্ভট তথ্য হাজির করে ঝামেলা পাকানোটা শোভনীয় নয়, সেটা তিনি নিজেও জানেন। ফলে এর প্রেক্ষাপট তৈরি করে রেখে গেছেন বৃষ্টি খাতুন ওরফে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। 

এটা হতে পারে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যে তিনি এই কাজটি করেছিলেন। একটা মুসলিম মেয়ে হিন্দু পরিচয়ে মন্দিরে যাতায়াত করছে, পূজা অর্চনা করছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে ওঠাবসা করছে এবং তাদের বিশ্বাস অর্জন করেছে-এটা তার ব্যক্তিস্বাধীনতা হলেও এর মাধ্যমে তিনি কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করতে চেয়েছিলেন, নাকি স্বেচ্ছায় হিন্দুধর্মে আকৃষ্ট হয়ে এসব করেছিলেন, সেটা তিনি জানেন! তবে বিষয়টি বেশ রহস্যজনক।

শেয়ার করুন