২৮ এপ্রিল ২০১২, রবিবার, ০৬:৪৩:৪২ অপরাহ্ন
শিরোনাম :


নির্বাচনী নিয়ে বাড়ছে উত্তাপ উৎকণ্ঠা
মাসউদুর রহমান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৮-২০২২
নির্বাচনী নিয়ে বাড়ছে উত্তাপ উৎকণ্ঠা


ক্রমশই ঘনিয়ে আসছে জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ। আর মাত্র দেড় বছর। তবে এটাও কম সময় নয়। দেড় বছর একটি সরকারের জন্য অনেক বিশাল সময়। কিন্তু দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশে বিভিন্নমহলে যেসব তৎপরতা চলছে, সেটাতে এ দেড় বছরই কেমন যেন একটা উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া প্রতিপক্ষ থেকে শুরু করে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরাও বেশ তৎপর। একে অপরের প্রতি রাখছেন তীক্ষè নজর।

আগামী দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে চারটি পক্ষ ভীষণ তৎপর। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র, বিএনপি ও তার মিত্র। এ দু’পক্ষকে আবার সাপোর্ট দিচ্ছেন ভিনদেশি দুটি পক্ষ। ওই ক্ষেত্রে কোন দলের পক্ষে কে, এটা স্পষ্ট না হলেও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সেটা আবার স্পষ্টও হয়ে যায় একটু দৃষ্টি দিলেই। কারোরই আর জানতে বাকি নেই, গোটা বিশ্ব মোটামুটি দু’ভাগে। একভাগ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও তাদের মিত্র। অন্য পক্ষ চীন-রাশিয়াসহ তাদের মিত্র। ফলে বিদেশের দু’ভাগের দুই সাপোর্টও বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনায় ভূমিকা থাকছে। সব মিলিয়ে আগামী বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এ পক্ষগুলোর সক্ষমতা,প্রভাব বিস্তার থেকে শুরু করে অনেক কিছুইর প্রভাবই নির্বাচনের ওপর পড়বে। 

বাংলাদেশের মতো একটি দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় কে আসলো না আসলো এটা নিয়ে বহির্বিশ্বের মাথা না ঘামানোর কথা। কিন্তু ইদানিং অত্র অঞ্চলের (উপমহাদেশে) ভূ-রাজনীতি যেভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তাতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা। ফলে এ দেশে গণতন্ত্র,শান্তি,মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ চায় তারা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের (দাতা দেশসমূহ) একটা প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। প্রশ্ন আসতে পারে শান্তি আবার কী। শান্তি তো বিরাজমান। না। গত দুই জাতীয় নির্বাচন ছিল এক তরফা। এক দল ও তাদের মিত্রদের ইচ্ছার প্রতিফলন। অন্যরা সে নির্বাচন বয়কট,বর্জন,অংশ না নেয়া। বিরোধী মত মামলা-হামলা দিয়ে দমন। বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা স্পষ্ট বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে। ফলে সেটা কমিয়ে সাধারণ মানুষ যেন তাদের নেতা নির্বাচনটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে নিতে পারেন সেটাই চায় পশ্চিমাদেশসমূহ। 

তবে ইদানীংকালে দেশের প্রধান দুই দল বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশের প্রতিনিধিদের তৎপরতা একটু বেশি। তাদের প্রতিপক্ষ চীনও এ ব্যাপারে সোচ্চার। ভারত কিছুটা ব্যাকডোরে থেকে পরিস্থিতিটা অবজার্ভ করার চেষ্টা করে তাদের কর্মকৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। ফলে আগামী নির্বাচন যে কী হতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও একটা দুশ্চিন্তাকাজ করছে। 

কারণ দেশের প্রধান দুই দল ও তাদের মিত্ররা যেভাবে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে সেটা দেশের স্বার্থে এক টেবিলে বসে মীমাংসার অযোগ্য। এক দল বিশ্বাস করেনা অন্য দলকে। এটাই মূল সমস্যা। এ সুযোগটা এখন নিচ্ছে বাইরের শক্তি। এটা তো সত্য কোনো পরাশক্তি তাদের মতের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে সেখান থেকে তারা তাদের স্বার্থটা উদ্ধার করে নেবে, যা হতে পারে দেশের বৃহৎ কোনো স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও।

কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলার তাগিদ দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকার পশ্চিমা দূতাবাসগুলোকে চিঠি দেয়ার পর এসব দেশের কূটনীতিকরাও দৃশ্যত অনমনীয় অবস্থান নিয়েছেন। গত ১৮ জুলাই ঢাকার সব বিদেশি মিশনে চিঠি দিয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের কথা মনে করিয়ে দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ চিঠির পর পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা টুইট করে স্বাগতিক দেশে তাঁদের দায়িত্ব সম্পর্কে জানান দিয়েছেন। 

কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে চিঠি দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এটা কয়েক দিন পর পরই দিই। কারণ অনেক পরিবর্তন হয়। এ জন্য তাঁদের মনে করিয়ে দেয়া হয়। এটি পুরো বিশ্বেই হয়ে থাকে।

গত জুলাইয়ের সূচনায় যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোর জোট অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও প্রতিনিধিরা (১৪ দেশ) নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে প্রতিনিধিদলের পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাথাল চুয়ারড। 

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের বিষয়ে নাথাল চুয়ারড বলেন, নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত, দেশের গণতন্ত্র আরো কার্যকর ও শক্তিশালী, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিতে সহায়ক অবস্থা তৈরি এবং সকল অংশীজনের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে আমরা নির্বাচন কমিশনকে যে কোনো প্রকার সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। গণতান্ত্রিক ধারাকে আরো শাণিত করার মধ্য দিয়ে নাগরিকদের আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে সহায়তা করতে চায় ওইসিডি সদস্য দেশগুলো। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের হাইকমিশনাররা নির্বাচন কমিশনসহ সরকারও  নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যাসহ আগামী নির্বাচনে তারা কী চান সেটা ব্যাক্ত করেন। 

বিষয়টি ভালো চোখে দেখেনি সরকার। এরপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘের ভিয়েনা কনভেনশন মনে করিয়ে দিয়ে কূটনৈতিক মিশনকে চিঠি দেয়। এর জবাব দানে ছাড়েনি বিদেশি কূটনীতিবিদরা। তারাও বিভিন্নভাবে জানান দিয়ে দিয়েছেন, তারা যেটা করছেন, সেটুকু তাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। আগেও এমনটা হয়েছে। কেননা ২০১৮ ও ২০১৪ সনেও জাতীয় নির্বাচন ঘিরে প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিবিদরা সরাসরি বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এবং যা নির্বাচনে ফলাফলে প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এবার যারা কিছুটা তৎপর তারা তেমনটা কিছু করছেন না। দেশে সুশাসন,গণতন্ত্র,মানবাধিকার দেখতে চায় তারা। সে লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন যাতে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ হয়- এটাই তাদের প্রত্যাশা। কারন বিগত দুই নির্বাচনে যা ছিল অনুপুস্থিত। 

গত ১২ ও ১৩ জুলাই জাতিসংষের আবাসিক সমন্বয়ক প্রতিনিধি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদুত চার্লস ওয়াটলি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিএনপি শীর্ষনেতাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে কী হয়েছে সেটা মুখ খুলেনি উভয়পক্ষ। কী সেই আলোচনা বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সেটা জানার আগ্রহ সব মহলে। এটাও সরকারে থাকা দলের ভাল লাগার কথা না। এর বাইরেও কূটনীতিকরা ঢাকার বাইরেও বিভিন্নস্থানে গমন করেন। বিভিন্ন মহলে আলাপ আলোচনা করে রাজধানীর বাইরেও প্রান্তিক অঞ্চলে থাকা মানুষের মনমানসিকতা বোঝার চেষ্টা করছেন। 

কূটনীতিবিদের অবশ্যই একটা বাইন্ডিংস রয়েছে। সরকার বা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বা নাক গলানোর সুযোগ নেই। একই সঙ্গে তাদের কিছুটা দায়বদ্ধতাও আছে বলে তাদের দাবি। কেননা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ উন্নয়নসহযোগী দেশসমূহের কাছে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা চেয়ে থাকে। তারাও সুবিধামতো সেটা দিয়ে থাকে। এরমধ্যে করোনার ভ্যাকসিন অন্যতম ছিল। ফলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তাদের নখদর্পণে না থাকলে সে দেশ থেকে বাস্তব অবস্থা জানতে চাইলে তারা কিছুই আপডেট করতে পারবেন না। ফলে কিছু কিছু বিষয়ে নজর দেয়া-খবর রাখা তাদের প্রয়োজন শুধু দাতা বা উন্নয়নসহযোগী দেশ হিসেবে হলেও।  

এদিকে কূটনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সঙ্গেও বৈঠক করেন বিএনপির সঙ্গে। এমনকি সরকার দলের সঙ্গেও। সম্প্রতি এমন এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে। গত রোববারের ওই বৈঠক করে জার্মানির রাষ্ট্রদূত আখিম ট্র্যোস্টার তাঁর ভেরিফায়েড টুইটারে লিখেছেন, স্বাগতিক দেশের রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা কূটনীতিকদের মূল কাজ। সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ভালো বৈঠক হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু ও অংশীদার।

একইদিনে আরেক টুইটে নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত অ্যান ভ্যান লিউয়েন বলেন, স্বাগতিক দেশের পরিস্থিতি ও উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে কূটনীতিকরা যতো বেশি সম্ভব, অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠক করতে চান। ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ভালো বৈঠক হওয়ার তথ্য জানান তিনিও। 

এদিকে রাজনীতির মাঠও উত্তপ্ত হওয়াল লক্ষণ মিলেছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা তো বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছেন তাদের দাবি আদায়ে। আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীন ছাড়া অংশই নেবে না এটা পরিস্কার। সরকার এ দাবি মানতে নারাজ। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় নেতাকর্মীদের এখন থেকেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রস্ততি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখনও দেড় বছর বাকি। তার আগেই এমন নির্দেশনা আওয়ামী লীগে নানা পারিপার্শ্বিকতায় যে একটা উৎকণ্ঠা-অশান্তি বিরাজ করছে তারই প্রমাণ।

এমন উৎকণ্ঠা প্রধান বিরোধীদল বিএনপিদের মধ্যে গত ১৪ বছর ধরেই। এছাড়াও দেশের রিজার্ভ,বিদ্যুৎ ক্রাইসিস,দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সকল মানুষের মধ্যে একটা কমন উৎকণ্ঠা তো আছেই। হ্যাঁ, সেটার জন্য ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধটা দায়ী। তবু মানুষ অতো কিছু বুঝতে চায় না। দিনশেষে সরকারের ওপরই এসবকিছুর জন্য দায় চাপানের একটা প্রাণান্ত চেষ্টা করে, যা অতীতের সরকারের প্রতিও নানা সময়ে ছিল।  

 

শেয়ার করুন